এক. ভারতচন্দ্র
১. সাধারণ আলোচনা
অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ও উল্লেখযোগ্য কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। মঙ্গলকাব্যধারার তিনিই সর্বশেষ কবি। মঙ্গলকাব্যের প্রথানুবর্তনে তিনি কাব্য রচনায় ব্রতী ভূমিকা হলেও অনাগত আধুনিককালের বাণীবৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে। ভারতচন্দ্রের কাব্য ভাবগত আদর্শে আধুনিকযুগ লক্ষণাক্রান্ত। প্রাচীন ও নতুনের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে নতুনের দিকেই গতি নির্দেশ করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর যুগধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতচন্দ্রের কবিমানসটি গড়ে উঠেছে। অষ্টাদশ
শতাব্দীর শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রজীবনে নানা পালাবদল চলতে থাকে। মুরশিদকুলি সমসাময়িক সমাজ খাঁর পর যাঁরা বাংলার মসনদে বসেছেন তাঁরা সবাই বিলাসব্যসন ও উচ্ছৃঙ্খলতায় মত্তবিভোর হয়ে উঠেছেন। সেই সুযোগে-জমিদার, আমির- ওমরাহ ও দেশিবিদেশি বণিকের দল দেশের মধ্যে প্রভুত্ব বিস্তার করতে থাকে। নবাব আলিবর্দীর সময়ে (১৭৪০) বর্গীরা বার বার দেশ লুণ্ঠন করে নির্মম অত্যাচারে সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করে। বর্গির হাঙ্গামার ফলে বাংলার কৃষিজীবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ঘরে ঘরে হা-অন্ন হা-অন্ন রব। পর্তুগিজ জলদস্যুদের উপদ্রবে তখন বাংলার বাণিজ্যের অবস্থা শোচনীয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম। করভারে প্রপীড়িত সাধারণ মানুষ। লঘু অপরাধে ও বিনা অপরাধে ষড়যন্ত্রীদের কলাকৌশলে অসহায় দরিদ্র ব্যক্তিরা গুরুদণ্ড ভোগ করছে। বিচারের নামে প্রহসন চলেছে। বাংলাদেশের সর্বত্র তখন নিদারুণ আর্থিক সংকট-জনসাধারণের দুঃখ-দুর্গতির অবধি নেই। মানুষের নিঃস্ব শোচনীয় অবস্থার কথা একটি ছড়ায় ধরা পড়েছে- ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো। বর্গী এলো দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/খাজনা দেব কিসে।’ অর্থনৈতিক দুর্দশা দেশের সর্বত্র। তখন মানুষ বিদেশি বণিকের কাছে সমর্থ পুরুষ, সুন্দর শিশু ও সুন্দরী নারীদের বিক্রি করছে।
এই নিদারুণ অবস্থায় মুরশিদাবাদের নবাবি রাজতন্ত্রের বিলাসকলার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে নগরজীবনে। কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা তখন বিলাসব্যসনে টলটলায়মান। সমাজের অভিজাতশ্রেণির লোকেরা নবাবি বিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। ছলাকলাময় হাস্য- পরিহাস, বিকৃত রুচির কৌতুক ও ভাঁড়ামি, নৃত্যগীতাদি প্রভৃতিতে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা উচ্চকিত। একদিকে সমাজের নিম্নতলে দরিদ্র মানুষের এক মুষ্টি অন্নের জন্য হাহাকার, অন্যদিকে ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য খোসামুদি-মোসাহেবি, সুবিধাবাদ,
