এক. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
১. ভূমিকা: রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি
বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদাবলিতে রাধাকৃষ্ণের প্রণয় কাহিনি রয়েছে। রাধা ও কৃয়ের প্রেমকাহিনি নিয়ে রচিত কৃয়লীলা বিষয়ক কাব্য বাঙালির এক বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সম্পদ।
কৃষ্ণলীলার কাহিনি আমরা ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণে পাই। হালের ‘গাথা সপ্তশতী’ গ্রন্থে আমরা রাধার উল্লেখ দেখি। মোট কথা পুরাণের কৃষ্ণচরিত্র লোকজীবনের রসে সিক্ত হয়ে ধীরে ধীরে প্রাকৃত জীবন রসধারার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থের অমর প্রবাহ ও শৃঙ্গার প্রবাহ পর্যায়ে আমরা রাধাকৃয় প্রেমলীলার কলাচাতুরীর সঙ্গে পরিচিত হই। রাধাকৃষ্ণের প্রণয় সম্পর্ক সমকালীন সমাজচেতনায় লঘু রসের বিহ্বলতায় নতুন তাৎপর্য লাভ করে। তখন বাংলায় লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকাল, রাজা ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক কবিগোষ্ঠী সবাই বিলাসব্যসনে মগ্ন ও কামকলাচর্চায় আসক্ত ছিলেন।
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যটির মূল প্রেরণা ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থটি। ‘গীতগোবিন্দে’ বিলাসকলাকুতূহল ও হরিকথাসরসতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। গ্রন্থটি সংস্কৃতে লেখা। কিন্তু বাগুঙ্গি বাংলা ভাষার কাছাকাছি। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বিদ্যাপতির পদাবলিতে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কাহিনি প্রাকৃত জীবনরসেই পরিপূর্ণ-যদিও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। এই দুই কবির রচনায় শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পূর্বে রাধাকৃষ্ণের যে কাব্যিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে বৈয়ব কবিদের পথনির্মাতা তাঁরাই। চৈতন্যোত্তর যুগের কবিরা কমবেশি পূর্বসূরিদের দ্বারা প্রভাবিত।
২. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: পুথিবিচার
চর্যাগীতি পদাবলির পর দীর্ঘ আড়াইশো বছরকাল বাংলা সাহিত্যের নিষ্ফলা যুগ। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ স্বাধীন বাংলার পত্তন করলে সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে
ভূমিকা আসে। তখন দেশের মানুষ ভাঙাচোরা ছিন্নমূল জীবনের ওপর আবার নতুন করে ঘর বাঁধতে শুরু করল। সেই তুর্কি আক্রমণোত্তর বিধ্বস্ত জীবনের কাহিনি অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। চর্যাগীতি পদাবলি বাংলা ভাষার আদিমতম নিদর্শন হলেও তার মধ্যে অপভ্রংশের প্রভাব বর্তমান। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের
মতে, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকয়কীর্তনে বাংলাভাষার বিশিষ্ট বাক্রীতি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
চর্যাগীতির পর বাংলা ভাষার যে বিবর্তন ঘটেছে দীর্ঘকাল তার সুস্পষ্ট পরিচয় রয়েছে এই কাব্যে। জয়দেবের পরবর্তী রাধাকৃয় বিষয়ক প্রণয়কাহিনির বাংলা কাব্যকর্তা বড়ু চণ্ডীদাস। শ্রীকৃয়কীর্তনে আধ্যাত্মিক আদর্শ অপেক্ষা নরনারীর জৈবিক তৃয়া, কামনা বাসনার লালসাবৃত্তি ‘প্রাধান্য পেলেও মানবিক আবেদনের দিক থেকে এই কাব্যটি বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতার মূল্য বহন করছে। নীপাড়া দারূণাপাচ ফলিত এ
১৯১৬ সালে শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বৎবল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিলা গ্রাম থেকে এই গ্রন্থের পুথিটি আবিষ্কার করেন। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পুথি আবিষ্কার তাঁরই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পুথিটি প্রকাশিত হয়। পুথিটির প্রথম, মধ্য ও শেষের দিকের কয়েকটি পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি। ফলে কাব্যের নাম ও কবি-পরিচিত অজ্ঞাত থেকে গেছে। বিষয়বস্তু কৃয়লীলা বলেই আবিষ্কারক নাম দেন ‘শ্রীকৃয়কীর্তন’। কিন্তু পুথির মধ্যে ১০৮৯ বাংলা সনে লেখা একটা কবি পরিচয় চিরকুট পাওয়া গেছে। তাতে এই কাব্যকে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব’ (অর্থাৎ ‘শ্রীকৃয় সন্দর্ভ’) বলা হয়েছে। এ নিয়ে পণ্ডিতমহলে মতানৈক্য রয়েছে। অনেকের মতে চিরকুটের লিখনটি শ্রীজীব গোস্বামীর ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ হতে পারে। যা হোক, আবিষ্কারকের
দেওয়া ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামই বহুল প্রচারিত ও সর্বাধিক পরিচিত।
বড়ু চণ্ডীদাস ভণিতায় নিজেকে বাসুলীদেবীর পূজারি বলে পরিচয় দিয়েছেন।
‘বাসলীচরণ শিরে বন্দিআ/গাইল বড়ু চণ্ডীদাস।।’
এছাড়া, চন্ডীদাস, অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস-এর উল্লেখ গ্রন্থমধ্যে পাওয়া যায়। বোধহয় ছন্দের মাত্রাসমতা রক্ষার জন্যই এরূপ ঘটেছে।
বাঁকুড়া জেলার ছাতনা গ্রামে কবির বাসস্থান ছিল। কাব্যে বিভিন্ন রাগরাগিণী ও সংস্কৃত শ্লোকের দৃষ্টান্ত ও পৌরাণিক কাহিনির প্রেক্ষাপট থেকে একথা নিশ্চিত বলা চলে যে কবি বিদগ্ধ সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন।
লিপি বিচারক পণ্ডিতরা চতুর্দশ ও ষোড়শ শতকে এটি রচিত বলে অভিমত দিয়েছেন।
বিষয়বস্তুর দিক থেকে গ্রন্থটিকে চৈতন্যপূর্ব যুগের রচনা বলে নিঃসন্দেহে ধরা যায়। চৈতন্যপ্রভাবিত বৈয়বভাবাদর্শ ও রাধাকৃয়ের প্রণয়লীলা থেকে এ কাব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন
রচনাকাল প্রকৃতির। শ্রীকৃয়কীর্তনের রচনার কাল ও তারিখ না জানা গেলেও গ্রন্থটি শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের (১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ) পূর্ববর্তী কোনো সময়ের রচনা।
৩. কাহিনি সংক্ষেপ
শ্রীকৃয়কীর্তন কাব্য রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কাহিনি নিয়ে রচিত, সর্বমোট তেরোটি খন্ডে বিন্যস্ত। শেষ অংশের নাম ‘রাধাবিরহ’। শেষের অংশটি খণ্ডনামাত্মক নয় বলে অনেকে একে প্রক্ষিপ্ত মনে করেন। বিষয়বস্তু ও ভাষা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ‘রাধাবিরহ’ মূল গ্রন্থের স্বভাব সংগতি বিচ্যুত নয়।
জন্মখণ্ডে কৃয়জন্মের ভাগবতী ঘটনা সন্নিবেশিত। কংসের অত্যাচার থেকে ধরিত্রীর দুঃখমোচন ও মানুষের মুক্তির জন্য ভগবান নারায়ণের কৃয়রূপে দেবকীর গর্ভে জন্ম। আর কৃষ্ণের সহচরীরূপে মর্ত্যলীলার জন্য রাধারূপে জন্মগ্রহণ করলেন বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীদেবী। নপুংসক আইহনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল। এই পৌরাণিক কাহিনি দিয়ে গ্রন্থের আরম্ভ হলেও জন্মখণ্ডে লৌকিক জীবনের প্রাধান্য বেশি। তাম্বুলখণ্ডে যৌবনবতী রাধার রূপলাবণ্যে শ্রীকৃয় বিমুগ্ধ, আত্মহারা। রাধাকে দেখাশোনার জন্য আইহন রাধার মায়ের পিসি বড়াইকে নিযুক্ত করে। তারই মাধ্যমে কৃয় পান-সন্দেশ উপহার দিয়ে রাধার কাছে প্রণয় নিবেদন করলে রাধা দারুণ ক্রোধে বড়াইকে ভর্ৎসনা করে। কৃয় তখন নতুন ফন্দি আঁটে। রাধা মথুরার হাটে দধি বিক্রি করে। হাটের কর দিতে না পারায় কৃয় তার দেহ ও যৌবন দাবি করেন। সেই সময় বড়াই এসে কৃষ্ণের সপক্ষে ওকালতি করলে অনেক তর্কবিতর্ক বাদবিতণ্ডার পর নিরূপায় রাধা বাধ্য হয়ে শ্রীকৃষ্ণের নিকট নিজেকে সমর্পণ করেন। এই হল দানখণ্ডের বিষয়বস্তু। নৌকাখন্ডে রাধাকে ধরার জন্য কৃয় খেয়াঘাটে মাঝি সেজে খেয়াতরিতে মাঝনদীতে ভয় দেখিয়ে রাধার সঙ্গে জল-বিহারে মিলিত হন। এখন থেকে রাধা কিছুটা কৃষ্ণমুখী। ভারখণ্ডে মিলন সম্পর্কে তর্কবিতর্ক। এইখানে এই খণ্ডের সমাপ্তি। পুথি খণ্ডিত বলে আর কিছু নেই। এরপর ছত্রখণ্ডে মথুরার পথে রৌদ্রের উত্তাপ থেকে রাধাকে রক্ষা করার জন্য কৃয় মিলনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে তার মাথায় ছাতা ধরেছেন। পুথি খণ্ডিত বলে এই খণ্ডের আর পরের ব্যাপার জানা যায়নি। বৃন্দাবন খণ্ডে কৃষ্ণ রাধার মধুকুঞ্জে মিলিত হন। এই খণ্ডে ভাগবতের রাসলীলার প্রভাব পড়েছে। বস্ত্রহরণ খণ্ডে রাধা ও সখীরা বস্ত্র রেখে যমুনায় স্নান করতে নামে। কৃষ্ণ রাধার বস্তু এবং অন্যান্য সখীর বস্ত্র হরণ করে কদম্ব গাছে ওঠে। রাধার কাকুতিমিনতিতে কৃষ্ণ বস্ত্র দেয়। কালীয়দমন খণ্ডে কালীদহে কালীয় নাগ দমন-কৃষ্ণের জলকেলি ও গোপীদের বস্ত্রহরণ কাহিনি বর্ণিত। হারখণ্ডে কৃষ্ণ রাধার হার চুরি করেন। রাধার কাছে এই বৃত্তান্ত শুনে মা যশোদা এই কুকীর্তির জন্য পুত্রকে তিরস্কার করেন। বাণখণ্ডে কৃয় রাধার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে মদন বাণে রাধাকে মূর্জিত করেন। বড়াইর তিরস্কারে কৃয় রাধাকে বাঁচিয়ে তোলেন। বংশীখণ্ডে কৃষ্ণের বাঁশির মধুর সুর রাধার প্রাণমন কেড়ে নেয়। কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনি রাধা পথে বেরিয়ে পড়েন। কৃয় দূরে সরে যান। বড়াইর নির্দেশে রাধা নিদ্রিত কৃষ্ণের বাঁশী চুরি করেন। অনেক বাদানুবাদের পর রাধা কৃষ্ণর বাঁশি ফিরিয়ে দেন। সর্বশেষে ‘রাধাবিরহ’। বৃন্দাবনে মিলনের পর কৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে মথুরায় চলে যান। রাধা জেগে কৃষ্ণ অদর্শনে হাহাকার করে ওঠেন। রাধার অনুরোধে বড়াই মথুরায় কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পায়। রাধার অনন্ত বিরহ যন্ত্রণার কথা শুনেও কৃয় ফিরে এলেন না বৃন্দাবনে। এখানেই কাহিনি বিচ্ছিন্ন। আর বাকি অংশ পাওয়া যায়নি। কাহিনির অসমাপ্ত অবস্থায় কাব্যটির সমাপ্তি ঘটেছে।
৪. কাহিনি বিচার
রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা শ্রীকৃয়কীর্তনের উপজীব্য। সুপন্ডিত বড়ু চণ্ডীদাস কাব্যের কাঠামো নির্মাণে গীতগোবিন্দ, বিয়পুরাণ ও ভাগবতাদির কাহিনির কিছু কিছু অংশ অনুসরণ করেছেন। পৌরাণিক আদর্শ ও লৌকিক জীবনরসের সংমিশ্রণে এই কাব্য বৈশিষ্ট্যদ্যোতক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে
আধ্যাত্মিক মহিমা নেই-স্থূল অমার্জিত গ্রাম্য রুচির উৎকট প্রকাশ ঘটেছে। তবে গ্রন্থটি কৃয়কথা প্রচারের একটি ঐতিহাসিক স্তরকে সুচিহ্নিত করে রেখেছে। বাংলা ভাষায় রচিত রাধাকৃয় বিষয়ক প্রথম কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এটাই মধ্যযুগের আদি রচনা। এর রচয়িতা বস্তু চন্ডীদাস মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি কবি। তিনি জীবনরসিক কবি। কল্পনায় কিছু লৌকিক রং লেগেছে এবং রঙ্গলীলার প্রভাব পড়েছে। স্থূলতা বা গ্রাম্যতা অনেকটা রয়েছে এই প্রেমকাহিনির মধ্যে-তার জন্য সমকালীন সমাজজীবনই দায়ী। তুর্কি আক্রমণোত্তর নীতিভ্রষ্ট ভোগকামনাতুর উচ্ছল উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কাহিনি এতে রূপায়িত। তবে কবি সমস্ত নৈতিক সংস্কারের ঊর্ধ্বে যে মুক্ত জীবনদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন-তা আধুনিক জীবনচেতনার সগোত্র।
৫. চরিত্র বিচার
রাধা: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গ্রন্থটি কাহিনিমূলক কাব্য। রাধা, কৃয় ও বড়াই-এই তিনটি চরিত্রের উক্তিপ্রত্যুক্তি বা সংলাপের মাধ্যমে কাব্যটি গড়ে উঠেছে। এই তিনটি চরিত্র নিজ নিজ ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রত্যেকটি চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য এখানে সুস্পষ্ট। চরিত্রগুলির অন্তর্দ্বন্দ্বের
রাধা তীব্রতা, সংঘাত, বৈচিত্র্য ও উত্থানপতন বাস্তবানুগ ও নাট্যধর্মগুণান্বিত। বিশেষ করে রাধা চরিত্রের ক্রমবিবর্তন ও তার পরিণতিতে বড়ু চণ্ডীদাস প্রথম শ্রেণির শিল্পীপ্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
রাধা চরিত্রটি খুবই মানবিক ও জীবন্ত। সে অপরূপ লাবণ্যময়ী। কিন্তু ভাগ্যদোষে নপুংসক আইহনের স্ত্রী। এর জন্য তার অন্তরের বেদনা স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজ-সংস্কারের রীতিনীতিকে সে মেনে নিয়েছে। কুলবধূ হিসাবেই সে দুধ, দধি বিক্রি করতে মথুরার হাটে যায়। শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে এই নারী ক্রমেই প্রেমময়ী হয়ে উঠে। শ্রীকৃয় প্রেম নিবেদন করে কুলবধূ রাধা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। অনেক রাগ বিরাগের পরে দুজনের মিলন ঘটে। এভাবে আত্মস্বাতন্ত্র্যময়ী রাধার ক্রমবিবর্তন ও বিকাশ ঘটে।
দপ্তর
কংসবধের জন্য কৃয় তাঁকে বন্দাবনে ছেড়ে মথুরায় চলে গেলে অসীম বিরহবেদনায় রাধার যে আর্তি ফুটে উঠল তার মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাস সকল নিয়ম-সংস্কার বিধি-বিধানের ঊর্ধ্বে মুক্ত ও শাশ্বত প্রেমকে জয়যুক্ত করেছেন।
শ্রীকৃয়কীর্তন কাব্যের নায়ক শ্রীকৃয়। কিন্তু কৃষ্ণের মধ্যে চারিত্রিক সমুন্নতি ও নায়কোচিত ঔদার্যের অভাব। কৃষ্ণের প্রতি কবি যথোচিত উদারতা প্রদর্শন করেননি। সেজন্যই শ্রীকৃয় পূর্ণাঙ্গ চরিত্র হিসাবে গড়ে ওঠেনি। সে বিচ্ছিন্ন কতকগুলি চিত্রের নায়ক
শ্রীকৃয়
হিসেবে কাব্যে উপস্থিত হয়েছে। শ্রীকৃয়কে নিতান্ত ভোগলোলুপ কামজর্জর কুটিল চরিত্রের গ্রাম্য লম্পট ব্যক্তি হিসাবেই গণ্য করা চলে। তবে কাব্যের শেষের দিকে কৃষ্ণচরিত্র কিছুটা মহত্ত্ব-ব্যঞ্জিত।
বড়াই কুট্টনী জাতীয় চরিত্র। সংস্কৃত সাহিত্যে নায়ক-নায়িকার মধ্যে মিলন সাধনের জন্য বড়াই দৌত্যকর্মে নিযুক্ত এরূপ চরিত্রের সাক্ষাৎ মেলে। বড়াই রাধার মায়ের পিসি। তার বয়স অনেক। নাকের মাঝখানটা বসা। গাল তোবড়ানো, গালের হাড় উঁচু, বিকট দাঁত, উটের ন্যায় ঠোঁট, কথাবার্তা কাপট্যপূর্ণ। বড়াইর চরিত্রের
বৈশিষ্ট্য হল- ‘বিকট দস্ত কপট বাণী।’ এই বড়াই রাধাকৃয় মিলনে দৌত্যগিরি করেছে। এর পিছনে তার কোনো স্বার্থচিন্তা ও কুমতলব ছিল না। কয় বৈকুণ্ঠের বিঘ্ন, আর রাধা স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী-এই সত্য জেনেই বড়াই সমাজ-নিষিদ্ধ প্রেমের ব্যাপারে সহায়তা করেছে। বড়াই স্নেহশীলা ও পরিহাসনিপুণা, আমাদের একান্ত পরিচিত গ্রাম্য মাতামহী রূপেই চিত্রিত। তাঁর কথাবার্তা, কাজকর্ম সমস্তই চরিত্রগত স্বভাবধর্মানুসারী। নারীর সুকোমল হৃদয়বৃত্তিকে তিনি বিসর্জন দেননি। বড়াইর জন্যই রাধা ও কৃশ্বের প্রেমের বিকাশ ও চরিত্র দুটির পরিপূর্ণতা ঘটেছে।
৬. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সামাজিকতা
বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃয়কীর্তন কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য। এই কাব্যের কথাবস্তুর সামান্যই পুরাণ থেকে গৃহীত। অধিকাংশ কাহিনি পুরাণ-বহির্ভূত। দেশে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণের কাহিনি এবং সমসাময়িক যুগের সমাজচিত্র কবির কল্পনা জাগ্রত করেছে বেশি।
দেশে তখন শ্রীরামচন্দ্রের পুজো প্রচলিত ছিল। শুভ কোনো কাজ আরম্ভ করার আগে তাঁর বন্দনা করা হত। মেয়েরা মনস্কামনা সিদ্ধির আশায় চণ্ডী দেবীর পুজো করত। বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। শুভকাজ আরম্ভ করার পূর্বে শুভ তিথি, বার, ক্ষণ বিচার করা হত। বারাণসীতে গিয়ে লোকেরা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করত। গলায় কলশি বেঁধে জলে ডুবে, আগুনে ঝাঁপ দিয়ে, বিষ খেয়ে কিংবা গলায় পাথর বেঁধে জলাশয়ে ডুবে আত্মহত্যার রীতি ছিল। সংসারে আসক্তিহীন নারী মাথা মুড়িয়ে যোগিনী সেজে নানা স্থানে ও তীর্থে ঘুরে বেড়াত। জন্মান্তর, কর্মফল ও অদৃষ্ট প্রভৃতিতে সে যুগের বাঙালির গভীর আস্থা ছিল। মন্ত্রেতন্ত্রে লোকের গভীর বিশ্বাস ছিল। যাত্রাকালে হাঁচি ও টিকটিকির শব্দ বিঘ্নাদির পূর্বসূচনা বলে ধরা হত। এছাড়া শূন্য কলশি কাঁখে নিয়ে মেয়েদের জল আনতে যাওয়া, দক্ষিণদিকে শৃগালের গমন, শুষ্কডালে উপবিষ্ট কাকের ডাক, নরকপাল নিয়ে যোগিনীর ভিক্ষা প্রার্থনা প্রভৃতি ছিল অশুভের সংকেতবাহী। নারীহত্যা করা সমাজে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত ছিল। নারীহত্যা এমনই পাপজনক যে ‘শতেক ব্রহ্মবধ নহে যার তুল’। নারীহন্তারককে কেউ ঘৃণায় স্পর্শ করত না। নারীহত্যাকারী ব্যক্তির সাতপুরুষ অধঃপতিত থাকবে-এরূপ লোকবিশ্বাস প্রচলিত ছিল। অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বধূরা বিবিধ অলংকার পরিধান করত। প্রসাধন ও পোশাক পরিচ্ছদ ছিল জৌলুসপূর্ণ। শ্রীকৃয়কীর্তনে সোনা, হিরা, মণিমাণিক্য, মুক্তা, গজমতি প্রভৃতির উল্লেখ এত বেশি যে লোকের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না হলে কবির পক্ষে এরূপ বর্ণনা সম্ভব হত না। সাধারণ বেচাকেনা, লেনদেন কড়ির দ্বারা নির্বাহ হত। হাটে পণ্যবিক্রয়কারীকে শুল্ক দিতে হত। যাতায়াতের জন্য বর্ষাকালে নদীতে নৌকা চলাচল করত। মাঝিকে পারাপারের জন্য শুল্ক দিতে হত। রাজার কাছে গিয়ে ঘাট ইজারা দেবার ব্যবস্থা ছিল। পথঘাট তেমন নিরাপদ ছিল না। দস্যুতস্করের উপদ্রব ছিল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শুদ্র ছাড়া বৈদ্য, বণিক, সাপুড়ে, নাপিত, কুন্তুকার, তেলি, মাঝি প্রভৃতি বৃত্তিধারী জাতির উল্লেখ রয়েছে। শ্রীকৃয়কীর্তনে এই সব বর্ণনা থেকে তৎকালীন সামাজিক অবস্থার মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়।
৭. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাব্যমূল্য
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাব্যটি রাধাকৃষ্ণের প্রণয় ব্যাপার নিয়ে বাংলা ভাষায় রচিত মধ্যযুগের প্রথম কাহিনিকাব্য। রাধা ও কৃয়ের ঐতিহ্য নিয়ে যে বিপুল বৈয়ব সাহিত্য গড়ে উঠেছে তারই পথিকৃৎ বড়ু চণ্ডীদাস। অবশ্য বড়ুর পূর্বে জয়দেব রাধাকৃয়লীলা বিষয়ক ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্য রচনা করেন সরল সংস্কৃত ভাষায়। সেই জয়দেবের কাহিনির অনুগত বাংলা কাব্য শ্রীকৃয়কীর্তন।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের উৎস পৌরাণিক ভাগবত। তবে সমকালীন লৌকিক জীবনধারা এই কাহিনিকে পরিপুষ্টি দান করেছে। পুরাণের একটি সংক্ষিপ্ত পরিকাঠামোর উপর বড়ু চণ্ডীদাস একটি বৃহৎ লৌকিক কাহিনি কাব্য রচনা করেছেন। পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে অনেক প্রচলিত লোককাহিনি এবং কবির নিজস্ব কল্পনা স্থান পেয়েছে। প্রত্যক্ষ প্রাকৃত জীবনচেতনা, মানবতাবাদ, চরিত্র ও চিত্রকল্প সৃষ্টি, কাহিনি গ্রন্থন ও নাটকীয় উপস্থাপনা, ছন্দ ও অলংকার সৃষ্টি এবং ভাষা প্রয়োগের নৈপুণ্যে এই গ্রন্থের কাব্যমূল্য অপরিসীম।
নিসর্গসৌন্দর্য, মিলন ও বিরহবেদনা তথা বিচিত্র অভিব্যক্তিতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চণ্ডীদাসের অসাধারণ কবিত্ব-শক্তির সুন্দর এক নিদর্শন। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে রাধা, কৃয় ও বড়াই-এই তিনটি চরিত্রের উক্তি ও প্রত্যুক্তির মাধ্যমে কাহিনির অগ্রগতি ঘটেছে এবং সংলাপ ও দ্বন্দ্বসংঘাতময় কাহিনি নাট্যিক শিল্পবৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের নিম্নোদ্ভূত অংশটি পড়লেই ড. দাশগুপ্তের অভিমত যথার্থ বলে মনে হবে।-
কাহারো বউ তু কাহারো রাণী/কেহ্নে যমুনাত তোলসী পানী। (কৃষ্ণের উক্তি)
” বড়ার বৌ মো বড়ার ঝি/আন্তে পানী তুলি তোহ্মাত কি।। (রাধার উক্তি)”
রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই-বহুস্থলে এই তিনটি চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তি বা পারস্পরিক সংলাপ বিনিময়ের মধ্যে উৎকৃষ্ট নাট্যধর্মের ব্যঞ্জনা মেলে। নাটকের প্রধান গুণ-বাস্তবধর্মিতা ও দ্বন্দ্বসংঘাত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নায়ক-নায়িকার দ্বন্দ্বকলহ, মন ও মেজাজের উত্তাপ- প্রথমে দৃঢ় অসম্মতি ও শেষে আত্মনিবেদনের ব্যাকুলতা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বড়ু চণ্ডীদাসের মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতার পরিচয় মেলে। সেই নাট্যরীতির সমালোচনা করে অনেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে ঝুমুর জাতীয় লৌকিক নাট্যরীতির প্রাচীনতম নিদর্শন বলেছেন। তাছাড়া নানা স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে গীতিকাব্যের ভাবোচ্ছাস কাব্যটিকে অসামান্য শিল্প- মর্যাদায় ভূষিত করেছে। বংশীখণ্ডে কৃষ্ণের বাঁশীর মধুর সুর শুনে রাধার যে আকুলি-বিকুলি অবস্থা-তার মধ্যে রাধার বিরহজনোচিত ভাবোচ্ছাস ও আত্মসমর্পণের আকুতি অনবদ্য সুষমা লাভ করেছে।
কেনা বাঁশী বাএ বড়াই কালিনী নঈ কূলে। কেনা বাঁশী বাএ বড়াই এ গোঠ গোকুলে।।’ আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন/বাঁশীর শবদে মো আউলাইল রান্ধন।।’
কেনা বাঁশী বাএ বড়াই সে না কোন জনা/দাসী হআঁ তার পদে নিশিবো আপনা।।’
আখ্যায়িকা গীতিকাব্য ও নাট্যরসের সংমিশ্রণে শ্রীকৃয়কীর্তন এক অভিনব কাহিনি-কাব্য। চরিত্রকার ও কাহিনিকার হিসাবে চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব প্রশংসার্হ। ধীরে ধীরে তিনি অনভিজ্ঞ ও মুখরা বালিকা রাধিকাকে একের পর এক ঘটনার সাহায্যে বিকশিত করে তুলেছেন।
শ্রীকৃয়কীর্তনে রাধিকা শেষ পর্যন্ত প্রেম-পরিশুদ্ধা ও প্রেমে সমর্পিতা নারী হিসাবে পাঠকের সামনে ধরা দিয়েছেন। বড়ু চণ্ডীদাস রাধাকে বংশীখণ্ড ও বিরহবিরহে কামনাবাসনার ঊর্ধ্বে এক সমুন্নত ভাবসুষমার জগতে পৌঁছে দিয়েছেন। বিরহ অংশে রাধার বিরহমথিত হৃদয়ের যে পরিচয় পাওয়া যায় সেখানে শ্রীকৃয়কীর্তনের রাধা ও বৈশ্বব পদাবলি সাহিত্যের চন্ডীদাসের রাধার সীমারেখার পার্থক্য একেবারে নেই বললে অন্যায় হবে না। প্রমথনাথ বিশীর মন্তব্য যথার্থ যে, শ্রীকৃয়কীর্তনের যেখানে শেষ, সেখান থেকেই বৈয়ব পদাবলীর রাধার যাত্রা শুরু।
শব্দ প্রয়োগে, ছন্দ সৃষ্টিতে ও অলংকার যোজনায় কবির অভিনবত্ব প্রশংসনীয়। বাংলা ভাষার স্বাভাবিক উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সুস্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নবজাত বাংলাভাষা বড়ু চণ্ডীদাসের লেখনীতে বেশ সাবলীল, স্বচ্ছন্দগতি ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিষয়বস্তু, কাহিনিগ্রন্থন, ভাষা, ছন্দ ও অলংকার প্রয়োগের দিক থেকে শ্রীকৃয়কীর্তন যথার্থ রসমূল্য ও শিল্পোৎকর্ষ লাভ করেছে।
দুই. বিদ্যাপতির পদাবলি
১. সাধারণ আলোচনা
বৈয়ব পদাবলি সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান কবি বিদ্যাপতি। বিদ্যাপতির জন্মস্থান মিথিলা। বাংলার মাটিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। বাংলা ভাষায় তিনি এক পঙ্ক্তিও লেখেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙালি তাঁর কবিপ্রতিভাকে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি জানিয়েছে। ভিন্ন ভূমিকা রাজ্যের ভিন্ন ভাষার কবিকে নিজের মাতৃভাষার কবি হিসাবে গ্রহণ করার যথেষ্ট কারণ আছে। শুধু বৈয়ব মহাজনেরা নয়, সাধারণ বাঙালি
পাঠকও তাঁকে আপন ঘরের প্রিয়তম মনের মানুষ হিসাবে বরণ করে নিয়েছে। বাঙালির হৃদয়রাজ্যে তিনি চিরন্তন প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর রাধাকৃয় বিষয়ক পদাবলি বাঙালির প্রাণের প্রিয় সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। স্বয়ং মহাপ্রভু বিদ্যাপতির পদাবলি আস্বাদন করে পরম আনন্দ লাভ করতেন:
চন্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।
স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রিদিনে
গান শুনে পরম আনন্দ।
প্রাচীনকালে বাংলাদেশের সঙ্গে মিথিলার নিবিড় সাংস্কৃতিক ঐক্য ছিল। বাংলার ভৌগোলিক সীমা তখন বহুদূর বিস্তৃত। বাংলা ও মিথিলা সংস্কৃত চর্চার প্রধান কেন্দ্র বা পীঠস্থান ছিল। দুই প্রদেশের ছাত্ররা দুই প্রদেশে যাতায়াত করত। এর ফলেই বাঙালি ও মিথিলাবাসীদের মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিদ্যাপতি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত মিথিলাবাসীর উপেক্ষার পাত্র ছিলেন। বাঙালি কর্তৃক বিদ্যাপতির পদাবলি সমাদৃত হলেই মিথিলাবাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় বিদ্যাপতির প্রতি।
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ ও ‘শ্রীকৃয়কীর্তন’ কাব্যে বাঙালি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার প্রথম রসানন্দ উপভোগ করে। বিদ্যাপতির পদে প্রেমের অর্থাৎ মধুর রসের বিচিত্র অভিব্যক্তি ঘটায় বৈয়ব ধর্মের যে আদর্শ ‘কান্তাপ্রেম’- তারই পরিচয় পেয়ে রসিক বাঙালি বিদ্যাপতিকে বরণ করে নেয়। বৈয়ব পদ সংকলন গ্রন্থে তাঁর বহুপদকে স্থান দিয়ে বাঙালি মিথিলায় বিস্মৃতপ্রায় বিদ্যাপতিকে সগৌরবে কালজয়ী রাজসিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশে বিদ্যাপতি ও তাঁর পদাবলির নবজন্ম ঘটেছে। মিথিলা বিদ্যাপতির জন্মভূমি হলেও তাঁর চিরন্তন লীলানিকেতন কাব্যরসিক বাঙালির হৃদয়রাজ্য। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন যথার্থই উত্তি করেছেন- ‘বাঙালি বিদ্যাপতির পাগড়ী খুলিয়া লইয়া ধুতি চাদর পরাইয়া দিয়াছে।’ বস্তুতপক্ষে বাঙালি না হয়েও বিদ্যাপতি তাঁর কবিতায় ভাব ও ভাষার জন্য বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। চৈতনোত্তর বৈয়ব সমাজে তিনি মহাজনরূপে স্বীকৃত। বৈশ্বব সাহিত্যের একটি মুখ্য শিল্পধারা হল বিদ্যাপতি প্রদর্শিত সাহিত্য রীতি। তাই বিদ্যাপতি অন্য রাজ্যের ও অন্য ভাষার কবি হয়েও বাঙালি পদকার হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
চৈতন্যপূর্ব যুগে বিদ্যাপতি মিথিলার মধুবনি মহকুমার অন্তর্গত বিসফী গ্রামের এক সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পরিবারে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন।
বংশ-পরিচয়
পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত তিনি বর্তমান ছিলেন। পিতার নাম গণপতি ঠাকুর। ঠাকুর সম্ভবত কৌলিক উপাধি। পূর্বপুরুষের মতো
বিদ্যাপতিও বিচিত্রবিদ্যার অধিকারী ছিলেন। গীতগোবিন্দ, অমরুশতক, ঋতুসংহার, আর্যাসপ্তশতী, শৃংগারতিলক ও গাথা সপ্তশতী প্রভৃতি একাধিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত গ্রন্থের প্রভাব তাঁর রাধাকৃয় বিষয়ক পদাবলিতে লক্ষ করা যায়। রাজ্যশাসন সম্পর্কেও তাঁর প্রগাঢ় পান্ডিত্য ছিল। তিনি মিথিলার রাজসভায় কামেশ্বর রাজবংশের কীর্তিসিংহ থেকে দেবসিংহ, বীরসিংহ ও ভৈরবসিংহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। পাণ্ডিত্য ও কবিত্বে তিনি মিথিলাবাসীর প্রভৃত শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। পদাবলির ধ্বনিসৌন্দর্য, পদলালিত্য ও কাব্য মাধুর্যের জন্য তিনি ‘মৈথিল কোকিল’ নামে অভিহিত।
পদাবলি ছাড়াও বিদ্যাপতি কীর্তিলতা, কীর্তিপতাকা, দানবাক্যাবলি ও দুর্গা ভক্তিতরঙ্গিণী প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ক গ্রন্থ মৈথিলি ও অবহট্ট ভাষার রচনা করেন। কিন্তু বিচিত্রমুখী প্রতিভাধর বিদ্যাপতির প্রভাব বিদ্যাপতির মৌলিকতার স্বাক্ষর সুচিহ্নিত হয়ে আছে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলিতে। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলিতে জীবনানুভূতির স্বচ্ছন্দ প্রবাহ ও
প্রেমভাবনার বিচিত্র তরঙ্গ লীলায়িত হয়ে উঠেছে।
২. বিদ্যাপতির বৈয়ব পদাবলি
অলংকার শাস্ত্রে সুপণ্ডিত জীবনরসরসিক ছিলেন যৌবনের কবি, প্রেমের কবি। বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে মিলনবিরহ পর্যন্ত প্রণয়লীলায় রাধার চরিত্রচিত্রণে প্রগাঢ় জীবন-অভিজ্ঞতা, জীবনরসিক কবি নিপুণ মনস্তত্ত্বজ্ঞান ও অসামান্য শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় তিনি দিয়েছেন। রাধার দৈহিক রূপলাবণ্য, মাধুর্য ও প্রেমানুভূতির বিচিত্র দিককে তিনি শব্দ, ছন্দ, অলংকার ও চিত্রকল্পে ভাস্কর্যশিল্পের মর্যাদা দান করেছেন। বহুভাষাবিদ ও
বহুশাস্ত্রজ্ঞ সর্বোপরি সর্বভারতীয় কাব্য ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত কবি বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলার ইন্দ্রিয়জ দেহভাবনাকে মার্জিত ভাষাভঙ্গিতে, নিপুণ অলংকার প্রয়োগে, কল্পনার ব্যাপকতায় অপূর্বভাবে রসসৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। শব্দের ঝংকার ও সাবলীলতায়, ছন্দের ধ্বনি-সুষমায় ও অলংকারের দ্যুতিতে বিদ্যাপতি প্রথম শ্রেণির কবি। বিদ্যাপতি চৈতন্যপূর্বযুগের কবি। তাই স্বভাবতই তাঁর পদাবলিতে অপার্থিব প্রেমলীলার স্বর্গীয় দ্যুতি নেই। এই ধূলিমাটির সংসারের রক্তমাংসের নরনারীর প্রণয়-কথাই তাঁর কাব্যের প্রধান উপজীব্য বস্তু। তাই বিদ্যাপতির বেশির ভাগ পদে লৌকিক সংসারের প্রণয়াসক্ত নরনারীর মিলন-বিরহের আর্তি ফুটে উঠেছে। জীবনসমুদ্রের তটে বসে তিনি তরঙ্গলীলার সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করেছেন এবং সেই সৌন্দর্যে তিনি বিমুগ্ধ-বিভোর। তাঁর নায়িকা রাধার মধ্যে দেহজ কামনার আর্তি ও মিলন-বিরহের উচ্ছলতা ফুটে উঠেছে। বিদ্যাপতির রাধা বৃন্দাবনের রাধিকা নয়-আমাদের এই লৌকিক সংসারের ছলাকলাপূর্ণ এক রসরঙ্গময়ী যুবতি রমণী।
বয়ঃসন্ধি ও পূর্বরাগের পদে রাধা লীলাচপল ‘ভুবিন্যাসে অভিজ্ঞ’, যৌবনসুচতুর ও কলাবতী। কবি বিদ্যাপতি একজন শ্রেষ্ঠ মনোবিদের দৃষ্টিতে কৈশোর-যৌবন-সন্ধিগতা তন্বী রাধার নতুন ভাবসংকট মনোরহস্যের অপূর্ব শিল্পলোক সৃষ্টি করেছেন। কৈশোর গেল, যৌবন এল। রাধার চিত্ত দ্বন্দ্বে আলোড়িত। কখন রাধা কেশ বাঁধে, কখন
রাধার বিবর্তন
খুলে ফেলে। কী চায় সে নিজেই জানে না। ভাস্কর্য-শিল্পীর মতো বিদ্যাপতি
