মানব সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনসংখ্যা বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য চাহিদা বেড়েছে। খাদ্য চাহিদা মেটাতে নিত্য নতুন কৃষি উপকরণের ব্যবহার এবং শস্য নিবিড়তা বেড়েছে। উন্নতমানের বীজ, সার, সেচ ও কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি ‘দ্য উৎপাদনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লব ঘটানো হল। বেশি ফলাতে গিয়ে দেখা গেল রোগ-পোকার আক্রমণও বেড়ে গেছে। কীটনাশকের বেশি ব্যবহার সবুজ বিপ্লবের অঙ্গ ছিল। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের সুফল বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। মাটির উৎপাদিকা শক্তিতে টান পড়ল এবং রোগ-পোকার উৎপাত বেড়ে গেল। কৃষকেরা ফসল বাঁচাতে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার শুরু করল অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে। সমস্যার সমাধান তো হলই না, উপরন্তু নতুন সমস্যা দেখা দিল। যেসব রোগ-পোকা তেমন প্রবলভাবে দেখা যেত না, সেগুলি প্রবলভাবে ফিরে এল। আবার অনেক রোগ-পোকা আগের মতো ওষুধ প্রয়োগে তেমন নিয়ন্ত্রিত হল না।
খাদ্যের মধ্যে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গরুর দুধ, পুকুরের মাছে কীটনাশকের উপস্থিতি আজ বাস্তব সত্য। পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। মৌমাছি প্রভৃতি উপকারী কীটপতঙ্গ, ব্যাঙ, কেঁচো, মাছ, পাখি, সাপ প্রভৃতি কীটনাশকের প্রভাবে বিপন্ন হতে শুরু করল। এভাবে চললে বেশি দিন আমাদের অস্তিত্ব বজায় থাকবে তো?
শুরু হল নতুন চিন্তাভাবনা। নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে সব কিছু দেখার আয়োজন শুরু হল। মাথায় চুল থাকলে যেমন উঁকুন আসবে, তেমন ফসলের ক্ষেতে রোগ-পোকা লাগবেই। রোগ পোকা লাগলেই যে ফসল শেষ হয়ে যাবে, তা ঠিক নয়। বরং রোগ-পোকা লাগলে, তা প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বনের ঘাস, গাছপালা খেয়ে হরিণ ও অন্যান্য জন্তুরা বাঁচে এবং হরিণ ও অন্যান্য জন্তুদের খেয়ে বাঘ বাঁচে। কিন্তু কোনদিন কি শোনা গেছে বনের সমস্ত জন্তু ও হরিণকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে। তা হয় না। প্রকৃতিতে একটা ভারসাম্য প্রাকৃতিকভাবেই ঠিক করা আছে। তেমনভাবে ফসলের ক্ষতিকারক পোকাকে খেয়ে ফেলার জন্য ক্ষেতে অন্য পোকা আছে। যেহেতু তারা ফসলের ক্ষতি করে না, তাই তাদের দিকে নজর পড়ে না। ফসলের ক্ষতিকারক পোকাকে খেয়ে ফেলে যে পোকা, তাদেরকে আমরা বন্ধু পোকা বলি। বিচক্ষণতার সঙ্গে কীটনাশক প্রয়োগ না করলে এই বন্ধু পোকাগুলি আগে মারা যায়। কাজেই নিয়মিত মাঠ পরিদর্শনের মাধ্যমে বন্ধুপোকা ও শত্রুপোকা চেনা-জানা ও প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নেওয়া এখন শস্য সুরক্ষার প্রধান অঙ্গ।
