১. সাধারণ আলোচনা
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের শাখাটি একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। সংস্কৃত সাহিত্যের ভাগবত, রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ করে সে সময়ে বাঙালি ভূমিকা কবিরা বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। যে-কোনো দেশের সাহিত্যে অনুবাদের গুরুত্ব যথেষ্ট ভিন্নতর বিষয়বস্তুর সান্নিধ্যে এসে অন্য একটি ভাষা নানা দিক থেকে শক্তি সঞ্চয় করে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে। এতে ভাষার সমৃদ্ধি ঘটে ও সাহিত্যের পরিধি বিস্তৃত হয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের মাধ্যমে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয়বস্তুর প্রকাশ ঘটায় আর্যসংস্কৃতির সঙ্গে আপামর বাঙালি চিত্তের সংযোগ সাধিত হয়। ফলে নতুন দিগন্তের দিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারিত হয়।
তুর্কি আক্রমণের আগে বল্লাল সেনের সময় কৌলীন্য ধর্ম ও বর্ণাশ্রমের তন্ত্রমন্ত্র সংহিতার নানা প্রথা ও আচারের জালে জড়িত হয়ে হিন্দু সমাজ এক সর্বনাশা বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট চলছিল। তুর্কি সেনার আক্রমণে সেই বিপর্যয় আরও প্রবল আকার ধারণ
করে। প্রাণভয়ে বাঙালিরা বাঁচবার জন্যই দায়ে পড়ে প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তারপর ধীরে ধীরে মুসলিম শাসন সুপ্রিতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তখনও উচ্চ অভিজাত সম্প্রদায়ের ঘৃণা ও অবজ্ঞার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য দলে দলে মধ্য ও নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা স্বাধীন ইচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। হিন্দু সমাজকে এই সর্বনাশা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উচ্চ-নীচ সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে হৃদয়ের ঐক্য বন্ধন ও ভাবমূলক সংহতি স্থাপনের কাজে অগ্রসর হলেন হিন্দু দলপতিরা। তখন উচ্চশ্রেণির মানুষেরা তুচ্ছতা ও অবজ্ঞার হাত থেকে নিম্নবর্ণকে কোলে সংস্কৃতি সমন্বয়ের তুলে নিতে বদ্ধপরিকর হলেন। এতকাল সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চার অধিকার ছিল
মনোভাব শুধুমাত্র উচ্চ অভিজাত সম্প্রদায়ের। নিম্নশ্রেণির লোকেরা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। পরন্তু নিম্নশ্রেণিয়দের আরাধ্য দেবদেবীর আচার অনুষ্ঠান ও পুজোপার্বণের সঙ্গে উচ্চশ্রেণির কোনো সম্পর্ক ছিল না। হিন্দু সমাজকে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এবং অখন্ড ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি গড়ে তুলতে গেলে সর্বাগ্রে পৌরাণিক হিন্দুর আদর্শ লোকসাধারণের মধ্যে প্রচার করা দরকার। সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়েই হিন্দুসমাজে এই আত্মিক মিলনের সূত্রপাত ঘটাতে তাঁরা সচেষ্ট হলেন। এরই পরিণাম হিসাবে দেখা দিল অনুবাদ সাহিত্যের ব্যাপক আয়োজন। সংস্কৃত- অনভিজ্ঞ অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত আপামর বাঙালির কাছে তাই শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির কবিরা ভাগবত, রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি পুরাণাদির বাংলায় অনুবাদ করে তাঁদের ধর্মাদর্শ পৌছে দিলেন। একটি বিরাট সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই কৃত্তিবাস লিখেছেন- সাধারণ