রাধার কৈশোর অবস্থা থেকে নবযৌবনবতীতে পরিণত হওয়ার লীলাবৈচিত্র্যের রূপমূর্তি
নির্মাণ করেছেন। বিদ্যাপতির রাধাপ্রেমের স্বরূপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন- বিদ্যাপতির রাধা অল্পে মুকুলিত বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। সৌন্দর্য ঢলঢল করিতেছে। আর সেজন্যই ছন্দ, সংগীত এবং বিচিত্র রঙে বিদ্যাপতির পদ পরিপূর্ণ।
রাধার দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে তার মানসিক পরিবর্তন- ভীতিবিহ্বল চাপল্য, যৌবনের উত্তাপ, কৈশোর যৌবনের দ্বন্দ্ব বিদ্যাপতির লেখনীতে বর্ণাঢ্য শিল্পসৌন্দর্য লাভ করেছে। বিদ্যাপতিকে সুখের কবি বলা হয়। কিন্তু সেই সুখও মিলন বিরহের এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। পূর্বরাগের পর অভিসার, অভিসারের পর মিলন। কত মধুযামিনী মিলনে কেটে যায়। কিন্তু সেই মিলনেও তৃপ্তি নেই- “কত মধুযামিনী রভসে গোঁয়াইলু/ন বুঝলু কৈছন কেল/লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু/তবু হিয়া জুড়ন না গেল।।”
এখানেই মিলনে আনন্দ পরিতৃপ্তির মধ্যে অপরিতৃপ্তির অপার্থিব ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। বিদ্যাপতি মিলনের বর্ণনায় উৎকৃষ্ট কাব্যকলার নিদর্শন রেখেছেন। মিলনের পর বিরহ। বিরহের পদ রচনায় বিদ্যাপতির দক্ষতা আরও গভীর। মিলনে
প্রেমের সব সংশয় ও সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। তখন রাধার অন্তর থেকে উচ্ছল আনন্দ বিরহ বেরিয়ে আসে-“সেই কোকিল অব/লাখ লাখ ডাকউ/লাখ উদয় করু চন্দা।” মিলনে রাধার যে আনন্দ চাঞ্চল্য-বিরহে তারই বাথা দ্বিগুণতর হয়ে ওঠে। না পাওয়ার থেকে পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা আরও ব্যাপক ও গভীর। কর্তব্যের আহ্বানে বৃর মথুরা চলে যান। বৃন্দাবনের মিলনকুঞ্জে নেমে আসে শূন্যতা। রাধার দুচোখ বেয়ে
অশ্রু ঝরতে থাকে। এই বিরহ বেদনা তীব্র ও নিখিল ব্যাপ্ত- “শূন ভেল মন্দির শুন ভেল নগরী। শুন ভেল দশদিশ শূন ভেল সগরী।।”
বিরহের তীব্রতা ও শূন্যতাবোধের হাহাকারে যন্ত্রণাদগ্ধ রাধার জ্যোতির্ময়ী মূর্তি ফুটে উঠেছে ‘মাথুর’ পদে। শ্রীকৃয় আজ দূরদেশে। রাধার হৃদয়- ‘পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা’। বিরহের রাধার তীব্র আর্তিকে বর্ষা প্রকৃতির সঙ্গে একাকার করে বিদ্যাপতি তাঁর হৃদয় যন্ত্রণাকে রসঘন করে তুলে নিঃসীম শূন্যতায় পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছেন-সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ঘোর দুর্যোগ, ব্যতিপাত, বজ্রপাত, মেঘগর্জন-বিদ্যুৎচমক। এই ভরা বর্ষায় রাধা গৃহে একাকী। রাধার হৃদয় বিরহে দীর্ণ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে-“মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী/ফাটি যাওত ছাতিয়া।” বিরহের যন্ত্রণায় রাধা শীর্ণকায়া হয়ে ওঠেন। তখন তাঁর হৃদয় থেকে আক্ষেপ ধ্বনিত হয়- “অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব/ কি করব বারিদ মেহে।/ এ নব যৌবন বিরহে গোঙায়ব/কি করব
পিয়া-লেহে।” সো
কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বিদ্যাপতি কৃয়কান্তশিরোমণি রাধাকে চিরবিরহের সাম্রাজ্যে ফেলে রাখেননি। ভাবসম্মিলনের জগতে রাধাকৃষ্ণের চিরমিলন ঘটিয়েছেন। রাধা নিজের দেহমন্দিরেই মিলনসুখ অনুভব করেছেন। তাঁর এই প্রগাঢ় উপলব্ধি ঘটেছে যে নয়ন সমুখে কৃয় না থাকলেও তাঁর অন্তরে কৃষ্ণ চিরআসীন। সেজন্য তাঁর আনন্দের সীমাপরিসীমা নেই- ‘কি কহবরে সখি আনন্দ ওর। চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর।’
বিদ্যাপতির পদাবলির বিষয়বৈচিত্র্য শুধু তাঁর কাব্যবৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেনি। পরন্তু তাঁর মানবিক চেতনার স্পর্শে সকল বিষয় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সুখদুঃখ, আনন্দ বিষাদ, মিলনবিরহ ও মান-অভিমানের এমন লীলায়িত জীবনছন্দ সমকালীন
উপসংহার
কাব্যে ঝংকৃত হয়নি বললে চলে। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতিকে সুখের কবি, আনন্দের কবি, যৌবনের কবি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু একথা বিদ্যাপতি সম্পর্কে অংশত খাটে। আসলে বিদ্যাপতি জীবনের সামগ্রিকতার কবি-বিচিত্র লীলারস উপলব্ধির কবি। বিদ্যাপতি বহিরিন্দ্রিয়ের অনুগামী হয়েও ইন্দ্রিয়াতীত। বঙ্কিমচন্দ্র যথার্থই বলেছেন- ‘বিদ্যাপতির কবিতা দূরগামিনী বেগবতী তরঙ্গ সংকুলা নদী।’ এবং বিরহের পদে ‘বিদ্যাপতির কবিতা রুদ্রাক্ষ মালা।’
‘প্রার্থনা’ বিষয়ক তিনটি পদেও বিদ্যাপতির কৃতিত্ব সমধিক। বিদ্যাপতির ভক্তিভাবুকতা
প্রার্থনা
ও ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক আকুতি সুস্মিত কাব্যরূপ লাভ করেছে। বৈয়বধর্মে দীক্ষা না নিয়ে, বৈয়বীয় জীবনচর্যা ও সাধনভজনের রীতিনীতি না মেনেও
অনুভূতির প্রগাঢ়তা ও সত্যোপলব্ধির গভীরতায় তিনি বৈয়বোত্তম এক পরম মহন্ত। ‘ভণয়ে বিদ্যাপতি শেষ-শমন ভয়/তুয়া বিনু গতি নাহি আরা।
আদি-অন্যদিক নাথ কহায়সি/অবতারণ-ভার তোহারা।’
বিদ্যাপতি মানবিক জীবনরসের কবি হলেও তাঁর রচনায় আধ্যাত্মিক উত্তরণও ঘটেছে। যে মর্তগৃহে মানুষের জন্ম ও সুখদুঃখ মিলনবিরহের লীলা চলছে তাকে কবি পরিহার করেন নি। পরন্তু এই মানবজীবনের লীলাভূমিতে বিচরণ করেই তিনি ঊর্ধ্বায়িত জীবনসত্যের সন্ধান করেছেন। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্পর্কে যথার্থ মন্তব্য করেছে- ‘কল্পনার বিশাল
বিশ্বব্যাপী অসীমকালে প্রসারিত রহস্যভেদকারী পরিধির সঙ্গে কীর্তনের সৌন্দর্যভোগে অপরিতৃপ্তি ও শেলির আদর্শ সন্ধানে ঊর্ধ্বাভিযান পিয়াসি হৃদয়াবেগ যেন নিবিড় একাত্মতায় যুক্ত হইয়াছে।’
আদিরসকে ভিত্তি করেই বিদ্যাপতি শৃঙ্গারকে ভক্তির উচ্চমার্গে তুলতে সমর্থ হন। বিষয়বস্তু, ছন্দ, সংগীতধর্ম ও ভাববৈচিত্র্যে বিদ্যাপতি শুধু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি
উপসংহার নন, সমগ্র পূর্ব ভারতেও তিনি শীর্ষস্থানীয় বিশিষ্ট কবি। সৌন্দর্য সুখসল্লেগের তরঙ্গলীলায় তাঁর পদাবলি মিলনমধুর বিরহবিধুর শাশ্বত জীবনছন্দকে বর্ণদীপ্ত করে আধ্যাত্মিকতার দিকে গতিনির্দেশ করেছে। বৈয়ব পদাবলি সাহিত্যের অন্যতম রূপকার ও পথনির্মাতা বিদ্যাপতি।
ব্যক্তিগত প্রতিভা ও গভীর কাব্যানুভূতির সাহায্যে তিনি বৈয়ব পদাবলি সাহিত্যের পথিকৃৎ। পরবর্তীকালের বৈয়ব পদাবলি বিদ্যাপতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। তাঁর শ্রেষ্ঠ ভাবশিষ্য হচ্ছেন গোবিন্দদাস কবিরাজ। বিদ্যাপতি-কৃত পথ দিয়েই পরবর্তীকালের অনেক কবি সগৌরবে যাত্রা করেছেন।
৩ . বিদ্যাপতি ও ব্রজবুলি ভাষা
বিদ্যাপতির পদাবলির কাব্যভাষার নাম ব্রজবুলি। তিনি ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছিলেন কিনা এ সম্পর্কে পন্ডিতেরা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। অনেকের মতে বিদ্যাপতি মাতৃভাষা মৈথিলি ভাষায় মূল পদাবলি রচনা করেছিলেন।
ভূমিকা পরে তাঁর পদ ব্রজবুলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁর পদাবলি বাংলা, আসাম ও উড়িষ্যায় প্রচলিত হলে তাতে আঞ্চলিক ভাষা প্রবেশ করে। ফলে একটা কৃত্রিম কাব্যভাষা তৈরি হয়। ড. সুকুমার সেন লিখেছেন, ষোড়শ শতাব্দীতে আসামে ‘ব্রজবলী’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে আধুনিক কালে ঈশ্বর গুপ্তই প্রথম ‘ব্রজবুলি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু বাংলাদেশে কাব্যরসিকদের মুখে মুখে মধ্যযুগ থেকেই ব্রজবুলি শব্দটি প্রচলিত। তখন থেকেই বাঙালি বিশ্বাস করতেন বৃন্দাবনের রাধা, কৃষ্ণ ও সখীরা ব্রজবুলি মিশ্রভাষা এই ভাষায় কথা বলতেন। তাই এর নাম ব্রজবুলি অর্থাৎ ব্রজের বুলি বা ভাষা। বর্তমানে বৃন্দাবনের স্থানীয় জনসাধারণ যে ভাষায় কথা বলেন তার নাম ব্রজবুলি নয় ব্রজভাখা বা ব্রজভাষা। এই ভাষা একটি জীবন্ত লৌকিক ভাষা। এটা পশ্চিমা হিন্দিরই একটি শাখা। কিন্তু ব্রজবুলি কথ্য ভাষা নয়। ব্রজবুলিতে কেউ কোনোদিন কথা বলেনি। আর ব্রজবুলির সঙ্গে ব্রজভাষার কোনো সাদৃশ্য বা মিল নেই। আসলে ব্রজবুলি একটি মিশ্র কৃত্রিম কাব্যভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তনেই এর উদ্ভব ঘটেছে। ব্রজবুলি ভাষার ভিত্তি মৈথিলি ভাষা। এই মৈথিলি ভাষার জন্ম মাগধী অপভ্রংশ থেকে। মিথিলা এককালে নব্য ন্যায়শাস্ত্র চর্চার পীঠস্থান ছিল। বাংলাদেশ থেকে অনেক ছাত্র ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষার জন্য মিথিলায় যেত। বিদ্যা সমাপনান্তে তাঁরা বিদ্যাপতির পদ মুখে মুখে বহন করে আনত। কালক্রমে বাঙালির মুখে পড়ে সেই মৈথিলি ভাষার অনেক রূপান্তর ঘটে। মৈথিলি ও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে কৃত্রিম ও মিশ্র ব্রজবুলি ভাষার উৎপত্তি। এভাবে আসামে
মৈথিলি ভাষার সঙ্গো অসমীয়া ভাষার সংমিশ্রণে অসমীয়া ব্রজবুলি ভাষার সৃষ্টি। ওড়িয়া ব্রজবুলি সম্পর্কে এই একই কথা।
ব্রজবুলি ভাষার শ্রুতিমাধুর্য অতুলনীয়। ব্রজবুলি ললিত কোমল মধুর বলেই প্রেমানুভূতির মিলন বিরহ ভাব প্রকাশের অন্যতম বাহন। ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তনে ইতিহাসের সক্রিয় প্রবর্তনায় এর সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। যা স্বাভাবিক নয়, যা কৃত্রিম তার আয়ু ফুরিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। এক বিশেষ ভাবগত পরিমণ্ডলের মধ্যেই ব্রজবুলি উদ্ভব ও বিস্তার ঘটেছে। বিদ্যাপতির অনুকরণে সার্থক ব্রজবুলির পদ রচনা করেছেন গোবিন্দ দাস, জ্ঞান দাস ও বলরাম দাস প্রমুখ কবিবৃন্দ। আধুনিক কালে ঈশ্বর গুপ্ত ও রবীন্দ্রনাথ ব্রজবুলিতে পদ রচনায় প্রয়াসী হন। কিন্তু এঁদের ব্রজবুলি ভাষা বৈশ্বব সাহিত্যের ব্রজবুলির মতো সুললিত নয়। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন- ‘বাঁশরি বাজাতে চাই, বাঁশরি বাজিল কই?’