পৃথিবীতে প্রায় ন’লক্ষ প্রজাতির পোকার মধ্যে মাত্র দশহাজার পোকা ফসলে আক্রমণ করে অর্থাৎ “নিরামিশাষী” শত্রুপোকা। আবার প্রকৃতিতে বহু পোকা রয়েছে যারা মাংশাসী- অর্থাৎ ফসল না খেয়ে অন্য পোকা বা ডিম খেয়ে করে জীবন ধারন করে, যেমন মাকড়সা। এরাই হল বন্ধু বা মিত্র পোকা। জঙ্গলে যেমন তৃণভোজী হরিণ ইত্যাদি খেয়ে বাঘ, সিংহ জীবনধারন করে, ফসলের কীটপতঙ্গেরও একটা খাদ্যশৃঙ্খল আছে। শত্রু ও মিত্রপোকার খাদ্য- খাদক সম্পর্ক। যে অঞ্চলে ঐভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় আছে সেখানে কৃষিবিষের প্রয়োজন ছাড়াই প্রাকৃতিক নিয়মে ফসল উৎপাদন হবে।
পাশাপাশি, নগরায়ণের সাথে সাথে কৃষিজমি কমছে। ক্রমহ্রসমান কৃষি জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য যোগাতে পরিকল্পনামাফিক চাষবাস করা একান্ত প্রয়োজন। মাটির স্বাস্থ্য বজায় রেখে পরিবেশ বান্ধব হতে গেলে চিরায়ত কৃষির প্রয়োজন। সুসংহত উপায়ে ফসলের রোগ-পোকা-আগাছা নিয়ন্ত্রণ সেই চিরায়ত তথা টেকসই কৃষির একটি প্রধান অঙ্গ। এজন্য সুসংহত উপায়ে ফসলের শত্রু নিয়ন্ত্রণ (Integrated Pest Management – IPM) এখন এত জরুরি।
আই. পি. এম. কি?
আই পি এম হল এমন এক পদ্ধতি যার সাহায্যে ফসলের শত্রু রোগা-পোকা-আগাছা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের সকল প্রকার ব্যবস্থার সার্বিক ও সার্থক সমন্বয় ঘটিয়ে ক্ষতিকারক রোগ, পোকা ও অন্যান্য শস্য শত্রুর সংখ্যা ও পরিমাণ ফসলের অর্থনৈতিক ক্ষতিকর সীমা (ETL)-র নীচে রাখা হয়। ফসল চাষ করলে রোগ-পোকা আসবে কিন্তু তাদের সংখ্যা বা পরিমাণ একটা সীমার বেশি বাড়তে না দিলে ফলনে কোনো প্রভাব পড়ে না।
সুসংহত রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ এর প্রধান প্রধান ক্ষেত্র তথা ধাপগুলি হলো-
(১) পরিচর্যামূলক নিয়ন্ত্রণ
(২) যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ
(৩) জৈবিক নিয়ন্ত্রণ
(৪) রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
(১) পরিচর্ষামূলক নিয়ন্ত্রণঃ
ফসলের রোগ-পোকা-আগাছা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল পরিচর্যাগত নিয়ন্ত্রণ। এর ফলে ফসলে রোগ, পোকা ও অন্যান্য শত্রুর আক্রমণ হয় না বা খুব কম হয়, যাতে ক্ষতির পরিমান অর্থনৈতিক চরম সীমার নীচে থাকে। এজন্য চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কতকগুলি কৃষি প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়া প্রয়োগের উপর জোর দেওয়া হয়। এগুলি হল-
ক) এলাকার উপযোগী, রোগ-পোকা সহনশীল ও উচ্চফলনশীল জাতের সংশিত বীজ ব্যবহার করা।
খ) একই ফসল বারবার চাষ না করা বা শস্য পর্যায়ের প্রচলিত ধরণ পরিবর্তন করা।
গ) ফসল কাটার পর চাষ, গ্রীষ্মকালীন চাষ, আল ছাঁটা এবং ফসলের গোড়া ও অবশিষ্টাংশ নষ্ট করা।
ঘ) বীজ শোধন করে লাগানো ও বীজতলায় চারা অবশ্যই শোধন করা। প্রয়োজনে চারার শিকড় শোধন করা।
ঙ) জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার দেওয়া।
চ) প্রয়োজন হলে অণুখাদ্য সার স্প্রে করা।
