মাটি ও ফসল:
একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন এবং রাসায়নিক সারের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার ফলে রাজ্যে চাষের জমির উৎপাদিকা শক্তি ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে শস্য উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধির হারকেও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
মাটির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং স্থায়ীভাবে উদ্ভিদ পুষ্টি সরবরাহের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে মাটিকে লালন করা এবং সুসংহত উপায়ে উদ্ভিদ খাদ্য সরবরাহ করা। বিভিন্ন ভৌতিক ও বায়ুমন্ডলীয় ক্রিয়া বিক্রিয়ায় মাটিতে প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ খাদ্য প্রস্তুত হলেও এক্ষেত্রে মাটিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জীব ও জীবাণুগুলির ভূমিকা অপরিসীম।
মাটিতে অবস্থিত বিভিন্ন ক্ষুদ্র জীব যেমন পিঁপড়ে, কেঁচো, পোকামাকড় প্রভৃতি এবং বিভিন্ন অণুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস, অ্যান্টিনোমাইসিটিস্ ইত্যাদি বিভিন্ন জৈবিক ক্রিয়ার মাধ্যমে মাটিকে চাষের উপযুক্ত করে রাখে। এরা মিলিতভাবে জৈব অবশেষ এবং অজৈব বস্তু (খনিজ) গুলোকে উদ্ভিদের খাদ্যে পরিণত করে অর্থাৎ জটিল জৈববস্তু জীবাণুর ‘পচন’ (Decomposition) প্রক্রিয়ায় সরল খাদ্যে পরিণত হয়।
দেখা গেছে আদর্শ মাটির প্রতি গ্রামে ১ কোটি ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। এক একর জমির ১৫-২০ সেমি গভীর মাটিতে ১৮০-১৮০০ কেজি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। আবার ১ গ্রাম মাটিতে ১ লক্ষ থেকে ১ কোটি পর্যন্ত ছত্রাক পাওয়া যেতে পারে। সমপরিমাণ মাটিতে প্রায় ১ লক্ষ অ্যাক্টিনোমাইসিটিস্ বসবাস করে। ১ একর জমিতে যার পরিমাণ ১৮০-১৮০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এই হল জীবন্ত মাটির ধারণা।
এই ধরণের অণুজীবেরা কেবল উদ্ভিদ খাদ্যই সরবরাহ করে না, এরা ফসলের বৃদ্ধির উপযোগী নানারকম হরমোন, উৎসেচকও সরবরাহ করে। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে গাছকে পুষ্টি যোগায়। মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক ধর্মকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে এই সকল জীবাণু। ক্রমাগত যথেচ্ছ রাসায়নিক সার প্রয়োগে এদের সংখ্যা ক্রমহ্রসমান।
সবুজ বিপ্লবের যুগে শস্য উৎপাদনের ৪টি প্রধান হাতিয়ার ছিল উচ্চফলনশীয়। জাত, রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক ও সেচ। বাড়তি ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সারের অবদান ছিল ৬০ শতাংশ। কাজেই রাসায়নিক সারকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে উৎপাদনের গতিকে বজায় রাখাও সম্ভব নয়। তাই রাসায়নিক সারের কুফলকে ন্যূনতম করে মাটির স্বাস্থ্যকে ভালো রাখার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপের সমন্বয় দরকার। যেমন, ১) মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করা, ২) মাটির জৈবিক পদার্থ হিউমাসকে বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় জৈব সার প্রয়োগ করা, ৩) মাটিতে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য জীবাণুসার ব্যবহার করা, ৪) মাটির বিক্রিয়া (যেমন অম্লত্ব, ক্ষারত্ব) ঠিক রাখার জন্য চুন, ডলোমাইট, জিপসাম প্রয়োগ করা এবং ৫) সঠিক শস্য পর্যায় অনুসরণ করা যাতে মাটিতে অবস্থিত খাদ্য সঠিকভাবে বিভিন্ন ফসলে বন্টন করা সম্ভব হয়।
মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে জমিতে সার প্রয়োগ:
মাটির নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি – জমির চারধার থেকে দুই ফুট ভেতরে ৬-৮টি জায়গা থেকে এবং মাঝখানের ২-৪টি থেকে জায়গা এলোমেলো ভাবে বা কোনাকুনি ভাবে (Zig Zag) নির্বাচন করে জমির উপরের অংশের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রতিটি স্থানের উপর থেকে ৬ ইঞ্চি ৯ ইঞ্চি নিচ পর্যন্ত মাটি ‘V’ আকৃতি করে কেটে ফেলে দিতে হবে। ফসলের শেকড়ের গভীরতা অনুসারে ‘V’ আকৃতির গর্তের ধার থেকে মাটির পাতলা স্তর সংগ্রহ করে একসাথে মেশাতে হবে। পুরো মাটি ছায়ায় শুকিয়ে গুঁড়ো করে চারটি সমান ভাগে ভাগ করে আড়াআড়ি দু’ভাগ ফেলে দিতে হবে। পড়ে থাকা মাটিকে পুনরায় ৪ ভাগ করে ২ ভাগ নিয়ে ৫০০ গ্রাম মাটি একটি পলিথিনের প্যাকেটে নিম্নলিখিত বিবরণ সহ মাটি পরীক্ষা কেন্দ্রে বা স্থানীয় সহ কৃষি অধিকর্তার অফিসে পৌঁছে দিতে হবে।
মাটির নমুনা সংগহ করার সময় কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে, যেমন- জমিতে ফসল থাকাকালীন অবস্থায়, সারের গর্ত, পুরাতন আল, জলাজমি বা সার দেওয়া জমি থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। মাটির নমুনা পরিষ্কার নতুন পলিথিন প্যাকেটে সংগ্রহ করতে হবে ও মিহি করে গুঁড়ো করতে হবে। নমুনার মাটি যেন ভেজা না থাকে।
মাটির নমুনা সম্পর্কে তথ্যাবলী
সাধারণত মাটি পরীক্ষাতে মাটির পি এইচ বা ক্ষারাম্লমান, তড়িৎ পরিবাহিতা বা লকণাক্তত জৈব কার্বন ও এন.পি.কে-এর পরিমাণ জানা যায়। মাটির পি.এইচ থেকে অম্লত্ব ও ক্ষারার জানা যায়। পি.এইচ ৬.৫-এর কম হলে মাটি আম্লিক ও ৭.৫-এর বেশি হলে ক্ষারীয় বালে ধরা হয়। পি.এইচ. ৬.৫-এর কম হলে মাটি শোধনের জন্য চুন কিংবা ডলোমাইট প্ররোগের প্রয়োজন পড়ে। পি.এইচ ৮.০-এর বেশি হলে অনেক ক্ষেত্রে জিপসাম প্রয়োগের দরকার হয়।
মাটি সংশোধনের জন্য চুন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগ (কুইন্টাল/একরে)
চুনজাতীয় পদার্থ | বেলে বা বেলে দোআঁশ | দোআঁশ বা পলি দোআঁশ | কাদা ও কাদা দোআঁশ |
১) চুনাপাথর বা ঘুটিং ২) বেসিক স্ল্যাগ বা গুঁড়ো/ চুন বা কাঠ-তুষের ছাই | 10 5 | 20 10 | 30 15 |
বিঃ দ্রঃ – সাধারণতঃ পি.এইচ ৬.০-এর নিচে হলে প্রতি ০.১ পি.এইচ বাড়ানোর জন্য একর প্রতি আরও ২০০ কেজি চুন প্রয়োগ দরকার। আর পি.এইচ ৮-এর ওপরে হলে ০.১.পি.এইচ কমানোর জন্য প্রতি একরে আরও ২০০ কেজি জিপসাম প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়। চুন প্রয়োগের সময় গুঁড়ো করে মেশানো ভালো। মাটির ৬ ইঞ্চি গভীরতার মধ্যে চুন মিশিয়ে দিতে হবে। ফসল লাগানোর কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ আগে চুন মেশাতে হয়।
গ্রীষ্মকালে জমিতে চুন দেওয়া ভালো। জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় চুন দেওয়া যাবে না। হাল্কা মাটিতে কম ও ভারী মাটিতে বেশি চুন প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। উত্তরবঙ্গের জমিতে চুনের পাশাপাশি ডলোমাইট প্রয়োগ বেশি যুক্তিযুক্ত।
অনেকে জিপসামকে চুনের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু জিপসাম সোডিয়াম সমৃদ্ধ ক্ষারমাটি শোধনের জন্য ব্যবহার করা হয়। ফসল লাগানোর ১ মাস আগে জিপসাম প্রয়োগ করে জমিতে সেচ দিতে হয়।
মাটির তড়িৎ পরিবাহিতার মান ১ মিলি মোজ/সেমি-এর কম হলে স্বাভাবিক। এই মান ১-২ মিলি মোজ/সেমি হলে বীজের অঙ্কুরোদগমে অসুবিধা হয় এবং ২-৩ মিলি মোজ/সেমি হলে লবণ সহনশীল ফসলেরও অসুবিধা হয়। এই মান ৩ মিলি মোজ/সেমি- এর বেশি হলে বেশিরভাগ ফসলের পক্ষে ক্ষতিকারক।