অনুবাদ কাব্য
৫৯ লোকদের সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝাবার জন্যই তাঁর অনুবাদ- ‘লোক বুঝাইতে কৈলা কৃত্তিবাস পন্ডিত।’ আর মালাধর বসু লিখেছেন- ‘ভাগবত অর্থ যত পয়ারে বান্ধিয়া।/ লোক নিস্তারিত গাই পাঁচালি রচিয়া।’
সংস্কৃত রচনাকে বাঙালি জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অনুবাদকেরা স্বাধীন চিন্তাধারার আশ্রয় নিয়েছেন। সংস্কৃত রচনায় যে জীবন বা সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে বাঙালি জীবনের মিল নেই তা বর্জন করেছেন বা নতুন বিষয়ের সন্নিবেশ করে বাঙালি জীবনের অনুগ করে তুলেছেন। আর রয়েছে ভক্তিবাদ। মুসলমান আক্রমণের সময়ে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হিসাবে সারা ভারতে ভক্তিবাদের প্লাবন এসেছিল-এর মূল কথা আচারসর্বস্ব আড়ম্বরপূর্ণ পুজোয় কোনো ফল হয় না, ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি ও তার নাম কীর্তনেই ব্যক্তিমানুষ তথা সমাজজীবনের উত্তরণ ঘটে। মুসলিম শাসকেরাও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের রসাস্বাদনের জন্য ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য বিশেষ আগ্রহী হন। অনেক
শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা
অনুবাদক কবি মুসলমান শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ইলিয়াস শাহি বংশের নৃপতিরা বুঝতে পেরেছিলেন যে সদ্য বিজিত একটি দেশকে শাসন করতে গেলে সেই দেশের মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি স্থাপন করতে হবে এবং দেশের আচার ব্যবহার ও সংস্কৃতিকেও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হবে। তাই মুসলমান শাসকেরা হিন্দু কবিদের দিয়ে পুরাণাদির অনুবাদ করিয়ে রসতৃয়া চরিতার্থ করলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভাগবত, রামায়ণ ও মহাভারতাদির অনুবাদ হিন্দু মুসলমান প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন যে-পালপার্বণ, উৎসব অনুষ্ঠান, আচার ব্যবহারে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় ও ঐক্য সাধিত হয়েছে। এভাবে অনুবাদ সাহিত্য একদিকে আর্যসংস্কৃতি ও বাংলার লৌকিক সংস্কৃতির জীবনধারাকে মিলিয়ে দেবার অনুকূল পরিমণ্ডল তৈরি করল। আবার এই আর্য সংস্কৃতির প্রভাবেই বাংলা সাহিত্য লৌকিক ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে নতুনতর বিষয়ের সান্নিধ্যে পরিপুষ্টি ও বিকাশের উপসংহারকারী সুযোগ পেল। মোটকথা উচ্চ ও নিম্ন সম্প্রদায়ের হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্যের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের পুনর্গঠন এবং সর্বভারতীয় প্রাণধারা, ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি জাতির যোগস্থাপনের জন্য মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ। আর এর ফলেই বাংলা সাহিত্য বিকাশের এই ধারাটি নতুন শক্তি ও সৌন্দর্যে পরিপুষ্টি লাভ করল।
২. রামায়ণের অনুবাদ: কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ পাঁচালি
মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট নিদর্শন বাল্মীকি রচিত রামায়ণ মহাকাব্যের অনুবাদ। কবি কৃত্তিবাস বাংলা রামায়ণের আদি কবি। তিনিই প্রথম উত্তর ভারতে রামায়ণ অনুবাদের পথিকৃৎ। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের নাম রামায়ণ পাঁচালি।