ছ) সঠিক সময়ে, সঠিক বয়সে, সঠিক মাত্রায়, দূরত্বে ও সারিতে সুস্থ ও সবল চারা বা বীজ লাগানো।
জ) সঠিক সময়ে সেচ প্রয়োগ, প্রয়োজনের বেশী জল না দেওয়া।
ঝ) জমি ও আল সর্বদা আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার রাখা।
ঞ) সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন জমিতে নেমে কোনাকুনি ভাবে গিয়ে গাছ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা। রোগ-পোকা বা বন্ধুপোকা কতগুলো আছে এবং কি কি ক্ষতি কতটা পরিমানে করছে তা দেখা। সেইমত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ট) প্রয়োজনে ফাঁদ ফসল বা সাথী ফসল ব্যবহার করা।
(২) যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ:
ক) হাত দিয়ে ডিমের বা পোকার গাদা গাছ থেকে তুলে ফেলা বা আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট করা।
খ) সন্ধ্যাবেলা যৌথভাবে আলোক ফাঁদ বা আগুন জ্বালিয়ে পোকা ধরা বা পুড়িয়ে মারা।
গ) ফসল ও পোকার মধ্যে জাল বা অন্য কিছু দিয়ে ব্যবধান সৃষ্টি করা।
ঘ) ইঁদুর বা লেদা পোকার আক্রমণ হ’লে জমিতে পাখি বসার দাঁড় হিসাবে গাছের ডাল বা বাঁশ পোতা।
৬) শস্য দানার আর্দ্রতা রোদে শুকিয়ে সুপারিশকৃত মাত্রায় নামিয়ে এনে গোলাজাত করা।
চ) ধানক্ষেতে কেরোসিনের তেলে ভেজা দড়ি টেনে পোকা মারা এবং বাদামী শোষক পোকার আক্রমণ হলে ‘পাশঠ্যালা’ দেওয়া।
(৩) জৈবিক নিয়ন্ত্রণ:
প্রকৃতিতে বেশ কিছু কীটপতঙ্গ বা প্রাণী আছে যারা আমাদের ফসলের ক্ষতিকারক শত্রু পোকাদের (শাকাহারি) আক্রমণ করে তাদের সরাসরি মেরে ফেলে (পরভোজী) বা তাদের দেহ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে মেরে ফেলে (পরজীবি)। এরা সকলেই মাংসাশী পোকা, এদেরই আমরা বন্ধু পোকা বলি। ফসলের বিভিন্ন বন্ধু জীব হল পরভোজী পোকা, পরজীবি পোকা ও বিভিন্ন মিত্র জীবাণু। এরাই নিঃশব্দে আমাদের ফসলকে শত্রু পোকার হাত থেকে রক্ষা করে চলেছে। প্রকৃতিতে যেমন শত্রুপোকা আছে তেমনই বন্ধুপোকাও আছে। অথচ আমরা অযথা আশংকার ভিত্তিতে নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করে এইসব বন্ধুপোকাদের ধ্বংস করে ফেলি। ফলে, খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে গিয়ে শত্রুপোকার আক্রমণ বেড়ে যায়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। সেইজন্য বন্ধুপোকার সংরক্ষণ প্রয়োজন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত নয়। এমন কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত যা বন্ধুপোকার ক্ষতি করে না বা কম ক্ষতি করে। সেইজন্য জৈব কীটনাশক যেমন নিমজাত (অ্যাজাডাইরেকটিন) বা জীবাণুজাত কীটনাশক (বি.টি., এন.পি.