তিন. চণ্ডীদাসের পদাবলি
চৈতন্যপূর্ব যুগে বিদ্যাপতির মতো চণ্ডীদাস আর একজন শ্রেষ্ঠ কবি। বাংলাভাষায় তিনি প্রথম পদাবলি সাহিত্য রচনা করেন। কিন্তু চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। চন্ডীদাস নামধারী অন্তত চারজন কবি
ভূমিকা
ছিলেন বলে পণ্ডিতেরা চন্ডীদাস সমস্যার সমাধান করতে প্রয়াসী হয়েছেন।
এ নিয়ে বিতর্ক আছে। প্রকৃত সমাধান হয়নি। যা হোক, আমরা পদাবলির চন্ডীদাসকেই বেশি করে চিনি। বৈশ্বব পদাবলি সাহিত্যে এখনও চণ্ডীদাসের স্থান অতি উচ্চে। অল্প কথায়, সহজ ভাষায় বৈয়বীয় প্রেমের নিগূঢ় ভাবকে তিনি অপূর্ব কাব্যসংগীতে ফুটিয়ে তুলেছেন।
চন্ডীদাসের ব্যক্তিপরিচয় সঠিক কিছু জানা যায় না। জনশ্রুতি অনুসারে তিনি বীরভূম জেলার নান্নুর গ্রামে বাস করতেন। জাতিতে ব্রাহ্মণ এবং আদিতে বাশুলি বা চণ্ডীর উপাসক হয়েও তিনি সহজমার্গের সাধনায় ব্রতী হন। ইনি রামী নাম্নী জনৈকা
কবিপরিচয়
রজক-কন্যাকে সাধনসঙ্গিনী হিসাবে গ্রহণ করেন। রজকিনি রামীর
কথা কোনো কোনো পদে পাওয়া যায়। রজকিনি ও চন্ডীদাসের প্রেম ছিল কামগন্ধহীন আধ্যাত্মিক আদর্শপুত। ‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম/কামগন্ধ নাহি তায়।’ কথিত আছে যে চন্ডীদাস এক রাজার ক্রোধে পতিত হয়ে হস্তীপদতলে পিষ্ঠ হয়ে প্রাণ হারান। চন্ডীদাসের পদাবলির রাধা এক সূক্ষ্মভাবের জ্যোতির্ময়ী বিগ্রহ। জন্ম থেকেই তিনি কৃষ্ণপ্রেমে
উন্মাদিনী। জন্মজন্মান্তরে তিনি কৃয়গতপ্রাণ-জাগতিক অনুভূতির ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মিক জগতের অভিযাত্রী। তাই চণ্ডীদাসের রাধা চরিত্রে কোনো ক্রমবিকাশ নেই। পূর্বরাগ, অনুরাগ, বিরহ ও মিলন প্রভৃতি বিচিত্র পর্যায়ের কবিতা চন্ডীদাস লিখলেও সব পদেই প্রেমানুভূতিতে বিরহ প্রবল।
চন্ডীদাসের পদে কৃষ্ণ রাধার মনের মানুষ। কৃষ্ণনাম জপ করতে করতে তাঁর প্রাণ অবশ হয়ে যায়-তিনি মিলন ও বিরহের এক অপূর্ব সৌন্দর্যময় রোমান্টিক রাজ্যে গিয়ে হাজির হন। রবীন্দ্রনাথ চন্ডীদাসের পদাবলি আলোচনা করতে গিয়ে রাধার প্রেমসাধনাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন-“চন্ডীদাস সহজ ভাষার সহজ ভাবের কবি-এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি।”
চন্ডীদাসের কবিতায় রাধার যে প্রেম তা এক গভীরতম দুঃখবোধের জীবন-নির্যাস। চন্ডীদাস দুঃখের মধ্যে সুখ ও সুখের মধ্যে দুঃখকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর রাধা প্রেমের সাধনায় ব্যাকুল ও গভীর। প্রেমে দুঃখ আছে, বেদনা আছে, এমনকি মৃত্যুও অনিবার্য। তাই বলে প্রেমকে পরিত্যাগ করা যায় না। কঠোর দুঃখের সাধনায় প্রেমের স্বর্গীয় দ্যুতি ফুটে ওঠে। চন্ডীদাসের পদাবলিতে প্রেমের শ্রেয়োবোধ অপার্থিব রসলোক সৃষ্টি করেছে- সেখানে উপভোগের কামগন্ধ নেই-আছে আত্মানুভূতির নিবিড় আনন্দ। এটাই বড়ো প্রেমের বৈশিষ্ট্য। বড়ো প্রেমের সাধনায় কুলশীল, জাতিমান সব পরিত্যাগ করতে হয়-পরকে আপন করতে হয় ও আপনকে পর করতে হয়। পদে পদে রক্তের পদচিহ্ন এঁকে কুল-খোয়ানো অভিসার যাত্রায় বেরিয়ে পড়তে হয়। এমনকি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়- ‘চণ্ডীদাস বলে শুন বিনোদিনী/পীরিতি না কহে কথা। পীরিতি লাগিয়া পরাণ ছাড়িলে।
পীরিতি মিলয়ে তথা।।’
প্রথম থেকেই চন্ডীদাস রাধার বৈরাগ্যময়ী তপস্বিনী মূর্তি চিত্রিত করেছেন। কৃয়কে তিনি চোখে দেখেননি, কিন্তু তার নাম শুনেই তিনি কাতর ও ভাবাবেশে বাহ্যজ্ঞানরহিতা। বেদনাবিহ্বল কণ্ঠে বলে ওঠেন-‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম/কানের ভিতর দিয় মরমে পশিল গো/আকুল করিল মোর প্রাণ।’ নাম জপ করতে করতেই যখন রাধার শরীর দারুণভাবে অবশ হয়ে যাচ্ছে, তখন দেহের পরশে আরও সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে। শ্রীকৃয়কে ভোলার চেষ্টা করেও রাধা ভুলতে পারেন না। কৃয়-অনুরাগ সুতীব্র হয়ে ওঠে। কুলীন জাতির মান-মর্যাদা নষ্ট হয়। কৃষ্ণের জন্য গেরুয়া-রাঙা বসন পরে আহার-বিহার পরিত্যাগ করে কৃষ্ণধ্যানে তন্ময়চিত্ত হলেন। যেসব বস্তুর সঙ্গে কৃয়ের সাদৃশ্য আছে সেদিকেই তিনি নিবিষ্টচিত্ত ও আবেশ বিহ্বল হয়ে পড়েন:
‘সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে/না চলে নয়ান তারা।
বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে/যেমতি যোগিনী পারা।।
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি/দেখয়ে খসায়ে চলি। হসিত বয়ানে চাহে মেঘ পানে/কি কহে দুহাত তুলি।।
এক দিঠ করি ময়ূর ময়ূরী/কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে। চন্ডীদাস কয় নব পরিচয়/কালিয়া বধুর সনে।।’
রাধা শুনেছেন কালিন্দী নদীর তীরে নবজলধর শ্যাম আনাগোনা করেন। শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভের জন্য তার চিত্ত ব্যাকুল। তাই ঘর থেকে বাইরে বার বার যাতায়াত করেন, কদম্ব- বনে তাকান। কৃয়কে না-দেখার, না-পাওয়ার মর্মবেদনা কত গভীর তা কাউকে বলে প্রকাশ করা যায় না। সখীর সঙ্গে জল আনতে যান। যমুনার কালো জল দেখে কৃষ্ণের কালো রূপের কথা মনে পড়ে যায়। আরও অস্থির হয়ে ওঠেন। ঘরে ফিরে গুরুজনদের সামনে দাঁড়াতে রাধার লজ্জা হয়। কারণ সর্বদা ছলছল আঁখি। সমস্ত ভুবন শ্যামময় ঠেকে তাঁর চোখে- ‘পুলকে আকুল/দিক্ নেহারিতে/সব শ্যামময় দেখি।’ সর্বদাই শ্যামসুনাগর তাঁর হৃদয়ে জেগে রয়। এতে কুলধর্ম রাখা দায়- ‘কুলের ধরম রাখিতে নারিনু কহিলু সবার আগে।’ কুলশীল জাতিমান সব জলাঞ্জলি দিয়ে কলঙ্কের ডালি মাথায় নিয়ে রাধা প্রেমের নৈবেদ্যস্বরূপ নিজেকে কৃষ্ণের চরণতলে সমর্পণ করতে চান। এই ঐকান্তিক আত্মনিবেদনে প্রেম ও ভক্তি বিশেষ তাৎ
পর্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে। ভালোমন্দ, সতী ও অসতী কোনো কিছুরই চিন্তাভাবনা নেই রাধার। তাঁর একমাত্র কামনা-‘বঁধু কি আর বলিব আমি/জীবনে মরণে জনমে জননে/প্রাণনাথ হৈও তুমি।’
কৃয়প্রেম এক রহস্যঘন অতল গভীর বস্তু। তাই কৃয়ের সঙ্গে মিলনেও রাধার অহেতুক বিচ্ছেদভাবনা। মিলনের মধ্যে এই স্বেচ্ছাসৃস্ট বিরহ-ভাবনা কল্পনার উত্তুঙ্গশীর্ষে চমৎকার কাব্যসৌন্দর্য লাভ করেছে। ‘দুই কোরে দুই কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়াতিলে আধ না দেখিলে যায় যে মরিয়া।’
রাত্রিদিনের ব্যবধান ঘুচিয়ে নিরন্তর দুঃখের সাধনায়ও রাধা কৃয়প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেননি-‘বাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি/বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পীরিতি।’ অপূর্ব মোহিনী জানে কালা কানু। ‘দারুণ মুরলী স্বর/না মানে আপন পর।’ আর তাতে রাধার ‘নিশি নিশি অনুখন/প্রাণ করে উচাটন/বিরহ অনলে জ্বলে তনু।’
পূর্বরাগ থেকে অভিসার ও ভাবসম্মিলন পর্যন্ত চন্ডীদাস রাধার বৈরাগ্যবিধুর তপস্বিনী মূর্তি গড়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতায় সর্বত্র লোকগঞ্জন ভীতা কুলবধূ রাধার ব্যাকুল আর্তি ও প্রেম সাধনায় গভীর হৃদয়যন্ত্রণা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেতে। মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্বেই তাঁর পদাবলির সুর বাংলার ঘরে ঘরে মাঠে-ঘাটে বেজে উঠেছিল। চন্ডীদাসের রাধা যেন গৌরলীলারই পূর্বাভাস। চন্ডীদাস বাঙালির প্রাণলোকের ক্রান্তদর্শী কবি। একান্ত সরল সহজ গ্রাম্য জনগণের প্রচলিত আটপৌরে ভানায় তিনি পদাবলি রচনা করেছেন। তিনি ভাবতন্ময় মরমিয়া কবি। তাঁর কবিতায় বাংলার পল্লিগ্রামের রূপ, রঙ, রসের শ্যামল সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। সাধারণ বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষাতেই তাঁর পদ রচনা। কিন্তু সেই সর্বজনপরিচিত লৌকিক ভাষা চন্ডীদাসের সহজাত প্রতিভার স্পর্শে অলৌকিক ভাবব্যঞ্জনায় শিল্পমূল্য পেয়েছে। ‘আমার পরাণ যেমতি করিছে তেমনি হউক সে’, ‘শংখ বণিকের করাত যেমন আসিতে-যস্তুতে ‘কাটে’, ‘কানুর পীরিতি চন্দনের রীতি ঘসিতে সৌরভময়’ ও ‘জলবিনে মীন যেন কবন্ধু না জিয়ে’-এইসব সহজ ভাষা ও অলংকার পাঠকের হৃদয়কে এক অপূর্ব ভাবরসে পরিপূর্ণ করে তোলে। চন্ডীদাসের ভাষা রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘ছেড়েছে তার সকল অলংকার।’ চন্ডীদাসের কাব্যে বাচাতুর্য অলংকার ও চিত্রপ্রয়োগের চেষ্টা নেই। অথচ পরিপূর্ণ হয়ে আছে ভাবগভীর অনুভূতি ও অনুপম কাব্যসৌন্দর্য।
চার, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাসের পদাবলি
১. সাধারণ আলোচনা
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাসে বৈয়ব পদাবলি বাঙালির
সর্বোত্তম সাহিত্যকীর্তি বললে অত্যুক্তি হয় না। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর বৈয়ব ভূমিকা পদাবলি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে শত ধারায়। মানবহৃদয়ের অতিসূক্ষ্ম অনুভূতি ও প্রবল উৎকণ্ঠা, প্রগাঢ় সৌন্দর্যানুভূতি ও সুকোমল প্রেমমাধুর্য, অতীন্দ্রিয় জীবনবোধ ও বিস্ময় বিমুগ্ধ ভাববিহ্বল রোমান্টিক জীবনচেতনা অমূল্য রসসৌকর্যে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় বৈয়বধর্মের ভাব-প্রবক্তা। ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক নরনারীর হৃদয়ের প্রেম ভালোবাসার অভিন্নতা সম্পর্কে স্থাপিত হয়। বৈয়ব মতে রাধা জীবাত্মা, কৃয় হলেন পরমাত্মা। রাধাকৃষ্ণের প্রেম তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বা বিশুদ্ধ মতে মর্তবাসী মানব-মানবীর প্রেম নয়। এটা জীবাত্মা পরমাত্মার অপ্রাকৃত বৃন্দাবনলীলা। বৈয়বপদকর্তাদের পদাবলি বৈকুণ্ঠের জন্য। কিন্তু কৃয়প্রেমমুগ্ধা শ্রীরাধিকার অশ্রু ছলছল যে জীবনচিত্র কবিরা এঁকেছিলেন-নিশ্চয়ই তা এই মর্তনারীর বিরহ ছলছল আঁখির প্রতি দৃষ্টিপাত করে। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈয়বের গান নয়, যদিও লক্ষ্য বৈকুণ্ঠ। বৈয়ব কবিরা বৈয়বতত্ত্বে দীক্ষিত হয়েও মর্তজীবনের মাধুর্যকে অস্বীকার করেননি। মর্তমানবীর মান অভিমান মিলন বিরহই রাধিকার তত্ত্বকথায় রূপান্তরিত হয়েছে।