মাটিতে গ্রহণযোগ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ জানতে জৈব কার্বনের মান নির্ণয় করা হয়। কারণ জৈব কার্বনের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য নাইট্রোজেনের সঙ্গে সমানুপাতে থাকে।
পাশাপাশি, মাটিতে গ্রহণযোগ্য ফসফেট ও পটাশের পরিমাণ উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন-এর কোন মাত্রায় থাকে তা নির্ণয় করা হয়। উর্বরতার মান অনুযায়ী কৃষি দপ্তর থেকে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন উর্বরতার মানের মাটির জন্য ফসলে সার প্রয়োগের সুপারিশ আছে। এই পুস্তিকার শেষে বিভিন্ন ফসলে সারের সুপারিশকৃত তালিকা দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকা থেকে মাটি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশের মান অনুযায়ী ফসলে সারের সুপারিশ করা হয়।
জৈব সার:
উদ্ভিদ ও প্রাণী জাত দ্রব্য হল জৈব সার। আবর্জনা, গোবর, সবুজ সার, গাছপালা, খড় প্রভৃতি জৈব বস্তু এ কাজে ব্যবহার করা যাবে। যে সকল মাটিতে জৈব বস্তু কম থাকে সেখানে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা কম পাওয়া যায়।
জৈব সার প্রয়োগে মাটির গঠন উন্নত হয়। মাটির মধ্যে বায়ু চলাচল ও মাটির জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মাটির অম্লত্ব, ক্ষারত্ব ও তাপমাত্রার সাম্য বজায় থাকে। গাছ অণুখাদ্যের সরবরাহ পায়। মাটিতে প্রয়োগ করা রাসায়নিক সারকে জৈব পদার্থ ধরে রাখে ও গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসতে সাহায্য করে।
জৈব সার তৈরীর কৌশল:
জৈব সারের উৎসগুলো হল গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়ার মলমূত্র, হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা, গৃহপালিত পশুর দেহাবশেষ, তাজা-শুকনো রক্ত, শুকনো মাছ এবং মাছের গুঁড়ো, কচুরি পানা, জঙ্গলের লতা-পাতা, তরকারীর খোসা, বিভিন্ন ফসলের অবশিষ্টাংশ যেমন, ধান ও গমের খড়, সবজির পাতা, পাট পাতা, মাছের নাড়ীভুড়ি, ডিমের খোসা, চামড়া, হাড়, কাঠের গুঁড়ো, গম ও ধানের কুড়ো, চিটে ধান, শহরের সকল প্রকার জৈব আবর্জনা ইত্যাদি।
উক্ত উপকরণ ব্যবহার করে জৈব সার তৈরী করতে গেলে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় অবলম্বন করা দরকার। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে, যে স্থানে জৈব পদার্থ পচানো হচ্ছে সেখানে যেন বাইরের জল ও সূর্যালোক প্রবেশ না করে এবং যে বস্তু পচানো হচ্ছে তা যেন বাইরের বাতাস থেকে মুক্ত থাকে। এর ফলে সক্রিয় জীবাণুগুলি দ্রুত পচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
কম্পোস্ট সার তৈরীর পদ্ধতিঃ
গর্তের মাপ হবে গভীরে ৩ ফুট ও চওড়ায় ৫ ফুট এবং লম্বার মাপ প্রয়োজন অনুসারে করা যেতে পারে। গর্তের নিচে প্লাস্টিক, ইট বিছিয়ে জল নিরোধক করতে হবে। প্রথম স্তরে খড়, গোয়ালের আবর্জনা, তুষ, তরকারীর খোসা ইত্যাদি দিতে হবে দেড় ইঞ্চি পুরু করে। এর উপর ইঞ্চি ছয়েক পুরু করে গোবর, হাঁস-মুরগীর মল, সবুজ পাতা দিতে হবে। একদম উপরের স্তরে এক ইঞ্চি পুরু হালকা মাটির স্তর দিতে হবে। এভাবে আবর্জনা বিছানোর উদ্দেশ্য হল প্রথম স্তর হবে কার্বনের, দ্বিতীয় স্তর হবে নাইট্রোজেনের এবং তৃতীয় স্তর হবে মাটির। এই তিনটি স্তর নিয়ে একটি ধাপ। গর্তে এরকম তিনটি ধাপ থাকবে। মাটির স্তরের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ সুপার ফসফেট মেশালে পচন ক্রিয়া দ্রুত হবে। কাবন স্তরের আবর্জনার সেলুলোজ পচানোর জন্য অ্যাসপারজিলাস কালচার, ট্রাইকোডার্মা দেওয়া যেতে পারে। জৈব সারে ফসফেটের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ফসফেট দ্রবণকারী ব্যাকটেরিয়া (PSB) মেশালে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