বাল্মীকির রামায়ণে ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতি, আর্য ও অনার্য বা রাক্ষস সভ্যতা সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে সামগ্রিক ঐক্যবোধ ও আদর্শের সংস্থিতি লাভ করেছে। সংস্কৃত রামায়ণে গার্হস্থ্য চিত্র ও করুণ রসের প্রতিষ্ঠা ঘটায় জাতিবর্ণনির্বিশেষে ভারতীয় হিন্দুত্বের ওপর চিরন্তন প্রভাব বিস্তার করে আছে। রামায়ণ বালকাণ্ড বা আদিকাণ্ড,
অযোধ্যাকান্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকান্ড, লঙ্কাকান্ড ও উত্তরাকান্ড-প্রভৃতি সপ্তকান্ডের মহাকাব্য। এই সাতটি কান্ডে সর্বমোট চল্লিশ হাজার শ্লোক রয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণ ও সংস্কৃত রামায়ণের অনুবাদ হয়েছে বহু আঞ্চলিক ভাষায়। রামকাহিনি নিয়ে ভারত সংস্কৃতি পালি, প্রাকৃত ও বহু প্রাদেশিক ভাষায় কাব্য নাটকাদি রচিত হয়েছে। মধুসূদন দত্ত বাল্মীকিকে কবিগুরু ও ভারতের শিরঃচূড়ামণি রূপে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। রামায়ণের কাহিনি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনা আছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে তুলসীদাসের রামচরিতমানস ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ। পঞ্চদশ শতকে কৃত্তিবাস, চন্দ্রাবতী, নিত্যানন্দ আচার্য, অষ্টাদশ শতকে রামানন্দ ঘোষ (যতি), জগৎ রাম রায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে রঘুনন্দন গোস্বামী ও কবিচন্দ্র শংকর চক্রবর্তী রামায়ণ অনুবাদকের অন্যতম।
বাংলা ভাষায় রামায়ণের প্রথম অনুবাদক ও সার্থক যশস্বী কবি কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসের নামে প্রচলিত রামায়ণের মধ্যে কতটুকু নিজের রচনা তা জানবার উপায় নেই। বহু লেখকের অনেক রচনা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। লিপিকর ও গায়েনদের ইচ্ছানুসারে অনেক কিছু বর্জিত, সংযোজিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। কৃত্তিবাসের নামে প্রাপ্ত পুঁথির সংখ্যা অনেক। সেগুলির কৃত্তিবাসের রামায়ণ মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। সে যা হোক কৃত্তিবাসের কবি- প্রতিভার স্বরূপনির্ণয়ে আমাদের অধুনা প্রচলিত রামায়ণকে আশ্রয় করতে হবে। ১৮০২-১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে কৃত্তিবাসের রামায়ণ শ্রীরামপুরের পাদ্রিরা মুদ্রিত করেন। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার কৃত্তিবাসের পুরাতন ভাষাকে ঘষে মেজে যে সংস্করণ করেন- মোটামুটি সেটাই অল্পবিস্তর পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান মুদ্রিত পুঁথির রূপ হয়েছে। বর্তমানে কৃত্তিবাসী রামায়ণ বলতে সেই তর্কালঙ্কারী রামায়ণ বহুল প্রচারিত। কৃত্তিবাসের কাব্যে যে আত্মবিবরণী রয়েছে-মূলত তাকে ভিত্তি করে কৃত্তিবাসের বংশ
পরিচয় ও কাব্য রচনাকাল সম্পর্কে পন্ডিতেরা মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। আত্মবিবরণীটি এই: বঙ্গদেশে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে বেদানুজ নামে এক রাজা ছিলেন, নরসিংহ ওঝা ছিলেন এঁর সভাসদ। পূর্ববঙ্গে কোনো কারণে গোলযোগ সৃষ্টি হলে তিনি নদিয়া জেলার কৃত্তিবাসের পরিচয় ফুলিয়া গ্রামে এসে বসবাস করেন। এরই বংশে কৃত্তিবাসের জন্ম। বংশের নাম হল মুখুটি বংশ। নরসিংহের ছেলে গর্ভেশ্বর, তাঁর ছেলে মুরারি। মুরারির সাত পুত্রের অন্যতম পুত্র বনমালীই কৃত্তিবাসের পিতা। ছয় ভাই ও এক বৈমাত্রেয় ভগিনীর মধ্যে কৃত্তিবাস ছিলেন জ্যেষ্ঠ। কৃত্তিবাসের মাতার নাম মালিনী। কোনো মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রবিবারে কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত করে কৃত্তিবাস রাজপণ্ডিত হওয়ার জন্য গৌড়েশ্বরের সভায় উপনীত হন এবং সেখানে স্বয়ং নৃপতি হল পাত্রমিত্র কর্তৃক বিশেষভাবে সম্বর্ধিত হন। কৃত্তিবাস যা চাইবেন, রাজা তা দিতে স্বীকৃত হলে কৃত্তিবাস উত্তর দেন- ‘কার কিছু নাঞি চাই করি পরিহার। যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সার।।’