ভণ্ডামি ও স্তাবকতার অন্ত নেই। আর দেশে ধর্মচর্চা ও শিক্ষাদীক্ষা বলতে কিছু নেই। উচ্চবর্ণের সমাজে তখন ঘুণ ধরে গেছে। রুচিবিকৃতি তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে-পরস্পর খিস্তি খেউড় হাসি ঠাট্টা তামাশাকে সবাই আভিজাত্য মনে করছে। দেশব্যাপী এরূপ ভণ্ডামি বিলাসব্যভিচার-কলুষিত অবক্ষয়ী সমাজের মধ্যে ভারতচন্দ্রের আবির্ভাব।
কৃষ্ণচন্দ্রের রাজপ্রাসাদে সম্বর্ধিত ভারতচন্দ্র ছিলেন মহারাজের আনন্দবাজারের অন্যতম হোতা। রাজসভায় অনুগৃহীত কবি হয়ে সভাসদদের মনোরঞ্জন না করে তাঁর উপায় ছিল না। উপসংহার, যুগধর্ম ও ভারতচন্দ্র কিন্তু ভারতচন্দ্র ছিলেন আত্মসচেতন কবি। তাই কৌতুকের আড়ালে নিজের অন্তরাত্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। সেই যুগের বেদনাকে, নিদারুণ শিথিলতাপূর্ণ ক্লেদপিচ্ছিল সমাজজীবনের মানিকে সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবিদ্রুপের কশাঘাতে জর্জরিত করে মুক্ত জীবনের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
২. ভারতচন্দ্রের জীবনী
আত্মপরিচয়
১৭০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হুগলি জেলার অন্তর্গত ভুরশূট পরগনায় পেঁড়ো গ্রামে এক ব্রাহ্মণকুলের জমিদারবংশে কবির জন্ম। পিতার নাম নরেন্দ্র রায়। ভারতচন্দ্রের জীবন বাল্যকাল থেকেই দুঃখময়। পিতার সম্পত্তি বর্ধমান রাজার চক্রান্তে বেদখল হয়ে যায়। তারপর কবি মাতুলালয়ে লালিতপালিত হন। বাড়ির কারও মতামত না নিয়ে পছন্দমতো এক কন্যাকে বিয়ে করে সকলের বিরাগভাজন হন। বিনাদোষে বর্ধমানরাজ কর্তৃক কারারুদ্ধ হন। সেখান থেকে পালিয়ে যান কটকে। তারপর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। নানা ভাগ্যবিপর্যয়ের পর তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি নিযুক্ত হন। মহারাজ প্রদত্ত মূলাজোড় গ্রামে তিনি বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে বসবাস করে কাব্য রচনার অবসর পান। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের ঠিক তিন বছর পরে বহুমূত্র রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। পশর সঙ্গতিচীক
ভারতচন্দ্র নানা বিদ্যায় পণ্ডিত ছিলেন। কোন্ কোন্ বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা ছিল তা কবি সংক্ষেপে জানিয়েছেন- ‘ব্যাকরণ, অভিধান, সাহিত্য, নাটক। অলঙ্কার, সঙ্গীত শাস্ত্রের অধ্যাপক। পুরাণ আগমবেত্তা, নাগরী, পারসী।।’
কিশোর বয়সেই ভারতচন্দ্রের কবিশক্তির স্ফূরণ ঘটে। পনেরো বছর বয়সে দেবানন্দপুরের
বিবিধ কাব্য
মুনসিবাড়িতে নিজে সত্যনারায়ণের পাঁচালি রচনা করে পাঠ করেন। রচনাশক্তির নৈপুণ্যের। সাফল্যে শ্রোতা মুগ্ধ হন। সে যা হোক, ভারতচন্দ্র ‘সত্যপীরের পাঁচালি’, ‘রসমঞ্জুরী’, ‘বিবিধ কবিতাবলী’, ‘নাগাষ্টক’ ও ‘চণ্ডী নাটক’ প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। কিন্তু তাঁর কবিপ্রতিভার স্বকীয়তা ও শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটেছে ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে (১৭৫২-৫২)।