কম্পোস্ট তৈরীর সময় বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে-
১) সমস্ত আবর্জনা যত ছোট টুকরো করা যাবে তত পচনক্রিয়া ভালো হবে।
২) কম্পোস্ট ঢিপি যেন খুব রোদ ও ছায়ায় না থাকে।
৩) কম্পোস্টে জল জমা উচিত নয়।
কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট:
জমিতে জৈব সার প্রয়োগের পরিমাণ বেশি হওয়ায় অনেক সময় তা ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বর্তমানে কেঁচো সার ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে। এই সার কেঁচো নিঃসৃত উর্বর বর্জ্য পদার্থ যা অল্প পরিমাণ প্রয়োগে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। কেঁচো অর্ধ পচা জৈব পদার্থ খেয়ে মল আকারে তা বার করে দেয় এবং একেই কেঁচো সার বলা হয়। কেঁচোর মলে ঐ জমির মাটির তুলনায় ৪-৫ গুণ বেশি নাইট্রোজেন, ৫-৭ গুণ বেশি ফসফেট এবং প্রায় ১১ গুণ বেশি পটাশ পাওয়া যায়। এর খাদ্যনালীতে মাটির তুলনায় ৫০০-১০০০ গুণ বেশি উপকারী জীবাণু থাকে যা অল্প সময়ে জৈব পদার্থকে হিউমাসে পরিণত করে। মাটিতে কেঁচোর মলমূত্র, শ্লেষ্মা মিশে মাটির অম্লত্ব, ক্ষারত্বের মধ্যে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে। এছাড়া এরা মাটিকে ওলোটপালট করে বাতাস চলাচল, জলধারণ ও নিকাশী ক্ষমতা ভালো করে।
কেঁচোর জাত:
আইসেনিয়া ফোটিডা, ইউড্রিলাস ইউজেনি নামক দুটি জাত খুব দ্রুত কেঁচো সার তৈরী করে। লালচে রঙের এই কেঁচোরা প্রত্যেকদিন নিজের দেহের ওজনের সমপরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে। দেখা গেছে ১ লক্ষ ২০ হাজারটি কেঁচো বছরে প্রায় ১৭-২০ টন জৈব পদার্থ পরিপাক করে সারে পরিণত করে।
কেঁচো সার তৈরীর পদ্ধতিঃ
কেঁচো সার তৈরী করার জন্য যে পাত্র বা মেঝের উপর করা হবে তার গভীরতা যেন খুব বেশি না হয়। ৬ ইঞ্চি ১ ফুট পর্যন্ত গভীর, চওড়া ৩-৪ ফুট এবং লম্বা প্রয়োজনমতো। প্রতি বর্গফুটের জন্য ২৫-৩০টি কেঁচো ছাড়া হয়। এই গর্ত থেকে প্রতি দুই মাসে ১৫০-২০০ কেজি কেঁচো সার উৎপাদন হতে পারে।
মাটির নিচে গর্ত করলে ১ ফুট গর্ত হবে। কেঁচোর গর্তের ভিতর খোয়া, বালি দিয়ে ১ ইঞ্চি পুরু একটি স্তর করতে হবে। এই স্তরের উপর বাঁশের তৈরী মাচা করে দিতে হবে। এর উপর গোবর সার মিশ্রিত অর্ধ পচা জৈব সার দিয়ে এর মধ্যে কেঁচো ছাড়তে হবে। সবার উপরে ভেজা চটের আচ্ছাদন দিতে হবে। সিমেন্টের মেঝের উপরে গর্ত করলে ৬ ইঞ্চি গভীরতা হবে।
সার তৈরী হয়ে গেলে জল দেওয়া বন্ধ করতে হবে, কেঁচো নিচে চলে যাবে এবং ওপরের স্তর থেকে ভার্মিকম্পোস্ট সংগ্রহ করতে হবে।
বিঘা (৩৩ শতক) প্রতি ৫০০-৭০০ কেজি কেঁচো সার জমিতে দিলে উপকার পাওয়া যাবে। প্রতি টবে ১০০ গ্রাম কেঁচো সার দেওয়া যাবে।
সতর্কতাঃ
১) কেঁচোর খাদ্য হিসাবে অর্ধ পচা জৈব সার যেমন দরকার তেমনি চুন জাতীয় পদার্থ, লঙ্কা, মাংসের টুকরো, মাছ, রসুন, পেঁয়াজের খোসা ইত্যাদি যেন ব্যবহার না করা হয়।
২) কেঁচোর গর্তের তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি হলে কেঁচো গর্তে থাকবে না।
৩) গর্তে পিঁপড়ের উপদ্রব হলে চারিদিকে লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো ও লবণ সমপরিমাণে মোট ১০০ গ্রাম নিয়ে ১০ লিটার জলে গুলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
তরল সার:
একটি ড্রামে ১০০ লিটার জল নিয়ে ৫-৭.৫ কেজি শুঁটি জাতীয় ও তীব্র গন্ধ যুক্ত পাতা এবং ৫-৭.৫ কেজি গোবর বা ছাগল, ভেড়া, মুরগীর বিষ্ঠা এক সাথে মেশাতে হবে।