এই উত্তর পেয়ে রাজা খুব খুশি হলেন এবং কবিকে রামায়ণ রচনা করতে নির্দেশ দিলেন। কৃত্তিবাস রাজাদেশ পেয়ে রামায়ণ রচনায় ব্যাপৃত হন।
কৃত্তিবাস তাঁর আত্মবিবরণীতে জন্মসনটি জানাননি। তিনি লিখেছেন- ‘আদিতাবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘ মাস।/ তথি মধ্যে জন্ম লইমাম কৃত্তিবাস।’
এই দুই পংক্তিকে অবলম্বন করে পণ্ডিতেরা কৃত্তিবাসের জন্মসন তারিখ সম্পর্কে গবেষণার প্রয়াস পেয়েছেন। এ ব্যাপারে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণীতে উল্লিখিত গৌড়েশ্বর সম্পর্কেও কোনো সঠিক ধারণায় উপনীত হওয়া যায়নি। এই গৌড়েশ্বরকে পণ্ডিতেরা নানাভাবে রাজা গণেশ, জালালুদ্দিন, কংসনারায়ণ ও বুকনুদ্দিন বরবকশাহ ইত্যাদি রূপে চিহ্নিত করেছেন। এসব অনুমানমূলক। তবে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে কৃত্তিবাসকে পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি বলেই ধরা যায় এবং তিনি বুকনুদ্দিন বরবক শাহের সভায় উপস্থিত হন।
কবি কৃত্তিবাস মধ্যযুগের একজন বিশিষ্ট কবি। কবিত্ব ও পাণ্ডিত্যের সমন্বয় ঘটেছে তাঁর রামায়ণে। কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণের হুবহু আক্ষরিক অনুবাদ করেননি। তিনি রচনায় গল্পরসকে প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। সে জন্যই গ্রহণ বর্জন ঘটেছে। অনেকে মূল রামায়ণের কার্তিকের জন্ম, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, অম্বরীষ যজ্ঞ প্রভৃতি তিনি বাঙালির পক্ষে ভয়াবহ হবে বলেই বাদ দিয়েছেন। আবার নতুন বিষয় সংযোজনে গণেশের জন্ম, সম্বরাসুর বধ, কৈকেয়ীর বরলাভ, গৃহক চণ্ডাল প্রসঙ্গ, তরণী সেন, মহীরাবণ-অহিরাবণ কাহিনি ও লবকুশ যুদ্ধ ইত্যাদি বৃত্তান্ত স্কন্দপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, কূর্মপুরাণ, দেবী ভাগবত ও জৈমিণীভারত প্রভৃতি থেকে গ্রহণ করেছেন। এমনকি সম্পূর্ণ নতুন মৌলিক বিষয়ও কিছু কিছু যোগ করেছেন। আপামর জনসাধারণের উপযোগী করে তিনি রামকথাকে বাঙালির মন নিয়ে বাঙালির মতো করে পরিবেশন করেছেন সহজ সরল ভাষায়। রামায়ণ বাঙালি জীবনের মহাকাব্য। এতে রয়েছে বাংলার জনজীবন, পরিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতির নিবিড় স্পর্শে কৃত্তিবাসের সৃজনশীল কবিপ্রতিভার স্বাক্ষর মেলে। বাঙালির হৃদয়, বাংলার বন-উপবনের স্নিগ্ধ শ্যামলিমা ও নদনদীর কুলুকুলু ধ্বনি এবং বাঙালির ভক্তিরস কৃত্তিবাসী রামায়ণে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। কৃত্তিবাসের রামায়ণে মহাকাব্যের গাম্ভীর্য বা উদাত্ততা কোথাও নেই। রয়েছে মধ্যযুগীয় নীতিবোধ। কবির কল্পিত রাম, সীতা, লক্ষ্মণ,
রামায়ণে বাঙালিয়ানা
দশরথ, মন্থরা, কৈশল্যা, কৈকেয়ী এমনকি বিভীষণ, মন্দোদরী, শূর্পণখা প্রভৃতি চরিত্রগুলি বাঙালির ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছে। কৃত্তিবাসের রামায়ণে রাক্ষসগণ রামচন্দ্রের ভক্তরূপে কল্পিত। রামচন্দ্রের শ্রীচরণ দর্শনের আশায় রাবণ সীতা হরণ করেছেন। সীতা শক্তিরূপিণী মহালক্ষ্মী জেনেই তিনি একাজ করেছেন মুক্তিলাভের জন্য। যুদ্ধকালে দেখা যায় রাবণ রামচন্দ্রের স্তুতি করেছেন-আর তখনই রামচন্দ্রের দেদুল্যমানতা- ‘কেমনে এমন ভন্তের করিব সংহার।/ বিশ্বে কেহ রাম নাম না লইবে আর।’