৩. ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল
‘অন্নদামঙ্গল’ ভারতচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ রচনা। এটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তিনটি কাব্য। প্রথম আলিবর্দী কর্তৃক কৃষ্মচন্দ্রকে কারাগারে বন্দি এবং দেবী অন্নপূর্ণা কর্তৃক উদ্ধারের কাহিনি। অন্নদামঙ্গল এরপর সংস্কৃত ‘কাশীখণ্ড’ ও ‘শিবপুরাণ’ অবলম্বনে সতীর দেহত্যাগ ও তাঁর পুনর্জন্মের কাহিনি বিবৃত। তারপর স্থান পেয়েছে ব্যাসদেব কর্তৃক দ্বিতীয় কাশী নির্মাণের ইতিবৃত্ত ও হড়িহোড়ের কাহিনি।
দ্বিতীয় খন্ডের নাম ‘কালিকামঙ্গাল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর কাব্য’। আদিরসাত্মক কাব্য এটি। রাজকুমারী বিদ্যার সঙ্গে রাজকুমার সুন্দরের গোপন প্রণয়, বিদ্যার পিতা কর্তৃক সুন্দরের প্রাণদণ্ড। দেবী কালিকার কৃপায় সুন্দরের প্রাণরক্ষা ও বিদ্যাসুন্দরের বিবাহ এর উপজীব্য। এই গ্রন্থে আদি রসের প্রাচুর্য আছে। ‘অন্নদামঙ্গলে’র শেষ অংশ ‘মানসিংহ’ বা ‘অন্নদামঙ্গল’। রচনা হিসাবে এটি নিকৃষ্ট। দেবী অন্নদার ভক্ত ভবানন্দ মজুমদারের সহায়তায় ও দেবীর কৃপায় মানসিংহের হাতে প্রতাপাদিত্যের পরাজয় ও পথিমধ্যে তাঁর মৃত্যু। দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গির কর্তৃক হিন্দু দেবদেবীর নিন্দায় দেবীর অনুচর ভূতপ্রেত প্রমথগণের দ্বারা দিল্লিনগরী তছনছ ও বিপদগ্রন্ত সম্রাটের অন্নদার পুজো প্রভৃতি অনেক ইতিহাস বিবৃত ও অবিশ্বাস্য অতিরঞ্জিত কাহিনি স্থান পেয়েছে।
ভারতচন্দ্রকে যুগসন্ধির কবি নামে অভিহিত করা হয়। মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের বিশেষ কাঠামো অনুসরণ করে তিনি কাব্যরচনা করলেও তাঁর ভাবধারা সম্পূর্ণ নতুন। দেবলীলার
কাব্য-বৈশিষ্ট্য
পটভূমিকায় কবি মানুষের কাহিনিই মুখ্যত বিবৃত করেছেন। তাঁর কাব্যে দেবচরিত্রের মহিমা অপেক্ষা মনুষ্যচরিত্রই অধিকতর সজীব ও প্রাণবন্ত
হয়ে উঠেছে। দীর্ঘকালের মঙ্গলকাব্যের একঘেয়েমির মধ্যে ভারতচন্দ্র নতুনত্ব এনে তাকে আস্বাদ্য করে তুলেছেন। যুগ-সচেতন কবি ভারতচন্দ্র পুরাতনকে নামমাত্র গ্রহণ করে নতুনত্বের উদ্বোধন ঘটিয়েছেন। অন্নদামঙ্গল কাব্যে পুরাতন ও নতুন যুগ পরস্পর মুখ দেখাদেখি করেছে। তিনি পুরাতন পাত্রে নতুন রস পরিবেশন করেছেন। অন্নদামঙ্গল নতুন রীতির মঙ্গলকাব্য-মানুষের মঙ্গলচেতনায় তাঁর কাব্যসাধনা- ‘নূতন মঙ্গল আসে ভারত সরস ভাসে/রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আজ্ঞায়।’ এই নতুন মঙ্গলকাব্যে দেবদেবীরা স্বর্গলোক ও স্বর্গের মহিমা পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের নরনারীতে পরিণত হয়েছে। শিব, অন্নপূর্ণা ও ব্যাসদেব-এদের চরিত্রে পৌরাণিক ঐতিহ্য রক্ষিত হয়নি। শিব ও অন্নপূর্ণা ওই যুগের মানবিক রূপ ধারণ করেছে। বৃদ্ধ বর শিবকে দেখে মেনকার বিলাপ ও তার শ্লথ চরিত্র নিয়ে গৌরীর ঠাট্টা প্রভৃতি সহজেই প্রমাণ করে দেবদেবীর চরিত্রে স্বর্গধামের অলৌকিক মহিমা নেই। ভারতচন্দ্রের কবিমানসিকতা বিচার করে ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, মানবশিশুরা শিবকে ঘিরে যে কোলাহল ও রঙ্গরসিকতা শুরু করেছে-‘কেহ বলে জটা হৈতে বার কর জল,/কেহ বলে জ্বাল দেখি কপালে অনল। কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া। ধুলামাটি গায়ে তার দেয় ফেলাইয়া।”
দেবতার গায়ে এই যে ধুলামাটি নিক্ষেপ-এখান থেকেই বাংলা কাব্যে আধুনিকতার শুরু। ভারতচন্দ্র স্বর্গের তথা কৈলাসের দেবদেবীর সংসার বর্ণনায় স্বামী, স্ত্রী ও পুত্রদের একেবারে মাটির ঘরের দরিদ্র মানুষ রূপে চিত্রিত করেছেন।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র ঈশ্বরী পাটনি। তাঁর কণ্ঠে শোনা গেল বাঙালির চিরন্তন প্রাণের কথা-‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’ দেবী অন্নদার কাছে গ্রাম্য অশিক্ষিত খেয়াপারের মাঝি ঈশ্বরী ধনদৌলত বা মুক্তি আকাঙ্ক্ষা করেনি। সন্তানের জন্য স্বাবলম্বন শক্তি প্রার্থনা করেছেন। বাৎসল্যরসের রসিক সমগ্র বাঙালি জাতির মর্মোদ্ঘাটন করেছেন ভারতচন্দ্র এই চরিত্রে। কুলবধূর ছদ্মবেশে দেবী অন্নদা খেয়াপারাপারের মাঝি ঈশ্বরীর নৌকায় ভবানন্দ
মজুমদারের বাড়ি যান। দেবীর পাদস্পর্শে তার কাঠের সেঁউতি সোনা হয়ে যায়। সেটিকে পাটনি হেলাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। কুলবধূকে অঘটন ঘটন পটিয়সী দেবী জেনেও ঈশ্বরী দেবীর কাছে শুধু প্রার্থনা করেছেন তার সন্তানরা যেন দুমুঠো খেতে পায়। মানুষের প্রাণের ভালোবাসার দাবি সে প্রার্থনা করেছে। দেবতার কাছে মানুষের এটি বড়ো চাওয়া যে তার সন্তান, পরিজন যেন সুখে আনন্দে থাকে-তাদের জীবনের আলো যেন নিভে না যায়। ভারতচন্দ্রের কাব্যে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বড়ো বড়ো মানুষের আনাগোনা। কিন্তু এই ঈশ্বরী পল্লিপ্রাণ দরিদ্র, সরল খাঁটি বাঙালি সন্তান। ঈশ্বরী পাটনি ইতিহাসের সরণি থেকে আসেনি। তার পথ বাংলা নদীর তীরবর্তী পায়ে চলার পথ। কবি মোহিতলাল মজুমদারের মতে ঈশ্বরী পাটনি চরিত্রটি স্বল্পে সন্তুষ্ট স্বাবলম্বী ও সচ্ছল চিরন্তন বাঙালি জাতির প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্র।
ভারতচন্দ্রের কাব্যে রয়েছে তীক্ষ্ণ ও উজ্জ্বল কৌতুকপ্রিয়তা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি। মধ্যযুগের পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার অন্তঃসারশূন্যতা সামাজিক জড়ত্ব ও মিথ্যার প্রতি ভারতচন্দ্রের বক্রোক্তি ব্যঙ্গ বিদ্রুপের আঘাত অন্নদামঙ্গলে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সমস্ত কাব্য জুড়ে রঙ্গব্যঙ্গ ও কৌতুকের ছটায় অষ্টাদশ শতকের শূন্যতাবোধ ও শেষ অঙ্কের ঘণ্টাধ্বনি তাঁর কাব্যে বেজে উঠেছে। প্রমথ চৌধুরী তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেছেন যে ভারতচন্দ্রের হাসি বীরের হাসি। বাস্তবিকই ভারতচন্দ্রের হাসির কাছে শতাব্দীব্যাপী দেবতার ভণ্ডামি, ঔদ্ধত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা কোথায় উড়ে গেছে।