প্রথমে কাঁচা গোবর সবুজ পাতার সঙ্গে মিশিয়ে বস্তায় ভরে জলভর্তি ড্রামে ডুবিয়ে দিতে হবে। প্রতিদিন একটি লাঠি দিয়ে ড্রামের জল নাড়াতে হবে। এইভাবে ৩ সপ্তাহ
রেখে সার তৈরী হয়ে গেলে দ্রবণের কোনও বাজে গন্ধ থাকবে না। উক্ত তরল সারের সঙ্গে ২০০ গ্রাম ঝোলা গুড় মেশালে এর গুণমান বাড়বে। সারটির সঙ্গে সমপরিমাণ জল মিশিয়ে সকালে বা বিকালের মধ্যে ছড়াতে হবে। তরল সার ঠান্ডা ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এতে এর গুণাগুণ বজায় থাকবে।
সবুজ সার হিসাবে মাঠে ধনে লাগানো ধন্চ অন্যান্য শুঁটি জাতীয় গাছের চেয়ে অনেক বেশি নাইট্রোজেন মাটিতে সরবরাহ করে। ৪০-৪৫ দিন বয়সের ধনচে গাছ একর প্রতি জমিতে ৪০-৫০ কেজি নাইট্রোজেন যোগ করে।
বিঘা প্রতি ৪ কেজি ধনচে বীজ জ্যৈষ্ঠ মাসে একবার লাঙল দিয়ে কালবৈশাখীর বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে লাঙল দিয়ে কচি গাছ মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে একর প্রতি ১৫-২০ টন জৈববস্তু মাটিতে যুক্ত হবে। ধনে লাগানোর আগে মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে বিঘাপ্রতি ৬০-১০০ কেজি চুন প্রয়োগ করলে বেশি নাইট্রোজেন পাওয়া যায় এবং পচনের ফলে যে জৈব অ্যাসিড তৈরী হয় তা নষ্ট হয়ে যায়।
জমিতে পাতা সার প্রয়োগ:
সুবাবুল, পাথর কুচি, গ্লাইরিসিডিয়া, জোয়ার, বাজরা, সূর্যমুখী ইত্যাদি গাছের পাতা জমিতে ফসল লাগানোর পূর্বে প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এক্ষেত্রেও চুন প্রয়োগ করতে হবে।
জীবাণু সার:
মাটিতে বসবাসকারী জীবাণুর মধ্যে কেবলমাত্র ৫ শতাংশ জীবাণু ক্ষতি করে আর বাকী ৯৫ শতাংশ জীবাণুই উপকারী। এ সকল উপকারী জীবাণুদের এখন কৃষি উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাটিতে উদ্ভিদ খাদ্য সরবরাহকারী জীবাণুগুলি হল-
১) নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী
২) ফসফেট দ্রাবক
৩) পটাশ সমাবেশকারী
৪) গন্ধক ক্ষরণকারী
৫) মাইকোরাইজা
নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী জীবাণু সার:
কৃষিতে বহুল ব্যবহৃত নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী জীবাণু সারগুলি হল রাইজোবিয়াম, অ্যাজোটোব্যাক্টর এবং অ্যাজোস্পিরিলাম।
রাইজোবিয়াম – শিম্বী গোত্রীয় গাছের শেকড়ে এরা মিথোজীবী হিসাবে বসবাস করে।
এরা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে গাছের শেকড়ের গুটির মধ্যে সঞ্চয় করে। বিভিন্ন পরিবেশ অনুযায়ী রাইজোবিয়াম জীবাণু একর প্রতি ২০-৩০ কেজি পর্যন্ত নাইট্রোজেন যোগান দিতে পারে। শিম্বী জাতীয় ফসলের বীজের সাথে রাইজোবিয়াম মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। বিঘা প্রতি ২০০ গ্রাম হিসাবে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে। ফসলভেদে রাইজোবিয়ামের প্রজাতি ভিন্ন।
অ্যাজোটোব্যাক্টব – এই জীবাণু শিম্বীগোত্রীয় ফসল ছাড়া যেকোন ফসলে ব্যবহার করা যায় এবং গাছের চাহিদার ১০-২০ শতাংশ নাইট্রোজেন যোগান দিতে পারে।
অ্যাজোস্পিরিলাম – তন্ডুল ও সবজি জাতীয় ফসলে এই জীবাণু ব্যবহার করা যায়। এরা গাছের শেকড়ের বাইরে এমনকি তার কোষের ভেতর নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে। এরা একর প্রতি জমিতে ১৪-১৬ কেজি পর্যন্ত নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে।