শুধু এই নয়, বিভীষণপুত্র তরণিসেন সর্বাগ্রে রাম নাম লিখে যুদ্ধে নামে। যুদ্ধে তাঁর কাটা মুন্ড ‘রাম’ নাম করতে থাকে। কৃত্তিবাসের রাম বাল্মীকির রামের মতো ধীরস্থির বীর্যবান চরিত্র নয়। প্রবল হৃদয়াবেগে তিনি অত্যন্ত অধীর প্রকৃতির মানুষ হয়ে উঠেছেন-বাঙালির যা অন্যতম স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। এই ভক্তিভাব ও হৃদয়োচ্ছ্বাস বাঙালি জীবনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
শুধু রাম সীতা নয়, কৃত্তিবাসী রামায়ণের সমস্ত চরিত্রই বাঙালির প্রাণের রসে সিক্ত। রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, দশরথ, কৈকেয়ী, মন্থরা, শূর্পণখা পর্যন্ত প্রত্যেকটি চরিত্র বাঙালির ঘরোয়া
আদর্শে তৈরি। রাম বীর বটে তবে তিনি বাঙালি বীর- স্নেহে, মমতায় ও কোমলতায় সজল। ভক্ত হনুমান কর্মী ও জীবন্ত চরিত্র। দশরথ বাংলারই স্ত্রৈণ বৃদ্ধ। রাম একান্তভাবে পত্নী- বিবিধ বর্ণনা পাগল, দুর্বল স্বামী; সীতা সহনশীলা ও ভক্তিমতী কুলবধূ। রাবণ বাংলারই দুর্বৃত্ত জমিদার। মুনি-ঋষিরা ভোজনপ্রিয় বাঙালি ব্রাহ্মণ। বাঙালির জীবন ও জীবিকা নিসর্গপ্রকৃতি, পশুপক্ষী, আচার-প্রথা বেশভূষা, খাদ্যবস্তু ও রীতিনীতি সমকালীন অন্য কোনো কবির কাব্যে এরূপভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি। রামচন্দ্রের জন্মের পর পাঁচ দিনে পাঁচুটি, ছয় দিনে যষ্ঠী পূজা ও ছয়মাসে অন্নপ্রাশন প্রভৃতি সমস্তই বাঙালির আচার অনুষ্ঠান থেকে আহত।
রামচন্দ্রের অন্বেষণে ভরত যখন গৃহকের আতিথ্য গ্রহণ করেন তখন তাঁকে অভ্যর্থনা করা হয় দধি, দুগ্ধ, নারিকেল, চিতল ও রুইমাছ ইত্যাদি সামগ্রী দিয়ে। নারিকেল পুলি, কলাবড়া, তালবড়া, ছানাবড়া, ছানাভাজা, খাজা গজা, জিলিপি, পাঁপড়, গুড়পিঠে, কচুরি, লুচি, ক্ষীর প্রভৃতি নানাধরনের বাঙালির ভোজন-সামগ্রীর উল্লেখ আছে রামায়ণে। উত্তরাকাণ্ডে দেখি শাক ভাজা, ঝোল, অম্বল, পায়েস, দধি, পিষ্ঠকাদি ব্যঞ্জন দিয়ে লক্ষ্মণকে সীতাদেবী আহার করিয়েছেন। পশুপক্ষীর বর্ণনাতেও কবি বাংলাদেশের সারস, কাদাখোঁচা, গৃধিনি, কোকিল, চিল, ফিঙে, পেঁচা, কাকাতুয়া, খঞ্জন, বক, বাদুড়, কাঠঠোকরা প্রভৃতি পাখিসমূহকে
জীবন্ত করে তুলেছেন।
কৃত্তিবাসের রামায়ণে বাঙালির পারিবারিক জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শগুলি সুপরিস্ফুট হয়েছে। পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃপ্রেম, পতিনিষ্ঠা ও বাঙালির বিবিধ নৈতিক আদর্শ ও আধ্যাত্মিক এষণাকে কৃত্তিবাস সুললিত কাব্যরূপ দিয়েছেন। কৃত্তিবাসি রামায়ণ বাঙালিকে জীবনচর্চায় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে আদর্শগত প্রেরণা দিয়ে আসছে। বাঙালি কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়তে পড়তে পথ চলবার জন্য খুঁজে পায় সত্য ও শিবের সন্ধান। কৃত্তিবাস মূলত করুণরসের ভান্ডারী। তাঁর রামায়ণ করুণ রসের আকর। অযোধ্যাকাণ্ডের থেকে
রস