ভারতচন্দ্র স্বচ্ছ এবং অলংকৃত ও প্রবচনবহুল বাগুঙ্গির সুষম প্রয়োগে কবি মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন অন্নদামঙ্গলে। অনুপ্রাস, যমক, উপমা, শ্লেষ, রূপক ব্যজস্তুতি ও উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলংকারের সার্থক প্রয়োগে, ভুজঙ্গপ্রয়াত, তোটক ও তোণক প্রভৃতি ছন্দের ব্যবহারনৈপুণ্যে এবং শ্লেষকৌতুকপূর্ণ, তির্যক দৃষ্টিভঙ্গির পরিস্ফুটনে, বর্ণনার পরিপাট্যে, বৈচিত্র্য ও মাধুর্যে অন্নদামঙ্গল অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই মন্তব্য করেছেন-“রাজসভার কবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো যেমন তাঁহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।” ভারতচন্দ্রের পূর্বে বাংলা কাব্যে ছন্দবৈচিত্র্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ভারতচন্দ্র ছন্দনির্বাচনে অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি প্রণিধানযোগ্য “ভারতচন্দ্রই প্রথম ছন্দকে সৌষম্যের নিয়মে বেঁধেছিলেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃত ও পারসিক ভাষায় পণ্ডিত। ভাষাবিন্যাসে ছন্দে প্রাদেশিকতার শৈথিল্য তিনি মানতে পারেন নি।” ভারতচন্দ্র নতুন নতুন ছন্দের প্রবর্তন করে বাংলা কাব্যের বৈচিত্র্য ও গতিশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সতীর দেহত্যাগের সংবাদে বিচলিত শিবের বিষাদবিক্ষুব্ধ চিত্তের সম্যক অভিব্যক্তিতে তিনি সংস্কৃত ভুজঙ্গপ্রয়াত ছন্দের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন- “মহারূদ্ররূপে মহাদেব সাজে। ভভন্তম্ ভভন্তম্ শিঙ্গা ঘোর বাজে। লটাপট জুটাজুট সংঘট্ট গঙ্গা। ছলচ্ছল টলটল কলক্কল তরঙ্গা।।”
ভূতপ্রেতগণ দক্ষযজ্ঞনাশে মেতে উঠেছে। তাঁদের উন্মত্ত কোলাহল কবি তোণক ছন্দের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন- “ভূতনাথ ভূতসাথ দক্ষযজ্ঞ নাশিছে। যক্ষরক্ষ লক্ষলক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে।। প্রেতভাগ সানুরাগ ঝম্প ঝম্প ঝাঁপিছে। ঘোর রোল গণ্ডগোল চৌদ্দ লোক কাঁপিছে।।”
শুধু ছন্দ নয়, অলংকার ও প্রবচন প্রয়োগে ভারতচন্দ্রের কৃতিত্ব সমধিক। শ্লেষ অলংকার প্রয়োগের অপূর্ব নিদর্শন মেলে তাঁর কাব্যে- ‘অতি বড়ো বৃদ্ধ সিদ্ধিতে নিপুণ/কোন গুণ নাহি তার কপালে আগুন।। কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ। কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।
অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্রের প্রযুক্ত ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’, ‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’ ও ‘নীচ যদি উচ্চভাষে সুবুদ্ধি উড়ায়ে হাসে’ প্রভৃতি প্রবচনগুলি বাঙালি জীবনের শাশ্বত কথাকলিতে পরিণত হয়েছে। এককথায় পয়ার ত্রিপদীর বাঁধধরা শিল্পরীতির মধ্যে ভারতচন্দ্র অপূর্ব বাণীবিন্যাস ও মণ্ডনকলায় নতুন শক্তি ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে বুচিবিকৃতি আছে। অশ্লীলতার অভিযোগও অনেকে আনেন। বস্তুত ভারতচন্দ্র সজ্ঞানে কিছু করেননি। রাজসভার ঝাড়লণ্ঠন বাতির আলোর তলায় বসে তাঁর কাব্যসাধনা। সুতরাং রাজদরবারের দোষগুণ তাঁর কাব্যে প্রতিফলিত হবেই। অবক্ষয়ী সমাজের জীবনচিত্রের তিনি শিল্পী। এর জন্য দায়ী সেই যুগ। কুরুচি ও অশ্লীলতা ভারতচন্দ্রের ব্যক্তিগত ত্রুটি নয়, যুগগত ত্রুটি। ভারতচন্দ্রের নিরাসক্ত দৃষ্টিতে যুগজীবনের চিত্র উদ্ঘাটিত। তবে ভারতচন্দ্রের কাব্যে জীবনদৃষ্টির গভীরতা নেই। তিনি জীবনের বহিঃরঙ্গের কবি। কৌতুক, রঙ্গব্যঙ্গ, হাসি ঠাট্টা তামাশা তাঁর প্রধান সম্পদ। রাজসভায় কবি হিসাবে মৌলিক সৃষ্টি অপেক্ষা রচনাকৌশলের দিকেই তাঁর দৃষ্টি ছিল বেশি। রাজদরবারের বৈশিষ্ট্য-ছলাকলা, চাতুর্য ও রূপসজ্জার পরিপাট্যে তাঁর রচনা সমৃদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করতেন-যে হোক, সে হোক ভাষা কাব্যরস লয়ে। তৎসম, দেশি ও ফরাসি ভাষার মার্জিত প্রয়োগে তিনি নিজস্ব ভাষাভঙ্গি বা স্টাইলের জগৎ তৈরি করে গেছেন। তীক্ষ্ণতা, তির্যকতা, কৌতুকরস, রঙ্গব্যঙ্গের উতরোল উল্লাস, অসঙ্গতির চমকপ্রদ উজ্জ্বলতা ও অসাধারণ বাগ্বৈদধ্যে এবং সর্বোপরি কাহিনিগ্রন্থন, চরিত্র সৃষ্টি ও পৌরাণিক লৌকিক ভাবরূপরসের সংমিশ্রণে ও আত্মগত ভাবনার লিরিক মূর্ছনায় তিনি আশ্চর্য মৌলিক সৃষ্টিশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। কবি হিসাবে ভারতচন্দ্রের প্রধান গৌরব ও কৃতিত্ব এই যে তিনি তাঁর কাল থেকে অনেকটা এগিয়ে আছেন। আধুনিকতার বাণী-যুক্তি, বুদ্ধি ও মানবতার আদর্শ হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো তাঁর কাব্যে দীপ্তি বিকীর্ণ রয়েছে।
অনুশীলনী
১। ভারতচন্দ্রের আবির্ভাবকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পটভূমি কেমন ছিল? কবির কাব্যে এই যুগ পটভূমির কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায় কী?
২। ভারতচন্দ্র কোন্ রাজসভার কবি ছিলেন? সংক্ষেপে কবি জীবনকথার উল্লেখ করে তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৯২) ১+৫+৯=১৫
৩। ভারতচন্দ্র কার সভাকবি ছিলেন? ভারতচন্দ্রে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটির নাম ও রচনাকাল উল্লেখ করো। তাঁর কাব্য ও কবিপ্রতিভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৯৫)১+২+৫+৬
৪। ভারতচন্দ্র কার সভাকবি ছিলেন? ভারতচন্দ্রের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটির নাম ও রচনাকাল উল্লেখ করো। তাঁর কাব্য ও কবিপ্রতিভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৯৬)
৫। ভারতচন্দ্রের কাব্যের নাম কী? তাঁকে কী উপাধি দেওয়া হয়েছিল? কোন্ শতকে তাঁর কাব্যটি রচিত হয়? কবির জীবন কাব্যপ্রতিভার পরিচয় দাও।
(উ.মা. ১৯৯৯)