বৈয়বধর্মে দীক্ষিত বৈয়ব পদকাররা অন্তরের সমস্ত সৌন্দর্য মাধুর্য উজাড় করে দিয়ে সৌন্দর্যঘন শ্রীরাধিকার তিলোত্তমামূর্তি অঙ্কন করেছেন। মধ্যযুগের বৈয়ব কবিদের হৃদপদ্ম বিকশিত অনুভূতির অপরূপ সৌন্দর্যপ্রতিমা শ্রীরাধিকা। প্রাচীন পুরাণাদি ও অন্যান্য গ্রন্থে খন্ড খন্ড কবিতায় রাধার বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু পরিচয় মেলে। তারপর বৈয়ব কবিদের হৃদয় সমুদ্রে স্নাত হয়ে সেই রাধার পূর্ণাবয়ব নতুন এক সৌন্দর্যমূর্তি গড়ে উঠেছে। বৈয়ব কবিরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রাধাকে রূপলাবণ্যময়ী করে তুলেছেন। যুগ যুগ ধরে মানুষের রূপ সৌন্দর্যের প্রতি যে প্রবল অনুরাগ ও অদম্য আকর্ষণ, প্রেমের জন্য যে সুতীব্র ব্যাকুলতা-শ্রীরাধিকা সেই চিরকালীন মনুষ্য-হৃদয়ের সমস্ত সৌন্দর্যপ্রিয়তা ও প্রেমপিপাসার পুঞ্জীভূত মূর্তি। বৈয়ব কবিদের শ্রীরাধিকা বৈয়বীয় তত্ত্ব ও মানবীয় রসের এক উজ্জ্বলতম নায়িকা।
বৈয়ব পদাবলি সাহিত্য মুক্ত জীবনের জয়গানে মুখরিত। প্রেম স্বাধীন ও সর্ববন্ধনমুক্ত। এটি জীবনের শ্রেয়োবোধের দ্যোতনাবাহী। তাই যে অনুবাদ সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্য সমাজের রীতিনীতির পথ ধরে চলেছিল, বৈয়ব সাহিত্য সেখানে একটা বিরাট ব্যতিক্রম। বৈয়বসাহিত্য রাজসভা থেকে মুক্তি লাভ করে জনপথবাহী হয়ে মধ্যযুগের প্রথানুবর্তী জীবনচেতনার মধ্যে পালাবদলের সূচনা ঘটিয়েছে। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি প্রণিধানযোগ্য যে বৈয়বকাব্যই আমাদের দেশের সাহিত্যকে প্রথম রাজসভার সংকীর্ণ আশ্রয় থেকে বৃহৎভাবে জনসমাজের মধ্যে সম্প্রসারিত করেছে।
বৈয়ব পদাবলি সাহিত্যকে চৈতন্যপূর্ব ও চৈতন্যোত্তর দুই পর্যায়ে ভাগ করা যায়। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে উপজীব্য করে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় খণ্ড খণ্ড কিছু কবিতা রচিত হতে দেখা যায়। তারপর জয়দেবই প্রথম সরল সংস্কৃত ভাষায় সুললিত কান্ত কোমল পদে ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যে রাধাকৃষ্ণের কাহিনিকে রূপ দেন। বাংলাভাষায় বড়ু চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস রাধাকৃয় বিষয়ক কাহিনির রচয়িতা। গীতসাহিত্যে চৈতন্যপূর্ব যুগের এঁরা শ্রেষ্ঠ কবি। এ স্থলে বলা দরকার যে চৈতন্যপূর্ব যুগের কবিদের ব্যক্তিগত ধর্মচেতনা ও কাব্যাদর্শ এক ছিল না। সাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রভাবমুক্ত কবিরা মানব-মানবীর প্রেমের স্বচ্ছন্দ বিকাশ লক্ষ করেছেন রাধাকৃয়ের প্রেমের মধ্যে। তাঁদের রচিত পদাবলি মূলত মানবীয় রসে পরিপূর্ণ। ভক্তি যদি বা কোথাও থাকে তা তাঁদের উপলব্ধির
বস্তু। কিন্তু চৈতন্য-পরবর্তীকালের পদাবলি সাহিত্য স্বরূপত ভিন্ন। মহাপ্রভু যে ভক্তিধর্ম প্রচার করেছিলেন তাতে রাধাকৃয় তত্ত্বের আদর্শ ব্যাখ্যাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। পদকার লিখেছেন- ‘গৌরাঙ্গ নহিত কি মেনে হইত কেমনে ধরিত দে ৮ রাধার মহিমা প্রেমরস সীমা জগতে জানাত কে।।/ মধুর বৃন্দা বিপিন-মাধুরী-প্রবেশ চাতুরী সার।/ বরজ-যুবতী-ভাবের ভকতি শকতি হইত কার।।’
বাস্তবিকই মহাপ্রভু তাঁর ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে রাধাকৃয়ের অপ্রাকৃত প্রণয়লীলাকে সর্বজনবোধ্য- সহজরূপে প্রকাশ করেন। মানবীয় প্রণয়রীতির মাধ্যমে বৈয়বপদাবলির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটায় সাধারণ পাঠক নায়ক-নায়িকার বিরহমিলনের আর্তি ও আনন্দ সহজে উপলব্ধি করতে পারে। আবার বৈয়বের গান ভক্তের ভক্তিপিপাসার্ত অন্তরকে ঐশ্বরিক অনুভূতিতে পরিতৃপ্ত করে।
পদাবলি সাহিত্যের পূর্ণবিকাশ ঘটেছে মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পর। মহাপ্রভুর সমকাল থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পদাবলি সাহিত্যের কূলপ্লাবী সৃষ্টিধারা প্রবাহিত। চৈতন্যোত্তর পদাবলি প্রধানত তিনটি ধারার মুক্ত ত্রিবেণি রাধাকৃষ্ণলীলা, শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ও গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ।
চৈতন্যোত্তর পদাবলি সাহিত্যের কবিরা স্বাধীন ভাবকল্পনা অনুযায়ী কবিতা রচনা করেননি। চৈতন্য প্রবর্তিত বৈয়ব ভাব ও জীবনদর্শন এ সময়ের পদাবলি সাহিত্যকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে। কবিরা সবাই সাধক; বৈয়বধর্মে দীক্ষিত হয়েই ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে তাঁদের কবিপ্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। এ যুগের পদাবলিতে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনার স্বাতন্ত্র্য
বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
চৈতন্য আবির্ভাবের পর বৈয়বপদাবলিতে নতুন বিষয়ের সংযোজন গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদ। শ্রীগৌরাঙ্গের রহস্যময় মর্তলীলা নিয়ে বহু কবিতা রচিত হয়েছে। এর কারণ হল, গৌড়ীয় বৈয়বাচার্যদের চোখে মহাপ্রভু রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ। অন্তরঙ্গে তিনি কৃষ্ণ, বহিরঙ্গে রাধা। রাধাভাবের জীবন্তমূর্তি শ্রীচৈতন্য শ্রীরাধিকার মতোই কৃষ্ণের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। রাধাপ্রেম যে কী বস্তু তিনিই সকলকে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণসমর্পিত প্রাণ সেই মহাপুরুষের বাল্য, কৈশোর ও ভাবময় জীবনের বিচিত্র দিক নিয়ে পদকাররা গীতিমাধুর্যের
অপূর্ব রসলোক সৃষ্টি করেছেন।
- গৌরাঙ্গবিষয়ক পদগুলি দুই পর্যায়ে বিভক্ত। এক, বিশুদ্ধ গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ-এগুলি গৌরাঙ্গ জীবনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। দুই, গৌরচন্দ্রিকা। সেই সমস্ত গৌরাঙ্গবিষয়ক পদই গৌরচন্দ্রিকা – যেগুলির ভাবের পরিপূরক রাধাকৃবিষয়ক পদ রয়েছে। চৈতন্য-সমসাময়িক কীর্তনীয়া সমাজে এই ধারণা গড়ে উঠেছিল যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে সাধারণ শ্রোতারা মানব- মানবীর প্রেমের ব্যাপার বলে গ্রহণ করতে পারে। তাই শ্রোতাদের চিত্তকে আধ্যাত্মিক চেতনায় পূর্বাহ্নে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রাধাকৃয়বিষয়ক পদ গান করার পূর্বে তাঁরা গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ গান করতেন। রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলার সঙ্গে মিল রেখে যেসব গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ গান করা হয় তাই গৌরচন্দ্রিকা। এর উদ্দেশ্য ছিল শ্রোতার চিত্তকে লৌকিক প্রেমের ভাবানুভূতি থেকে ভগবদ্প্রেমে উন্নীত করা।
চৈতন্য আবির্ভাবের পর রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা নিয়ে অজস্র কবিতা রচিত হয়েছে। প্রেক্ষাপট হচ্ছে দ্বাপর যুগের বৃন্দাবন, নায়ক কিশোর কৃয়, নায়িকা কিশোরী রাধিকা।
দার্শনিক চিন্তাচেতনা কবিদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করলেও বিষয়বস্তু নায়ক-নায়িকার প্রেম ও অতীত জীবনলীলা হওয়ায় রোমান্টিক কল্পনার ব্যাপকতা ও মানবীয় জীবনরস বৈয়বপদাবলিকে অসামান্য কাব্যকৌলীন্য দান করেছে। রবীন্দ্রনাথের এস্থলে বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য- ‘বৈয়ব কবিদের পদাবলি বসন্তকালের অপর্যাপ্ত পুষ্পমঞ্জরীর মতো। যেমন তাহার ভাবের সৌরভ তেমনি তাহার গঠনের সৌন্দর্য।’
বৈয়ব কবিরা মহৎ এক ধর্মীয় আদর্শে দীক্ষিত হওয়ায় মহাজন নামে অভিহিত। তাঁদের রচিত কবিতা মহাজন পদাবলি। আবার বৈয়ব কবিতা জীবনেরই পদাবলি। বিরহতাপিত চিরপ্রেমিকার অশ্রুধারার মধ্যে স্বর্গলোকের আনন্দসুধা ঝরে পড়েছে। চৈতন্যপূর্ব যুগের কবিদের মধ্যে অন্যতম জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস।
২. কবি জ্ঞানদাস
জ্ঞানদাস: চৈতন্যপরবর্তী কালের একজন সুবিখ্যাত বৈয়ব পদকর্তা। বৈয়ব পদাবলি সাহিত্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস-এই চারজন কবিই প্রতিনিধি- স্থানীয় কবি ও নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। জ্ঞানদাসের জীবন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য আত্মপরিচয় তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকটে
কাঁঙ্গড়া বা কাঁদড়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে আনুমানিক ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। ইনি নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবী দেবীর নিকট বৈয়বধর্মে দীক্ষিত হন। নিত্যানন্দের তিরোধানের কিছুদিন পরে তিনি জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে বৃন্দাবনে তীর্থ করতে যান। বৃন্দাবনে জ্ঞানদাস শ্রীজীব, রঘুনাথ দাস, গোপালভট্ট ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখ বিখ্যাত বৈম্নবাচার্যদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। জ্ঞানদাস, নরোত্তম দাস আয়োজিত খেতুরির কবি সম্মেলনে যোগ দেন। সেই অনুষ্ঠানে গোবিন্দদাস কবিরাজ ও বলরাম দাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এর বেশি কিছু তাঁর সম্পর্কে জানা যায়নি। কবি চিরকুমার ছিলেন। জ্ঞানদাসের ভণিতায় প্রায় চারশত পদ পাওয়া গেছে। মনে হয় অল্প প্রতিভাশালী কবিরা জ্ঞানদাসের নামে তাঁদের কবিতা অনেক চালিয়ে দিয়েছেন।
জ্ঞানদাস বৈয়বভক্ত কবি। তাঁকে চন্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়। চন্ডীদাসের মতোই জ্ঞানদাসের পদে প্রকাশরীতির সরলতা ও ভাবের গভীরতা লক্ষ করা যায়। জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই কবিতা রচনা করেছেন। তবে বাংলা ভাষায়
কাব্যবৈশিষ্ট্য রচিত কবিতাতেই তাঁর প্রতিভার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ব্রজবুলির পদে কবি বিদ্যাপতিকে আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করায় সেগুলি কাব্যসৌন্দর্যের গৌরব অর্জন করতে পারেনি। বাংলা ভাষায় রচিত কবিতাবলিতে ভাবের সরলতা ও অনুভূতির গভীরতা অলংকার-বিরল সহজ ভাষায় অনবদ্য শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভার স্বকীয়তা বাংলা ভাষার পদে দীপ্যমান।