সীতার পাতাল প্রবেশ সর্বত্রই করুণরসের ঝরণাধারা প্রবাহিত হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণও করুণরসপ্রধান- কিন্তু কৃত্তিবাসে সেই রস আরও গভীর। দশরথ কর্তৃক অন্ধ মুনির পুত্র বধ, সীতাহরণ, রামচন্দ্রের বিলাপ, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, সীতানির্বাসন, সীতার পাতাল প্রবেশ ও সরযূ-সলিলে রামচন্দ্রের দেহত্যাগ প্রভৃতি বিষয় করুণরসে আর্দ্র এবং তা বাঙালিকে গভীর বেদনায় আপ্লুত করে। করুণরসের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বীররস এবং হাস্যরস সৃষ্টিতে কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব কম নয়। তবে হাস্যরস যতটা সার্থক, বীররস ততটা নয়। ভক্তিভাবুকতার তীব্রতা বীররসকে ম্লান করে দিয়েছে। কৃত্তিবাসের লেখনীতে হাস্যরস খুবই গাঢ়তর বর্ণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটি দৃষ্টান্ত এই বন্দি হনুমানকে বেঁধে রাবণের অনুচরবৃন্দ যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন- ‘মনে মনে হাসে তবে পবন কুমারে। প্রস্রাব করিয়া দিল কাঁধের উপরে।।’
তারপর হনুমানকে দেখে লঙ্কার রমণীরা পরিহাস করলে সে তার সমুচিত জবাব দেয় যে রাবণ তাঁর ভগিণী শূর্পনখার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে চায়। রাজি না হলে রাবণ তাকে বন্দি করেছে। ছন্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে তিনি
মাত্রাবিন্যাসে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। লক্ষ্যার্থক বাক্যগুচ্ছ প্রয়োগে কৃত্তিবাসের বিশেষ নৈপুণ্য প্রশংসনীয়। রাবণের চিতা, কালনেমির লঙ্কাভাগ, ঘরের শত্রু বিভীষণ, বানরের গলায় মুক্তামালা, রাম-রাজত্ব, লঙ্কাকাণ্ড প্রভৃতি বাংলাভাষাকে বিশিষ্টার্থক মূল্যে সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট করেছে। এমনিতর ভাবপ্রকাশের বহু জ্ঞানধর্মী সংকেত রয়েছে কৃত্তিবাসের রামায়ণে। অলংকার প্রয়োগেও বহুস্থানে কৃত্তিবাস মৌলিক কবিপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা বাঙালি জীবনের প্রেক্ষাপটেই সমগ্র কাব্যটি রচিত। বাঙালি জীবন ও বাঙালি ভাবের দ্বারা কাব্যটি পরিপুষ্ট হয়েছে বলে কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালির একান্ত আদরের সামগ্রী। বাঙালির জীবনগীতা কৃত্তিবাসি রামায়ণ। সমস্ত চরিত্রই এখানে বাঙালির সন্তানে পরিণত। তাঁর সঙ্গে বিশেষত নিবন্ধন সূত্র হিসাবে ভক্তিভাবুকতাই প্রধান আসন জুড়ে বসেছে। রবীন্দ্রনাথে মতে রামায়ণে ভক্তির লীলা। এই ভক্তির সঙ্গে বিভিন্ন রসের অভিব্যক্তি ঘটেছে বলে তা সর্বস্তরের নরনারীর পরম উপভোগের কাব্য। সমগ্র বাঙালির জাতীয় চেতনাকে তিনি কল্পনার রঙে অনুরঞ্জিত করে এক পরমানন্দের অমরাবতী গড়ে তুলেছেন। বিরাট বনস্পতির মতো কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালির প্রাণকেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থেকে তাঁদের জীবনচেতনাকে আনন্দে আদর্শে পরিস্ফুট করে তুলেছে। মধুসূদন যথার্থই বলেছেন- ‘কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি এ বঙ্গের অলংকার।’ আজকের যুগে যাকে গণসাহিত্য বলা হয় সেদিক দিয়ে বিচার করলে সমগ্র বাংলা কাব্যসাহিত্যের বিচিত্র ধারায় কৃত্তিবাস মধ্যমণির ন্যায় বিরাজমান। অন্য কোনো সাহিত্য রামায়ণের মতো এত ব্যাপকভাবে জনজীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেনি। কৃত্তিবাস-সৃষ্ট প্রত্যেকটি চরিত্রে বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য দেদীপ্যমান। তার সঙ্গে
যুক্ত হয়েছে সার্বজনীন ঈশ্বভক্তির অধিকার।
যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব কিন্নর ও নরবানর রাক্ষসদের কাহিনিকে অতিক্রম করে সমস্ত রণোন্মাদনা ও কোলাহলের ঊর্ধ্বে কৃত্তিবাসী রামায়ণে প্রধান হয়ে উঠেছে স্নেহ, প্রেম, শ্রদ্ধা, পাতিব্রত্য, বাৎসল্য প্রভৃতি মানব হৃদয়ের চিরন্তন বৃত্তিগুলি। কৃত্তিবাসি রামায়ণে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তাঁর হৃদয়ের ভাষা ও প্রাণের আকুতি। বাঙালি জীবনে কাল থেকে কালান্তরে কত পরিবর্তন হয়ে গেল-আরও এগিয়ে যাবে কাল; বাঙালি চিত্তে রামায়ণের জনপ্রিয়তা চিরদিন অম্লান থাকবে। এটি বাঙালির জাতীয় কাব্য। রাম, লক্ষ্মণ ও সীতাকে বাঙালি আদর্শ স্বামী-স্ত্রী ও ভ্রাতা হিসাবে গ্রহণ করে। সংস্কৃত রামায়ণের কাহিনি, প্রেক্ষাপট ও চরিত্রগুলি অবিকৃত রেখে কৃত্তিবাস বাঙালির জীবনধর্মকে রসসৌকর্যে মন্ডিত করে তুলেছেন। বাঙালির প্রাণ-মন- আত্মা-বাঙালির দিবসরজনির সুখ দুঃখ, আনন্দ, বেদনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্যোতনা কৃত্তিবাসের রামায়ণ। বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনাদর্শ ও সত্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালির জাতীয় মহাকাব্য।
৩. ভাগবতের অনুবাদ: মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়
কবি কৃত্তিবাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভাগবত পুরাণের অনুবাদ করে সাহিত্যকে পরিবর্ধিত ও সমৃদ্ধ করে গেছেন মালাধর বসু।
সংস্কৃত সাহিত্যে আঠারোখানি পুরাণ ও ছত্রিশটি উপপুরাণের মধ্যে ভাগবত পুরাণই ভারতবর্ষে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শুধু ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষা নয়-ইউরোপেও
এই পুরাণ সর্বপ্রথম অনূদিত হয় ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বারোটি স্কন্দে বিভক্ত ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের জীবনমাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। মূলত এই ভাগবতী আদর্শকে কেন্দ্র করেই ভারতবর্ষের ধর্ম ও দার্শনিক চিন্তার বিচিত্রমুখী বিকাশ ঘটেছে। মালাধর বসু ভাগবতের শুধু দশম ও একাদশ স্কন্দের সূত্র অবলম্বন করে কাব্য রচনা করেন।
কবি মালাধরের জীবন সম্পর্কে কিছু বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। কেদারনাথ ভক্তিবিনোদ কবির জন্মস্থান কুলীন গ্রামে গিয়ে কিছু কুলপরিচয় সংগ্রহ করেন। তাছাড়া মালাধর বসু গ্রন্থের আরম্ভে ও পরিসমাপ্তিতে কিছুটা আত্মপরিচয় দিয়েছেন।
গ্রন্থরচনার সন তারিখ সম্পর্কে কবি এরূপ উল্লেখ করেছেন- ‘তেরশ পঁচানই শকে প্রশ আরন্তন/চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন।’ অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে কাব্যরচনা শেষ হয়। সুতরাং বলা যায় কুলীন গ্রামের কায়স্থ পরিবারে কবির জন্ম। গ্রন্থোৎপত্তি সম্পর্কে কবির বক্তব্য স্বপ্নে ব্যাসদেবের আদেশ পেয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর কবিত্বশক্তিতে প্রীত হয়ে গৌড়েশ্বর তাঁকে গুণরাজ খান উপাধিতে ভূষিত করেন- ‘গুণ নাই, অধম মুই, নাই কোনো জ্ঞান/ গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুণরাজ খান।’
কেদারনাথ ভক্তিবিনোদ মহাশয় এই শ্লোকটির কথা জানিয়েছেন। এটি প্রক্ষিপ্ত বলেই অনেকে মনে করেন। কারণ আজ পর্যন্ত কোনো পুথিতেই এর উল্লেখ নেই। মালাধর কথিত এই গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবকশাহ ও শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ প্রমুখ।
কবিকৃত বংশ-পরিচয় থেকে জানা যায়-বর্ধমান জেলার কুলীনগ্রামে বিখ্যাত কায়স্থ পরিবারে কবির জন্ম। পিতার নাম ভগীরথ, মাতার নাম ইন্দুমতী। মালাধারের পুত্র সত্যরাজ খান (অপর নাম রামানন্দ বসু) শ্রীচৈতন্যের ভক্ত ও পার্ষদ ছিলেন। সব দিক বিচার করে মোটামুটিভাবে বলা চলে মালাধর বসু পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লোক ছিলেন।