ভি., বিউভেরিয়া ইত্যাদি), জৈব ছত্রাকনাশক (ট্রাইকোডারমা, সিউডোমোনাস) বা ‘সবুজ’ শ্রেণীভুক্ত কীটনাশক ব্যবহার করলে ক্ষতি কম হয়। এছাড়াও বিভিন্ন পাখি, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি আমাদের উপকার করে। জমিতে যথেষ্ট সংখ্যায় বন্ধুপোকা থাকলে শত্রুপোকারা বেশী বাড়তে পারে না। অনিষ্টকারী পোকা ও মিত্রপোকার মধ্যে একটা প্রাকৃতিক ভারসাম্য আছে। বিচার বিবেচনাহীনভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করা উচিত নয়। এপর্যন্ত প্রায় ৪৩০ ধরণের পোকার, ১০০টি প্রজাতির ছত্রাক ও ৩৬টি প্রজাতির আগাছার প্রতিরোধশক্তি জন্মেছে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ কিছু কৃষিবিষের প্রতি। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানী বাজারে বিক্রির জন্য নানা জৈব রোগ পোকা নাশক নিয়ে এসেছে এবং সুলভেই পাওয়া যাচ্ছে ও ব্যবহার হচ্ছে।
বন্ধুপোকাদের দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-পরভোজী ও পরজীবী। পরভোজী পোকা শত্রু পোকা ধরে ধরে খায এবং কীড়াকে খেয়ে বড় হয়। ফলে, শত্রুপোকার কীড়া বা ডিম নষ্ট
হয়ে যায় ও বন্ধুপোকা পুর্নতাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া, ক্ষেতে কিছু ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জাতীয় রোগজীবাণু দেখা যায় যারা শত্রুপোকার মধ্যে সংক্রমিত হয়ে তাদের মৃত্যুর কারণ হয় ও চাষীর বন্ধুর মতো কাজ করে। এই সব রোগজীবাণুর বংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে তরল বা পাউডার আকারে জমিতে প্রয়োগ করে শত্রুপোকা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
কয়েকটি পরভোজী বন্ধু পোকার পরিচিতি-
১) মাকড়সা-নেকড়ে, লিংকস, লাফানো, ছোট, রঙ্গীন, চারচোয়ালযুক্ত ইত্যাদি নানারকম মাকড়সা শ্যামাপোকা, শোষকপোকা, মাজরাপোকা, ঘাসফড়িং, পাতামোড়া পোকা ইত্যাদি ধরে খায়।
২) গ্রাউণ্ড বিটল-চকচকে, রঙ্গীন, শক্তপীঠ পোকাগুলি ধানগাছের নীচের দিকে থাকে এবং পাতামোড়া পোকা, বাদামী শোষক পোকা, শীষকাটা ল্যাদাপোকা, শ্যামাপোকা ইত্যাদি ধরে খায়।
৩) ড্যামজেল ফ্লাই-রোগা-পাতলা ঝিঁ ঝিঁ জাতীয় পোকাগুলি পাতামোড়া পোকা, শ্যামা পোকা, বাদামী শোষকপোকা ইত্যাদি ধরে খায়।
৪) লম্বাশুড় ঘাসফড়িং-সবুজ ও ঈষৎ হলুদাভ রঙের ঘাসফড়িংগুলির শুঁড় দেহের চেয়ে অধিক লম্বা হয়। রাতে বেশীরভাগ শিকার ধরে খায়। মাজরা ও গন্ধীপোকার ডিম এবং বাদামী শোষকপোকা, শ্যামাপোকা ইত্যাদি ধরে খায়।
৫) উরচুঙ্গা-বিভিন্ন পোকার ডিম ধরে খায়। এছাড়া মাজরা, পাতামোড়া, শীষকাটা, ল্যাদা ও বাদামী শোষকপোকার বাচ্ছা ধরে খায়।
৬) ওয়াটার বাগ-বিভিন্ন আকার ও আকৃতির জলের পোকাগুলি পাতামোড়া, চুঙ্গী, ল্যাদা, বাদামীশোষক, শ্যামা ইত্যাদি পোকা ধরে খায়।
৭) মিরিড বাগ-মাজরা, বাদামীশোষক, শ্যামাপোকা ধরে খায়।
কয়েকটি পরজীবী বন্ধু পোকার পরিচিতি-
১) বোলতা-বিভিন্ন আকার, আকৃতি ও রং এর বোলতা বিভিন্ন শত্রু পোকার ডিম ও কীড়ার উপর ডিম পাড়ে এবং সেখানেই জীবনচক্র প্রায় শেষ করে পূর্ণাঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসে। ফলে, শত্রু পোকার কীড়া ও ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