সহজ প্রকাশভঙ্গি ও ভাবগভীরতার দিক থেকে চন্ডীদাসের সঙ্গে জ্ঞানদাসের সাদৃশ্য বর্তমান। কিন্তু চণ্ডীদাসের মতো রহস্যঘন অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্যোতনা আনদাসের কবিতায় নেই। জ্ঞানদাস আধ্যাত্মিক ভাবানুভূতির সঙ্গে মানবিক চেতনার আশ্চর্য সমন্বয়সাধন করেছেন।
তিনি মিষ্টিক ও রোমান্টিক কবি। তাঁর কবিতা রূপ ও অরূপের সংগমতীর্থ। প্রেমের অতল অসীম রহস্য, চিরন্তন অতৃপ্তি বোধ, মিলনের ব্যাকুলতা, বিরহের মর্মান্তিক দাহ ও স্বপ্নচারিতায় মিলনের আনন্দ ও নিবিড় প্রশান্তি প্রভৃতি প্রেমের বিচিত্র লীলা তাঁর পদগুলিতে অপূর্ব শিল্পসৌকর্য লাভ করেছে। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, নৌকাবিলাস ও দানখণ্ড প্রভৃতি বিষয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন। কিন্তু তাঁর কবিপ্রতিভা পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ, মান, নিবেদন, রসোদ্গার, মিলন, বিরহ ও মুরলী শিক্ষা বিষয়ক পদগুলিতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে গৌরব দ্যুতিময়। নায়ক-নায়িকার রূপ বর্ণনা, প্রেমাবেগের তীব্র জ্বালা ও আর্তি, রূপবিভোরতা ও মিলন ব্যাকুলতাকে জ্ঞানদাস অনায়াসেই শিল্পশ্রীমণ্ডিত করে তুলেছেন। ভাব ও রূপের যুগলমূর্তি গঠনে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী।
শ্রীগৌরাঙ্গবিষয়ক পদে জ্ঞানদাস গৌরাঙ্গদেবের রাধাভাবভাবিত একাত্মবোধ এবং কৃয়বিরহজনিত তাঁর ধৈর্যহারা চিত্তের দিব্যভাবমণ্ডিত শ্রীমূর্তি চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন।
জ্ঞানদাস জন্ম-রোমান্টিক কবি। তিনি ভক্তিভাবকে রোমান্টিকতার স্পর্শে লৌকিক রসব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত করে তুলেছেন। রোমান্টিক কবিকল্পনার বৈশিষ্ট্য প্রাণাবেগের তীব্র উচ্ছ্বাস, স্বপ্নমেদুরতা ও অগাধ বিস্ময়বোধ। কৃষ্ণের নয়নমনোহর রূপমাধুর্যে মুগ্ধ ও প্রেমে আকুলা রাধার অন্তর্ভাবনার সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন কবি। শ্রীরাধিকা কত দিনই না কালো কালিন্দী নদীতীরে জল আনতে গেছেন। আজ কিন্তু শ্রীকৃয়কে দেখে ঘরে ফিরতে আর পথই শেষ হয় না-
রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।
ঘর যাইতে পথ মোর হৈল অফুরান।
অন্তরে বিদরে হিয়া কি জানি কি করে প্রাণ।।
শ্রীরাধার জীবনে আজ সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সমস্ত পথটাই যে কৃয় নামাঙ্কিত হয়ে গেছে। রূপের গোলকধাঁধায় পথভ্রষ্ট শ্রীরাধিকা। তাঁর জাতি কুলশীল মান সমস্তই আজ জলাঞ্জলি হয়ে গেল। শ্রীরাধিকা ‘কুলবতী সতী হৈয়া দু-কুলে দিলু দুখ।’ শ্রীরাধিকার এই সমাজ-বিগর্হিত অবৈধ প্রেমভাবনার চিরন্তন মুক্তপ্রেমের রোমান্টিক ভাবব্যঞ্জনা স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি লাভ করেছে। রোমান্টিকতার সঙ্গে প্রকৃতির একটা নিগূঢ় সম্পর্ক থাকে। বর্ষণমুখর শ্রাবণ রজনির নির্জন পরিবেশে শ্রীরাধিকার চিত্ত রোমান্টিক ভাবাবেশে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বপ্নের ঘোরে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর মধুর মিলন সাধিত হয়। স্বপ্নসমাগম তৃষ্টা রাধার একটি পদ ভাবমাধুর্যে অতুলনীয়-
মনের মরম কথা তোমারে কহিয়ে এখা
শুন শুন পরাণের সই।
স্বপনে দেখিল যে শ্যামল বরণ দে
তাহা বিণু আর কারো নই।
রঙীন শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীরঅঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে।
ঝরঝর শ্রাবণের বারিপাত, মেঘের গর্জন, রাত্রি গভীর, চারদিক বজ্রনিনাদিত। রাধার অন্তরের কামনার ধন শ্রীকৃয় স্বপ্নের রথে চড়ে রাধার কাছে উপস্থিত। শ্রীকৃয় এলেন, রাধাকে সোহাগ করলেন-দুজনের মধুর মিলন সাধিত হল। জ্ঞানদাস প্রেমানুভূতির নিবিড় মনস্তত্ত্বকে রোমান্টিক কল্পনায় দীপ্ত করে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ উল্লিখিত কবিতাটির চিরন্তন রোমান্টিক ধর্ম সম্পর্কে সুন্দর মন্তব্য করেছেন- ‘সে মেয়ে আজ নেই। আছে শাঙন ঘন, আজ সেই স্বপ্ন, আজো সমানই।’
প্রেমের অভিন্নাত্মক ভাবপ্রকাশে জ্ঞানদাস ব্যাখ্যাতীত অনির্বচনীয় রসব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন- ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর। প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর। হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে। পরাণ পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।’ আক্ষেপানুরাগের পদে জ্ঞানদাস রাধার প্রণয়ভঙ্গের বেদনার্তিকে সুস্মিত ভাব প্রতীতির মধ্যে স্থিরদীপ্তি দান করেছেন। প্রেমের সুখের জন্য রাধা ঘর তৈরি করলেন। সে ঘর আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেল-অমিয় সাগরে স্নান করতে নেমে-‘সকলি গরল ভেল।’ মেঘের বারি আকাঙ্ক্ষা করতে ‘বজর পড়িয়া গেল’। শ্রীকৃষ্ণের প্রেম কঠিন সাধনার বস্তু। এই সাধনার পথে অনেক আঘাত সহ্য করতে হয়- ‘জ্ঞানদাস কছে/কানুর পিরীতি/মরণ অধিক ভেল।’ অনুরাগের পদ রচনায় জ্ঞানদাসের কবিব্যক্তিত্ব সর্বাধিক স্ফূর্তিলাভ করেছে। কৃষ্ণের প্রতি তীব্র অনুযোগ রাধা প্রকাশ করেন মধুর স্বরে- ‘অন্যের আছয়ে অনেক জনা/আমার কেবল তুমি।’
রাধার জীবনের সুখদুঃখ ইহকালের পরম সঙ্গী শ্রীকৃয়। তাই জ্ঞানদাসের রাধা আঘাতের মধ্যে আনন্দ পায়, অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোর সন্ধান পায়। ‘দেখিয়া যতেক লোক করে উপহাস/চাঁদের উদয়ে যেন তিমির বিনাশ’। আর গুরুজনেরা গঞ্জনা করলে- ‘গুরু গরবিত যতেক গঞ্জে/ মণি যেন জ্বলে তিমির পুঞ্জে।’ জ্ঞানদাস দুঃখবোধের কবি। কিন্তু তাঁর দুঃখবোধের মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে এক অনাবিল আনন্দ। জ্ঞানদাসের রাধা মিলনে দয়িতের সঙ্গসুখ পান না। এই অবস্থা মর্মান্তিক-‘একলি মন্দিরে শুতলি সুন্দরি কোরহি শ্যামর চান্দ/তবহু কাকর পরশ না ভেল এ বড়ি মরমক ধন্দ।।’
কবি জ্ঞানদাস ভক্ত ও সাধকরূপে বন্দাবনে রাধা কৃষ্ণের মধ্যে চিরন্তন মানব-মানবীর ব্যর্থপ্রেমের হতাশা বেদনাকে প্রত্যক্ষ করে বিরহযন্ত্রণাদগ্ধ প্রেমের অলকাপুরী নির্মাণ করেছেন। সেদিক থেকে জ্ঞানদাস একই সঙ্গে বৈয়বসাধক সৌন্দর্যরসিক ও চিরায়ত মানবরসের কবি। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে বৈয়বীয় তত্ত্বের দিক থেকে গ্রহণ করলেও সৌন্দর্যরসিক জীবনপ্রেমিক জ্ঞানদাস সেই অলৌকিক প্রেমভাবনাকে লোকায়ত জীবনের রহস্যে ছন্দিত করে তুলেছেন। তাই জ্ঞানদাসের কবিতা সর্বকালের রসমর্যাদায় উন্নীত। প্রকাশভঙ্গির মাধুর্যে, ভাবের গভীরতা ও রসানুভূতির তীব্রতায়, মনস্তত্ত্বের নৈপুণ্যে ও সৌন্দর্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে জ্ঞানদাসের কবিতা গীতিকবিতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। জ্ঞানদাস চিরকালের রসিক পাঠকের প্রিয়তম কবি।
৩. গোবিন্দদাসের পদাবলি
গোবিন্দদাস চৈতন্যোত্তর পদাবলি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে ও বৈয়বীয় দর্শনে সুপণ্ডিত গোবিন্দদাস বিধিদত্ত কবিপ্রতিভার সাহায্যে ছন্দসংগীতের বাণীশিল্পে
যে অপূর্ব সৌন্দর্যের জগৎ সৃষ্টি করেছেন সেক্ষেত্রে তিনি জয়দেব-বিদ্যাপতি-ভারতচন্দ্রের সমগোত্রীয়। কিন্তু কাব্যাদর্শের দিক থেকে তিনি বিদ্যাপতিকে বিশেষভাবে অনুসরণ করেছেন। ভূভূমিকা তাই বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর ভাবগত আত্মীয়তা বেশি। বিদ্যাপতির অনেক খণ্ডিত বা অসম্পূর্ণ পদ তিনি সম্পূর্ণ করে ‘বিদ্যাপতি গোবিন্দদাস’- যুগ্মভণিতা যোগ করেছেন। বিদ্যাপতির মতোই গোবিন্দদাস অনেক প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী জমিদারের কাছে সম্বর্ধিত হন। বিদ্যাপতি যেমন জয়দেবের কাব্যাদর্শ অনুসরণ করে ‘অভিনব জয়দেব’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন, গোবিন্দদাস তেমনি বিদ্যাপতির অনুরূপ ভাষাভঙ্গি, ছন্দোলালিত্য ও অলংকারসমৃদ্ধ ভাবের রূপনির্মিতিতে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি নামে আখ্যাত। বিদ্যাপতির সঙ্গে গোবিন্দদাসের ভাবসাদৃশ্যের দিকে লক্ষ রেখে সমসাময়িক শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য বল্লভদাস সপ্রশংস মন্তব্য করেছেন- ‘ব্রজের মধুর লীলা যা শুনি দরবে শিলা। গাইলেন কবি বিদ্যাপতি/তাহা হৈতে নহে ন্যূন গোবিন্দের কবিত্বগুণ। গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।’ গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলা হলেও বৈয়বীয় তত্ত্বের ভাবানুভূতির প্রকাশে জীবনদৃষ্টির গভীরতা, তত্ত্বের রসসৌকর্যসাধন ও মন্ডনকলার শিল্পদ্যোতনায় তিনি বহুস্থলে বিদ্যাপতির থেকেও উচ্চস্তরের কবি। বৃন্দাবনের শ্রীজীব গোস্বামী তাঁকে কবীন্দ্র বলে সম্মানিত করেছিলেন। তদবধি গোবিন্দদাস কবিরাজ নামে খ্যাত।
গোবিন্দদাস ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে কাটোয়ার শ্রীখণ্ডে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মাতামহ বিখ্যাত পণ্ডিত দামোদর সেন। পিতার নাম চিরঞ্জীব সেন ও মাতা সুনন্দা দেবী। কবিরা জাতিতে বৈদ্য। পিতা চিরঞ্জীব বৈয়ব-ভাবাপন্ন ও শ্রীচৈতন্যের ভক্ত ছিলেন। আদিনিবাস ছিল কুমারনগরে। আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো সময়ে জীবনী ও কাব্য কবির তিরোধান ঘটে। প্রথমে তিনি শাক্ত ছিলেন। পরে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত
বৈশিষ্ট্য হন। সংস্কৃতিবান পরিবারে তাঁর জন্ম। সংস্কৃত সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্রে তিনি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। সংস্কৃতে ‘সঙ্গীত মাধব’ নামে একটি নাটক তিনি রচনা করেন। কিন্তু ব্রজবুলি ভাষায় পদরচনার জন্যই তিনি যশোমন্দিরে চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত রাগানুগা ভক্তির ঐতিহ্য নিয়েই কাব্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব। গোবিন্দদাস ভক্ত, সাধক ও রূপদক্ষ শিল্পী হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবিখ্যাতির অধিকারী। ভক্তিভাবের নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা এবং কাব্যিক মনন উৎকর্ষ তাঁকে কালজয়ী কবিত্বের স্বর্ণমুকুট পরিয়ে দিয়েছে। চৈতন্যোত্তর যুগের তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ পদকার। ভাষা, ছন্দ, অলংকার, চিত্র ও সংগীতের সুষম মিলনে ব্রজবুলিতে লেখা তাঁর কবিতাগুলি সৃজনশীলতার অভিনব শিল্পসামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। গোবিন্দদাসের কবিপ্রকৃতি অলংকারশাস্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তাঁর কবিতাবলি সংস্কৃতভাষার সুললিত মাধুর্য ও ক্লাসিক সংহতির সুমহান গাম্ভীর্যে দীপ্যমান। গোবিন্দদাস গৌরলীলা ও রাধাকৃষ্ণলীলার পূর্বরাগ, অভিসার, মান, কলহান্তরিতা, বাসকসজ্জা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা ও মাথুর প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ের পদকর্তা। তাঁর গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ সমগ্র বৈয়ব সাহিত্যে ভক্তিতন্ময়তার একক নিদর্শন। একজন রূপদক্ষ শিল্পীর ভাবের গূঢ়তা ও গাঢ়তা, আলংকারিক শিল্পনৈপুণ্য, চিত্র ও সংগীতধর্মিতা এস্থলে অসাধারণ কাব্যগৌরবে উজ্জ্বল। দিবাভাবচঞ্চল মহাপ্রভুর অন্তর্জীবনের নিখুঁত
লীলাচিত্র গোবিন্দদাস দক্ষ সচেতন শিল্পীর মতো ধীরস্থির তুলির টানে অতীব বর্ণাঢ্য ও সুস্পষ্ট করে তুলেছেন- ‘নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে/পুলক মুকুল অবলম্ব ঢঙ্গেদ মকরন্দ বিন্দু বিন্দু চুয়তাবিকশিত ভাবকদম্ব।’ শ্রীচৈতন্যের মানবিক ও অতিলৌকিক রূপ, মহাপ্রভুর শান্তপুণ্য করুণাঘন দিব্যজীবন ও তাঁর প্রেমাদর্শ রূপে রসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে উত্ত কবিতায়। অন্য একটি কবিতায়- ‘জয় শচী নন্দন রে/ত্রিভুবন মন্ডন কলিযুগ কাল/ভুজগ ভ্যা খণ্ডন রে।।’ রসসৃজন- শক্তির গুণে শ্রীচৈতন্যের চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গোবিন্দদাস মহাপ্রভুকে প্রত্যক্ষ করেননি। কিন্তু সুর ও ছন্দের মেলবন্ধনে শ্রীচৈতন্য এখানে পরিপূর্ণ প্রাণসংযুক্ত ও লাবণ্যরসে উদ্ভাসিত।
রূপানুরাগের পদে রাধার অলৌকিক সৌন্দর্য বর্ণনায় ভক্তি ও রূপের মধ্যে নিবিড় ঐক্য
প্রতিষ্ঠা করেছেন গোবিন্দদাস। ভাষার ঐশ্বর্য ও অলংকৃতি, ছন্দের ঝংকার, ভাবের গভীরতা
ও গাম্ভীর্যে তাঁর কবিতা সৌন্দর্যের অমরাবতী তৈরি করেছে। পূর্বরাগ পর্যায়ের একটি পদে
রাধার সৌন্দর্যে বিভোর কৃয় বলছেন-
যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি। তাঁহা তাঁহা বিজুরী চমকময় হোতি।।
যাঁহা যাঁহা অরুণ চরণে চল চলই। তাঁহা তাঁহা থলকমলদল খলই।।
যাঁহা যাঁহা হেরিয়ে মধুরিম হাস। তাঁহা তাঁহা কুন্দ-কুসুম পরকাশ।
কবির বর্ণনানৈপুণ্যে এখানে শ্রীরাধিকা অপার্থিব সৌন্দর্য লাবণ্যের ভাবপ্রতিমারূপে উদ্ভাসিত। ভাবের ঋজুতা বা দৃঢ় পিনদ্ধ শিল্পরূপে কবিতাটি অনন্য।
গোবিন্দদাসের কবিপ্রতিভা উত্তুঙ্কা শিখর স্পর্শ করেছে অভিসারের পদ রচনায়। এক্ষেত্রে সমালোচকেরা গোবিন্দদাসকে কবিসম্রাট, রাজাধিরাজ বলে অভিহিত করেছেন। অভিসারের অর্থ হল-‘প্রিয়ের মিলন আশে কুঞ্জেতে গমন/সংকেত পূর্বক অভিসারের লক্ষণ।।’ রাধা কুলবতী নারী-গৃহস্থ ঘরের বধূ। পরপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের জন্য সবার অলক্ষ্যে নিশীথ রাত্রে তাঁকে অভিসারে বেরোতে হবে। কুলখোয়ানো তাঁর অভিসার যাত্রা। এই পথে সাপ, ঝড়, বৃষ্টি, কাঁটা, অন্ধকার সবকিছুকে তুচ্ছ করে তাঁকে অগ্রসর হতে হবে। অভিসারের জন্য নিজেকে উপযোগী করে তুলতে রাধা স্বগৃহে রাত জেগে দুস্তর পথযাত্রার সাধনায় রত। অভিসারের যাত্রাপথে যেসব সম্ভাব্য বিপদবাধা দেখা দিতে পারে সে সমস্ত উত্তরণের চেষ্টায় রাধা প্রস্তুত হচ্ছেন-
কণ্টক গাড়ি কমল সম পদতল মন্ত্রীর চীরহি ঝাঁপি
গাগরি বারি ঢালি করি পিছল চলতহি অঙ্গুরি চাপি।।,
করযুগে নয়ন মুদি চলু ভামিনী তিমির পয়ানক আশে।
করকঙ্কণপণ ফণিমুখ বন্ধন শিখই ভুজগ গুরু পাশে।
ঘরের বাইরে দ্বার রুদ্ধ। অবিরাম প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তা কর্দমাক্ত পিচ্ছিল। চারদিক ঘোর অন্ধকারে লিপ্ত। প্রচণ্ড শব্দে ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে। সখীরা রাধাকে সতর্কবাণী শোনাল-এই ভয়ংকর দুর্যোগে অভিসারে বেরোলে প্রেমের জন্য তাঁর জীবননাশ অনিবার্য। কিন্তু প্রিয়ের জন্য শ্রেয়ের জন্য যে জীবন উৎসর্গ করেছে তাঁর কাছে প্রকৃতির বাবা কিছুই নয়-মৃত্যুও নিতান্ত তুচ্ছ। কুলমর্যাদার কপাট যে লঙ্ঘন করেছে তার কাছে ‘তাহে কাঠ কি বাধা’। ভয়ংকর দুর্যোগকে উপেক্ষা করে রাধা অভিসারে যাবেনই। কারণ-
কোটি কুসুম শর বরিখয়ে যদুবর তাহে কি জলদ জল লাগি।
প্রেম দহন দহ যাহ হৃদয় সহ তাহে কি বজরক আগি।।’
দুর্যোগের রাত্রিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অনেক বাধা ও কষ্ট অতিক্রম করে রাধা শ্রীকৃত্রের সঙ্গে মিলিত হলেন। কিন্তু সেই মিলন আনন্দের নয়। শ্রীরাধিকার পথযাত্রা বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু মনের গতি থামেনি। পথ আগমনের দুঃখবার্তা তিনি বলে চলেছেন। অভিসারের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রবল প্রাণশক্তি ও অবিশ্রান্তভাবে পথ হেঁটে চলা। গোবিন্দদাসের অভিসারের পদ এই চলমানতা ভাববৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। প্রেমের জন্য অভিসারে কঠিন দুঃখের কথা রাধা শ্রীকৃয়কে শোনাচ্ছে- ‘পথ আগম কথা/কত না কহিব হে/যদি হয় মুখ লাখেলাখ।’
শ্রীকৃষ্ণের জন্য রাধার যে প্রেমসাধনা তা অনন্তের অমৃতলাভের জন্য। অনন্ত বলেই সেই প্রেমের অভিসারের বিরতি নেই। পরমকে পেতে হলে দুঃখের মধ্য দিয়ে ত্যাগের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। পরমের সাধনা সত্য লাভের কঠিন সাধনা। কবে পরমের সাক্ষাৎলাভ ঘটবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তবুও সেই অনন্তের জন্য ‘কত রাত্রি অন্ধকারে চলেছে
মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে’।
গোবিন্দদাসের অভিসার পদের শিল্পরীতি বৈশিষ্ট্যদ্যোতক। অলংকার সজ্জায়, শব্দচিত্রে, ধ্বনিঝংকারে, অনুভূতির তীক্ষ্মতায়, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্বের আরোপে, চিত্রধর্মে ও নাটকীয়তায় পদগুলি উচ্চশ্রেণির গীতিকবিতার উৎকর্ষ লাভ করেছে। অভিসারের সাধনা বাস্তব জীবনের দুঃখকষ্টের ব্যাপার বলেই সেখানে নাটকীয়তা প্রচুর।
গোবিন্দদাস বৈয়ব পদাবলির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেও কিছু কিছু তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতিও লক্ষণীয়। অনেক কবিতায় অলংকার ভারস্বরূপ হওয়ায় তাঁর কবিতার প্রাণপ্রবাহ ব্যাহত হয়েছে। অলঙ্কার যেখানে কবিকল্পনারই অঙ্গীভূত, তখন শিল্প-সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা ঘটেছে। যেমন-
শরদ চন্দ পবন মন্দ বিপিনে করল কুসুম-গন্ধ
ফুল্ল মল্লী মালতী যুথী মত্ত মধুপ ভোরনি।
হেরত রাতি ঐছন ভাতি শ্যাম মোহন মদনে মাতি
মুরলী-গান পঞ্চম তান কুলবর্তী চিত চোরনি।
শারদ প্রকৃতির রম্য পরিবেশ সমস্ত বনভূমি কুসুমের বাসে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। প্রস্ফুটিত মল্লিকা মালতী যূথী। পুষ্পে পুষ্পে ভ্রমরের গুঞ্জন মোহন-মুরতি শ্রীকৃষ্ণের চিত্ত প্রেমোন্মত্ত। পঞ্চমতানে তিনি বাঁশি বাজাচ্ছেন। গীতঝংকার, ছন্দের চারুত্ব ও অনুপ্রাসের শ্রুতিমাধুর্যে কবিতাটি চমৎকার শিল্পকৃতির নিদর্শন। প্রকৃতির বস্তুচিত্রটি অলংকার ও হৃদয়ানুভূতির সার্থক সমাবেশে রসোত্তীর্ণ।
বিরহের পদ রচনায় গোবিন্দদাস সার্থকতা অর্জন করতে পারেননি। এর কারণ সমালোচকের মতে গোবিন্দদাস বেদনার কবি নন, আরাধনার কবি। কিন্তু মনে রাখা দরকার বিরহই বৈয়ব কবিতার মূল শক্তি। কেননা বিরহবোধেই প্রেমের যথার্থ উপলব্ধি। গোবিন্দদাস বিরহের পদ রচনায় সেই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু তিনি সাধক ও বড়ো কবি বলে তাঁর অন্যান্য কবিতা রসোত্তীর্ণ।
অনুশীলনী
১। বড়ু চণ্ডীদাস কোন্ সময়ের কবি? তাঁর কাব্যের নাম কী? তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
(উ. মা. ১৯৯৪)
২। ‘শ্রীকৃয়কীর্তন’ কার রচনা? এটি কে, কবে কোথা থেকে আবিষ্কার করেন? কাব্যটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর গুরুত্ব নির্ণয় করো।
(উ. মা. ১৯৯৯)
৩। ‘শ্রীকৃয়কীর্তন’ কাব্যটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই কাব্যের পুথিটি আবিষ্কারের গুরুত্ব বিচার করো।
(উ. মা. ২০০৩)
৪। বিদ্যাপতি কোন্ সময়ের কবি? তিনি কোন্ ভাষায় পদ রচনা করেছিলেন? তাঁর পদাবলি কবিপ্রতিভা বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলার যৌক্তিকতা বিচার করো।
(উ. মা. ১৯৯৯)
৫। বিদ্যাপতি কোন্ স্থানের কোন সময়ের কবি? তাঁর জীবন ও কবিপ্রতিভা সম্বন্ধে সংক্ষেপে লেখো।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্যাপতির গুরুত্ব নির্ণয় করো।
(উ. মা. ১৯৯৭)
৬। বাংলা পদাবলি সাহিত্যে চন্ডীদাসের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো। জ্ঞানদাসকে চন্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা কি যুক্তিসংগত? (উ. মা. ২০০০)
৭। বিদ্যাপতির কবি-প্রতিভার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ কী? (উ. মা. ২০০১)
৮। বাংলা পদাবলি সাহিত্যে চন্ডীদাসের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো। জ্ঞানদাসকে চন্ডীদাসের
ভাবশিষ্য বলা হয় কেন?
(উ. মা. ১৯৮৪)
১। চৈতন্য-পরবর্তী দুই বিখ্যাত পদকর্তার সাহিত্যিক কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।
(উ. মা. ১৯৮৩) (সংকেত: জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস] ১০। বৈয়ব পদাবলির মূল বিষয়বস্তু কী? দুইজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি পদকর্তার কবিকৃতির পরিচয় দাও।
(উ. মা. ১৯৮৪)
১১। গোবিন্দদাসের কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও। তাঁকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলা হয় কেন? সংক্ষেপে আলোচনা করো। (উ. মা. ১৯৯৮)
১২। চৈতন্যোত্তর বৈশ্বব পদাবলির সাধারণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করো। এই পদকর্তার নাম লেখো। এঁদের মধ্যে যে-কোনো একজনের কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও। পর্বের প্রধান দুজন (উ. মা. ২০০২)