ফসফেট দ্রবণকারী জীবাণ জমিতে যে ফসফেট সার ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগটাই মাটিতে আবদ্ধ হয়ে যায়। ফলে জমিতে ফসফেটের অভাব পরিলক্ষিত হয়। মাটিতে বসবাসকারী জীবাণু যেমন ব্যাসিলাস, সিউডোমোনাস এবং ছত্রাকের মধ্যে অ্যাসপারজিলাস ও পেনিসিলিয়াম ইত্যাদি মাটির অদ্রবণীয় ফসফেটকে গাছের গ্রহণযোগ্য করে তোলে এবং এই ধরণের জীবাণুর ব্যবহারে ফসফেটের অপচয় রোধ হয়। এই জীবাণুব ব্যবহারে গাছের ফসফেট চাহিদার ২০-২৫ শতাংশ যোগান দেওয়া সম্ভব হয়।
প্রতি একরে ২ কেজি এই জীবাণু সার জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে জমি তৈরীর সময় ব্যবহার করা হয়।
পটাশ সমাবেশকারী জীবাণু- ফ্রাটুরিয়া অরানশিয়া নামক জীবাণুটি মাটিস্থিত অদ্রবণীয় পটাশ সরবরাহ করতে সক্ষম।
গন্ধক-ক্ষরণকারী জীবাণু:- তৈলজাতীয় ফসল, পেঁয়াজ, রসুন, ফুলকপি ও বাঁধাকপি ইত্যাদি ফসলের জন্য প্রচুর পরিমাণ গন্ধকের প্রয়োজন হয়। অ্যাসিটোব্যাক্টর, প্যাস্টুরিয়ানামস্ জীবাণু ব্যবহার করলে গাছ গন্ধক পায়।
মাইকোরাইজা – গ্লোমাস, জাইগোস্পোরা, অ্যাকোলোস্পোরা ইত্যাদি ছত্রাক ফসলের শেকড়ে বাসা বেঁধে থাকে এবং গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ ধরণের ছত্রাককে মাইকোরাইজা বা ‘VAM’ বলে। এই জাতীয় ছত্রাক গাছকে ফসফরাস ও বিভিন্ন অণুখাদ্য যোগান দেয়।
জীবাণু সার ব্যবহার করার সময় মাথায় রাখতে হবে, ১) তা যেন রাসায়নিকের সংস্পর্শে না আসে, ২) জীবাণু সারের কার্যকারিতা বেশিদিন থাকে না, তাই উৎপাদনের ৬ মাসের মধ্যে ব্যবহার করা দরকার, ৩) জীবাণু সার প্রয়োগের সময় জমিতে যথেষ্ট পরিমাণ জৈব বস্তু থাকা দরকার, ৪) জীবাণু সার বহনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখা দরকার। অন্যথায় জমিতে পৌঁছনোর আগে জীবাণুর কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ধানক্ষেতে অ্যাজোলা: অ্যাজোলা হল একটি খুব ছোট পানা যা ১ সপ্তাহে দ্বিগুণ বাড়ে।
অ্যাজোলার পাতার মধ্যে ‘অ্যানাবিনা অ্যাজোলি’ নামে জীবাণু বাস করে, যা বাতাসের নাইট্রোজেন থেকে সার তৈরী করে। এক বিঘা জমির এজোলা দিনে প্রায় ২ কিলো ইউরিয়ার সমান নাইট্রোজেন দেয়।
শুকনো অ্যাজোলায় শতকরা ৪ ভাগ নাইট্রোজেন, ১ ভাগ ফসফরাস, ২-৩ ভাগ পটাসিয়াম থাকে।
অ্যাজোলা সার হিসাবে ব্যবহার:
জমিতে জল দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই কাদা করে, অ্যাজোলা ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। সঠিক আবহাওয়ায় ৫ কিলো অ্যাজোলা ১০০ দিনে ২০০ কুইন্টালও হতে পারে। ধানের ক্ষেতে রোপণ ও নিড়ানের সময় অ্যাজোলা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। অ্যাজোলা গরমে ভালো হয় না। ছায়াতে, ৪-৭ পি.এইচ-এ এবং অধিক আর্দ্রতায় অ্যাজোলা ভালো হয়। অ্যাজোলা দিয়ে ভালো কম্পোস্ট তৈরী হয়।
নীল-সবুজ শ্যাওলা :
এক ধরণের শ্যাওলা যারা মাটিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। ধানের জমিতে এই শ্যাওলা খুবই কার্যকরী।
নীল-সবুজ শ্যাওলায় শতকরা হিসাবে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশের পরিমাণ যথাক্রমে ২.৪৭, ০.১২ এবং ০.৩৭।
এই শ্যাওলা গ্রামে-গঞ্জে ডোবা বা জলা জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। পরিষ্কার জলাশয়ের তলদেশে যেসব শ্যাওলার গায়ে মুক্তোর মত বিন্দু জলের বুদবুদ্ দেখা যায়, সেগুলিই নীল-সবুজ শ্যাওলা।
খোল সার:
মাটিতে রাসায়নিক সারের মাত্রা কমিয়ে উদ্ভিদ খাদ্য সরবরাহ করার অন্যতম উপাদান হিসাবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের খোলের ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ছে। কৃষিতে নানা ধরনের খোলের মধ্যে সর্ষে, তিল, বাদাম, মহুয়া, নিম খোলের ব্যবহার বেশি হয়।