২) মাছি-বিভিন্ন ধরনের মাছি মাজরা, শ্যামা ইত্যাদি পোকা ধরে খায় ও তাদের ডিম বা ল্যাদার উপর ডিম পাড়ে। ওই ডিম থেকে জীবনচক্র সম্পূর্ণ করার সময় শত্রু পোকার কীড়া ও ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
এছাড়াও বাজারে প্রাপ্ত ইনসেক্ট গ্রোথ রেগুলেটর (IGR) ও ফেরোমোন ফাঁদ, আঠালো ফাঁদ ইত্যাদির সাহায্যেও বিভিন্ন কীট শত্রু নিয়ন্ত্রণ করা যায় অথচ পরিবেশে দূষণ ঘটে না।
(৪) রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃ
এটা হল শস্যরক্ষার শেষ অস্ত্র, অন্য ব্যবস্থা গুলির পরিপুরক ব্যবস্থা। প্রয়োজন ছাড়া যেন কখনোই রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা না হয় এবং করতে হলেও তা যেন পরিবেশের পক্ষে কম ক্ষতিকর হয়। ফসলে শত্রুপোকা ও বন্ধুপোকার অনুপাত এবং ফসলের ক্ষতির অর্থনৈতিক সীমা (ই টি এল) ছাড়াও ফসলের ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিচার করে তবেই রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করা উচিৎ। এর জন্য সপ্তাহে অন্তত একদিন জমিতে নেমে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। একই বিষ বারবার ব্যবহার করা যাবে না। এতে পোকার ঐ কৃষি বিষের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। সিন্থেটিক পাইরিথ্রয়েড জাতীয় কীটনাশক বারবার ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন শোষক পোকার ক্ষেত্রে দ্রুত পুনরুত্থান বা রিসার্জেন্স হয়। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সঠিক কৃষি বিষ সঠিক উপায়ে প্রয়োগ করা উচিত। সবজির ক্ষেত্রে কম বিপদজনক, সীমিত ক্ষমতা যুক্ত বিষ যেমন নীল ও সবুজ রং এর শ্রেণীভুক্ত বিষ এবং জৈব ও জীবাণু ঘটিত বিষ ব্যবহার করা উচিত।
ধানে বিভিন্ন রোগ-পোকা আক্রমনের অর্থনৈতিক চরমসীমা (ETL)-
১) ভেঁপু পোকা- প্রতি বর্গমিটার জমিতে যদি গড়ে ১টি পেঁয়াজকলি রোয়ার ২০ দিনের মধ্যে বা ৫ শতাংশ পেঁয়াজকলি যদি পাশকাঠি ছাড়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে দেখা যায় তবে রাসায়নিক কীটনাশক যেমন, ফোরেট ১০জি বা কার্বোফুরান ৩জি বা মনোক্রটোফস ৩৬ শতাংশ বা মিথাইল প্যারাথিয়ন ৫০ শতাংশ প্রয়োগ করতে হবে।
২) মাজরা পোকা-প্রতি বর্গমিটারে ১টি মথ বা ১টি ডিমের গাদা বা ৫ শতাংশ শীষের মধ্যে সাদাশীষ দেখা গেলে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। ভেঁপু পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য উল্লেখিত যে কোন একটি কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৩) পামরী বা শাঁকি বা লক্ষ্মীপোকা রোয়ার ৪০ দিনের মধ্যে যদি গড়ে প্রতি গুছিতে ১টা করে পূর্ণাঙ্গ পোকা বা ২টি সদ্য আক্রান্ত পাতা দেখা যায় এবং পরবর্তী সময়ে যদি ২টি পোকা বা ২টি সদ্য আক্রান্ত পাতা দেখা যায় তবে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। মিথাইল প্যারাথিয়ন ৫০ শতাংশ বা ক্লোরপাইরিফস ২০ শতাংশ বা ডাইক্লোরভস ৭৬ শতাংশ স্প্রে করা যেতে পাবে।