দেখা গেছে কুসুমের খোলে সবচেয়ে বেশি নাইট্রোজেন (৮ শতাংশ) পাওয়া যায়। আবার তুলোর বীজের খোলে ফসফরাস এবং পটাশের পরিমাণ যথাক্রমে ৩ শতাংশ এবং ২.২ শতাংশ। যেকোন খোল জমিতে প্রয়োগের পূর্বে গুঁড়ো করে দিলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
সর্যের খোল জমিতে দিলে তা থেকে গাছ দ্রুত খাবার গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে মহুয়া খোল জমিতে দিলে পচতে প্রচুর সময় নেয়। নাইট্রোজেন ঘটিত রাসায়নিক সারের সঙ্গে নিম খোল জমিতে প্রয়োগ করলে নাইট্রোজেন সহজে চুঁইয়ে নষ্ট হয় না।
প্রাণীজ হাড় ও রক্ত থেকে প্রাপ্ত সার:
বোন ও ব্লাড মিল নামে এরা পরিচিত। এসব সারে বেশি মাত্রায় ফসফরাস এবং অণুখাদ্য থাকায় এগুলো খুবই কার্যকরী। বিশেষ করে ফুল চাষে হাড়ের গুঁড়ো এবং ব্লাড মিল মাটির গুণগত মান উন্নত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। বাষ্প সিদ্ধ হাড়ে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ফসফরাস থাকে। ব্লাড মিলে ৭ শতাংশ পর্যন্ত নাইট্রোজেন পাওয়া যায়।
মাটিস্থিত খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের জন্য সঠিক শস্য পর্যায়:
ব্যবহৃত সার ও মাটিতে উপস্থিত খাদ্যের সঠিক ব্যবহারে বিজ্ঞানভিত্তিক শস্য পর্যায়ের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। একই ফসল এক জমিতে বারবার চাষ করলে মাটির একটি নির্দিষ্ট স্তর থেকে একই ধরণের খাদ্য উপাদানগুলি অপসারিত হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে। প্রতি বছর শস্যপর্যায় এমনভাবে ঠিক করা উচিত যাতে নির্বাচিত ফসলগুলো মাটির বিভিন্ন স্তর থেকে খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করতে পারে। শস্য পর্যায়ের ফসলগুলির অন্ততঃ একটি শিম্বগোত্রীয় গোখাদ্য বা ডালশস্য অথবা সবুজ সার জাতীয় ফসল যেমন ধচে হওয়া বাঞ্ছনীয়। শস্যপর্যায়ের একটি ফসল যদি পাট হয় তাহলে পাটের পাতার পচনের ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
বিভিন্ন ফসলের অবশিষ্টাংশে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ পাওয়া যায়-
সুপারিশ অনুযায়ী ফসলে সার প্রয়োগ এর হিসাব:
কোন্ ফসলে কোন্ সার কতটা দিতে হবে, তা জানা দরকার। বাজারে বিভিন্ন সার বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। কোন্ সার কতটা নাইট্রোজেন, কতটা ফসফেট ও কতটা পটাশ সরবরাহ করতে পারবে, তা দেখে নেওয়া দরকার।
১ কেজি না. সার পেতে হলে ১ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে চলবে না। এজন্য। ইউরিয়া সারের মধ্যে শতকরা কতভাগ নাইট্রোজেন আছে জানতে হবে। ইউরিয়া সারের বস্তার গায়ে 46% N লেখা থাকে। অর্থাৎ ১০০ গ্রাম ইউরিয়াতে ৪৬ গ্রাম নাইট্রোজেন আছে।
অতএব, ১ কেজি নাইট্রোজেন
= ২ কেজি ২২০ গ্রাম ইউরিয়া (৪৬% N) থেকে
= ৫ কেজি অ্যামোনিয়াম সালফেট (২০% N)
= ৪ কেজি ক্যান বা সোনা সার (২৫% N)
মাটিতে ১ একর উচ্চফলনশীল বোরো ধানের চাষের জন্য সারের সুপারিশকৃত মাত্রা হল এন.পি.কে ৫২: ২৬: ২৬ কেজি। এখন দেখা যাক এই পরিমাণ উদ্ভিদ খাদ্য যোগান দিতে কোন সার কত পরিমাণ লাগবে।
৫২ কেজি নাইট্রোজেন= ১১৪.৫ কেজি ইউরিয়া
২৬ কেজি ফসফেট = ১৬২.৫ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট
২৬ কেজি পটাশ = ৪৩.২৫ কেজি মিউরেট অফ পটাশ আবার ডি.এ.পি. ব্যবহার করলে ২৬ কেজি ফসফেটের জন্য ৫৬.৫ কেজি ডি.এ.পি. লাগবে। পাশাপাশি এই ৫৬.৫ কেজি ডি.এ.পি. থেকে ১০.১৭ কেজি নাইট্রোজেন পাওয়া যাবে। তাই মোট নাইট্রোজেন সার থেকে ১০.১৭ কেজি নাইট্রোজেন বাদ দিয়ে বাকি নাইট্রোজেন অর্থাৎ ৪১.৮৩ কেজি নাইট্রোজেন সরবরাহ করতে হবে। তখন মোট ইউরিয়ার পরিমাণ কমে গিয়ে ৯২ কেজি হবে। মিউরেট অফ পটাশ আগের মতো একই থাকবে। এইভাবে পছন্দ অনুযায়ী অন্যান্য সারের পরিমাণ হিসাব করা যায়। সাধারণতঃ নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ ২:১:১ অনুপাতে প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ ২ কেজি নাইট্রোজেন প্রয়োগ করলে ১ কেজি ফসফেট ও ১ কেজি পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে সুপারিশমতো কোন সার কখন প্রয়োগ করতে হবে তাও মেনে চলা দরকার।