৪) পাতা মোড়া ও চুঙ্গী পোকা গড়ে প্রতি ঝাড়ে বা গুছিতে ১টি বা ২টি সদ্য আক্রান্ত পাতা বা চুঙ্গী পোকা দেখা গেলে পামরী পোকা নিয়ন্ত্রনের জন্য সুপারিশকৃত যেকোন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
৫) বাদামী শোষক পোকা- পাশকাঠি ছাড়ার মাঝামাঝি পর্যায় থেকে শীয়ে দানা পুষ্ট হওয়ার সময় পর্যন্ত নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং যদি প্রথম দিকে প্রতি গুছিতে ১০টি পোকা এবং পরের দিকে ১৫-২০টি পোকা থাকে এবং প্রতি ৫টি গুছির মধ্যে ১টিতে পোকা দেখা যায় তবে এন্ডোসালফান ৪ শতাংশ গুঁড়ো বা কুইনলফস ১.৫ শতাংশ গুঁড়ো বা কারবারিল ৪ শতাংশ গুঁড়ো এমনভাবে ছড়াতে হবে যাতে ধানগাছের গোড়ার দিকে ওষুধ পৌঁছায়। ক্ষেতের পরিধি থেকে কেন্দ্রের দিকে ঔষধ প্রয়োগ করতে করতে অগ্রসর হতে হবে।
৬) শ্যামা পোকা-জমিতে যদি টুংরো রোগ দেখা দেয় তবে গড়ে প্রতি ঝাড়ে ২টি করে শ্যামা পোকা দেখা গেলে এবং অন্যক্ষেত্রে ২০টি বা তার বেশী পোকা দেখা গেলে মনোক্রটোফস ৩৬ শতাংশ জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
৭) গন্ধী পোকা-ধানে ফুল আসার বা দুধ আসার সময় যদি প্রতি ৫টি গুছিতে ১টি পোকা দেখা যায় তবে রাসায়নিক কীটনাশক যেমন, ম্যালাথিয়ন ৫০ শতাংশ বা ডাইক্লোরভস ৭৬ শতাংশ স্প্রে করতে হবে বা গুঁড়ো কীটনাশক ছড়াতে হবে।
৮) শীষকাটা ল্যাদাপোকা-প্রতি গুছিতে গড়ে ১টি ল্যাদাপোকার কীড়া দেখা গেলে বিকালের দিকে নিমতেল জাতীয় কীটনাশক বা উপযুক্ত এন.পি.ভি. জাতীয় জৈব কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ঝলসা রোগ-পাতার ৫ শতাংশ অংশে আক্রমন দেখা দিলে বা ১-২ শতাংশ শীষের গোড়া আক্রান্ত হলে এডিফেনফস ৫০ শতাংশ বা ট্রায়েমফস ৫০ শতাংশ বা কারবেনডাজিম ৫০ শতাংশ জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
১০) খোলা ধ্বসা রোগ-ক্ষেতের বিভিন্ন জায়গাতে ১০টি করে গুছি পরীক্ষা করে যদি প্রতি জায়গায় গড়ে ১টি গুছিতে রোগ হতে দেখা যায় তবে ঝলসা রোগের জন্য সুপারিশকৃত ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।
১১) বাদামী বা চিটে রোগ-শতকরা ৫টি বা তার বেশী পাশকাঠি চিটে রোগে আক্রান্ত হলে ম্যানকোজেব ৪৫ শতাংশ বা কারবেনডাজিম ৫০ শতাংশ জাতীয় ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
১২) টুংরো রোগ-পাশকাঠি ছাড়ার সময় থেকে কাঁচথোড় আসার সময় পর্যন্ত প্রতি বর্গমিটারে ১টি টুংরো আক্রান্ত গুছি দেখা গেলে কার্বোফুরান ৩জি বা মনোক্রটোফস ৩৬ শতাংশ জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ধানের ক্ষেতে শত্রুপোকা ও বন্ধুপোকার অনুপাত ২:১ বা তার বেশী হলে অর্থনৈতিক চরমসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা (ক্ষতির পরিমাণ) থাকে। সেক্ষেত্রে রাসায়নিক রোগ- পোকা নাশক প্রয়োগের কথা ভাবতে হবে। কমপক্ষে প্রতি ৭দিনে একদিন ক্ষেতে নামতে হবে ও সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে রোগ-পোকার আক্রমন কতটা হয়েছে। এরপর প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ:
উপরোক্ত পন্থাগুলির সার্থক রূপায়ণের জন্য আমাদের পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এর মাধ্যমেই আমরা ফসলের ক্ষতির সঠিক হিসাব বা পূর্বাভাস পেতে পারি। আমরা জানি, অর্থনৈতিক ক্ষতিকারক সীমা হচ্ছে ওষুধ প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। তা নির্ধারণের জন্য জমি পরিদর্শন এবং পোকা ও রোগের পর্যবেক্ষণ একান্তই প্রয়োজন।
সঠিক এবং নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোন মরশুমে কোন ফসলের পোকা বা রোগ কত ক্ষতি করছে বা করতে পারে এবং তার জন্য উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলির মধ্যে কি কি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী, সে সম্বন্ধে সঠিক ধারণা দেওয়া যেতে পারে। পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের মূল্যায়ন করা হয় কৃষি বাস্তুতন্ত্র পর্যালোচনার মাধ্যমে।
কৃষি বাস্তুতন্ত্র পর্যালোচনা (Agro Eco-System Analysis – AESA)
তারিখ.. সময়. ……… ফসল ও জাত
১) আকাশের অবস্থা,
৫) ক্ষেতে জল কতটা..
২) বৃষ্টিপাত………..
৬) গাছের সংখ্যা (প্রতি বর্গ মিটারে)…..
৩) আপেক্ষিক আর্দ্রতা……….
৭) ফসলের বয়স কত..
৪) সার ব্যবহার
৮) বিশেষ কোন অবস্থা………..
সুসংহত উপায়ে ফসলের রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণের কয়েকটি সাধারণ উপায়ঃ
ফসলের পেস্ট বা ক্ষতিকারক জীব গুলিকে মূলতঃ তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১) কীটশত্রু
২) রোগ
৩) আগাছা
১) কীটশত্রু: এগুলিকে আবার ছয় টি দলে ভাগ করা যেতে পারে। ফসলের ডগা ও পাতা খাওয়া পোকা, রস শোষক পোকা, নালী পোকা, ফলের মাছি, মাকড় ও নিমাটোড।
২) রোগঃ মূলত চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ছত্রাকজনিত রোগ, ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ, ভাইরাস জনিত রোগ ও অণুখাদ্যের অভাবজনিত রোগ লক্ষণ।
৩) আগাছাঃ প্রধানতঃ চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়-ঘাস জাতীয় আগাছা, চওড়াপাতা আগাছা, মুথাজাতীয় এবং শ্যাওলা ও অন্যান্য আগাছা।
১. ফসলের কীটশত্রু।
ফসল চিবানো, কাটা ও ছিদ্রকারী পোকা:
১) স্পোডোপ্টেরা বা তামাকের কীড়া-ডগা ও পাতা খেকো ল্যাদা পোকা।
২) হেলিকোভার্পা বা ছোলার শুঁটি ছিদ্রকারী পোকা, টমেটো, তুলো ইত্যাদির ফল ছিদ্রকারী পোকা।
৩) লিউসিনযেল্স বা বেগুনের ফল ও ডাঁটা ছিদ্রকারী পোকা।
৪) প্লুটেলা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ।
৫) এপিল্যাক্সা বা বাঘা পোকা।
৬) রেড পামকিন বিটল বা লাল কুমড়োর পোকা।
৭) এগ্রোটিস বা কাটুই পোকা।
৮) স্পাইলোসোমা বা শুঁয়োপোকা।
৯) সেমিলুপার বা ঘোড়া পোকা।
১০) মাজরা পোকা।
১১) ফ্রি-বিট্ল।
১২) পাতা জড়ানো পোকা।
১৩) পাতা মোড়া পোকা।
১৪) উই।
১৫) পিঁপড়ে।