বর্তমানে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ ছাড়া সালফার এবং অণুখাদ্য প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। তাই, উপযুক্ত সার প্রয়োজনমতো প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল চাষে সালফার প্রয়োগ:
মাটিতে সালফারের পরিমাণ ১০-১২ পি.পি.এম (দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ বা মিগ্রা/কেজি) এর কম থাকলে ফসলে সালফারের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা যায়। সালফারের অভাবে গাছের নতুন পাতা হলদে হয়ে যায়, যা নাইট্রোজেনের অভাবজনিত লক্ষণের মতো। তবে সালফারের ক্ষেত্রে বয়স্ক পাতাগুলি ধীরে ধীরে শুকাতে শুরু করে কিন্তু নাইট্রোজনের ক্ষেত্রে তা দ্রুত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বেশিরভাগ স্থানে এবং মুর্শিদাবাদ ও বাঁকুড়া জেলার কিছু স্থানে সালফারের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডালশস্য, তৈলবীজ, আলু, সবজি এমনকি ধানেও সালফার প্রয়োগে ফলন বৃদ্ধি ঘটছে।
ফসলে সালফারের অভাব মেটাতে বেশি সালফারযুক্ত সার ব্যবহারের ওপর নজর দেওয়া উচিত। সারগুলি হল অ্যামোনিয়াম সালফেট (২৪% S), সিঙ্গল সুপার ফসফেট (১২% S), পটাসিয়াম সালফেট (১৮% ১), ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (১৩% S)। উচ্চ পি.এইচ. যুক্ত মাটিতে মৌল সালফার বা পাইরাইট (২২% S) অথবা ফসফো-জিপসাম (১৬% ১) ব্যবহার করা যায়। মাটি ও ফসলের ওপর নির্ভর করে একর প্রতি ৮-২০ কেজি সালফার প্রয়োগ করা যায়। চীনাবাদাম চাষে শেষ মাটি ধরানোর সময় একর প্রতি ২০০ কেজি জিপসাম (১৩% ১) প্রয়োগে ফলন বৃদ্ধি হয়।
অণুখাদ্য:
অণুখাদ্য তরকারিতে নুনের মতো অল্প পরিমাণে দরকার, কিন্তু লাগবেই। কোন অণুখাদ্যের অভাব অন্য কোন খাদ্য দিয়ে পূরণ করা যাবে না। আবার মাটিতে অত্যধিক অণুখাদ্য প্রয়োগে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নানা অণুখাদ্যের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অভাবজনিত লক্ষণ দেখে অণুখাদ্য প্রয়োগের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রয়োজন। অণুখাদ্য মাটিতে প্রয়োগ না করে পাতায় স্প্রে করা বেশি যুক্তিযুক্ত। এতে মাটিতে অণুখাদ্যের আধিক্যহেতু বিষক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
মাটিতে অণুখাদ্যের সংকটময় মাত্রার মান (পি.পি.এম. বা মিগ্রা / কেজি)
উপাদান | নিষ্কাষণ পদ্ধতি | সংকটময় মাত্রার মান | প্রযোজ্য ফসল |
---|---|---|---|
জিঙ্ক বা দস্তা | ডি.টি.পি.এ দ্রবণে | ০.৬০-১.০০ | ধান, গম ও তৈলবীজ |
বোরন | গরম ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণে | ০.৫০ – ০.৩৬ | ধান, গম ও তৈলবীজ |
মলিবডেনাম | অ্যামোনিয়াম অক্সালেট দ্রবণে | ০.০৫ (তুলা শস্য, তৈলবীজ, সবজি জাতীয় ফসলের জন্য) এবং ০.২০ (ফুলকপি ও ফুলের জন্য) | তুলা শস্য, তৈলবীজ, সবজি, ফুলকপি ও ফুল |
কপার বা তামা | ডি.টি.পি.এ দ্রবণে | ০.২০ | ধান, ভুট্টা ও লেবু |
আয়রণ বা লোহা | ডি.টি.পি.এ দ্রবণে | ২.৫-৪.৫ | ধান, গম, ভুট্টা ও তৈলবীজ |
ম্যাঙ্গানীজ | ডি.টি.পি.এ দ্রবণে | ১.০ | ধান, গম ও কিছু বাগিচা ফসল |