মালাধর জানিয়েছেন, জনসাধারণের কাছে দুরূহ সংস্কৃত ভাষায় লেখা ভাগবত কাহিনি ও আদর্শ প্রচারের জন্য তাঁর কাব্য রচনা। কৃয়চরিত্রের কীর্তিকলাপ বর্ণনা করে ধর্মীয় আদর্শে
তিনি মানুষকে উদ্ধার করতে প্রয়াসী হন।-
‘ভাগবত অর্থ যত পয়ারে বান্ধিয়া। লোক নিস্তারিতে গাই পাঁচালি রচিয়া।।
কলিকালে পাপচিত্ত হব সব নর। বাঁচালির রসে লোক হইব বিস্তর।।
গাহিতে গাহিতে লোক পাইব নিস্তার। শুনিয়া নিষ্পাপ হব সকল সংসার।।’
মালাধর বসুর শ্রীকৃয়বিজয়, শ্রীকৃয়বিক্রম, গোবিন্দবিজয় ও গোবিন্দমঙ্গল নামেও অভিহিত। শ্রীকৃষ্ণের মহিমা বা কীর্তিকথা অর্থাৎ তাঁর বীরত্বের দিক বর্ণিত হয়েছে বলে কাব্যের এই নামকরণ। ‘বিজয়’ বা ‘মঙ্গল’-দুটোই সমার্থক। গৌরবকৃতির ব্যঞ্জনাবাহী।
ভাগবতের দশমস্কন্দে কৃল্পের জন্ম থেকে দ্বারকালীলা পর্যন্ত শান্ত জীবনকাহিনি এবং একাদশ স্কন্দে যদুবংশ ধ্বংস, কৃয়ের দেহত্যাগ ও উদ্ধবের কথোপকথনের মাধ্যমে জ্ঞান কর্ম ভক্তি ও মুক্তির নানা তত্ত্বকথা স্থান পেয়েছে। মালাধর ভাগবতের আত্মপরিচয়
এইসব ভগ্নাংশকে বাদ দিয়ে কেবল কাহিনি অংশটুকু গ্রহণ করেছেন। আসল কথা, কৃল্পের জন্ম থেকে দেহত্যাগ পর্যন্ত কৃয়লীলার সামগ্রিক জীবনী মালাধর জনচিত্তের উপযোগী করে রচনা করেন। তাই শ্রীকৃয়বিজয় ভাগবতের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। মালাধর নিজের স্বাধীন কল্পনানুসারে এই কাব্য রচনা করেন। শ্রীকৃয়চরিত্রকে বৈচিত্র্যদান
করার জন্য ভাগবত-বহির্ভূত নানা কাহিনিকে প্রয়োজনমতো গ্রহণ করেন। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে পন্ডিত মালাধর মহাভারতের সভাপর্ব, হরিবংশ ও বিয়পুরাণ, লিঙ্গপুরাণ ও যোগশাস্ত্র থেকেও অংশবিশেষ কাহিনি নিয়েছেন। তাই সব মিলিয়ে শ্রীকৃয়বিজয় একটি মৌলিক স্বতন্ত্র কাব্য হয়ে উঠেছে। কাব্যটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। আদ্যকাহিনি কাহিনি বিন্যাস বা বৃন্দাবনলীলায় বসুদেব ও কংসের ভগিনী দেবকীর বিবাহ, দেবকীর অষ্টমগর্ভে কৃয়ের জন্ম, নন্দালয়ে কৃয়ের লালনপালন, ইন্দ্রযজ্ঞ নিষেধ, রাস অনুষ্ঠান, কংস কর্তৃক কুয়বধের মন্ত্রণা ও কৃষ্ণ বলরামের মথুরা গমন স্থান পেয়েছে। মধ্য কাহিনি বা মথুরালীলায় কংসবধ থেকে দ্বারকা গমন পর্যন্ত কাহিনি। অন্ত্যকাহিনি বা দ্বারকালীলায় কৃষ্মের রুক্মিণী হরণ, সত্যভামার সঙ্গে কৃয়ের বিবাহ, ঊষার সঙ্গে অনিরুদ্ধের বিবাহ, জরাসন্ধ বধ, সুভদ্রাহরণ, দ্বারকাপুরী ধ্বংস ও কৃয়ের দেহত্যাগ প্রভৃতি স্থান পেয়েছে। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে মালাধর শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যরূপকে বাংলাভাষায় তুলে ধরতে প্রয়াসী
হন। কৃষ্ণের ঐশ্বর্যরূপ বর্ণনায় মালাধরই পথিকৃৎ। বিষয়বস্তুর এই নতুনত্বই তাঁর কাব্যের উপজীব্য বস্তু আর তারই প্রেক্ষাপটে অনুগ বিষয়াদির বর্ণনায় কোথাও কোথাও মালাধরের স্বতঃস্ফূর্ত কল্পনাশক্তি গীতিমূর্ছনায় রসমন্ডিত হয়ে উঠেছে। মূল ভাগবতের তুলনায় মালাধর বসু অধিকমাত্রায় জীবনসচেতন ও সৌন্দর্যপিয়াসী। তাই তাঁর বর্ণনায় পূর্বতন বিষয় স্বচ্ছন্দ সাবলীল ও আলংকারিক সুষমায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে।
তুর্কি আক্রমণে বিধ্বস্ত অধঃপতিত ও ক্ষয়িষু বাঙালি সমাজকে একটা সমুচ্চ আদর্শের
ওপর দাঁড় করাবার জন্য শ্রীকৃয়ের বীরমূর্তি অঙ্কনে তিনি প্রয়াসী হন। পরাভূত ও পথভ্রষ্ট মানুষকে ভীরুতা ও নৈরাশ্য হতাশার অন্ধকার থেকে উদ্ধারের জন্যই
কৃল্প চরিত্র
কৃষ্ণকে তিনি যুগনায়কের বীরোজ্জ্বল মূর্তিতে তুলে ধরেন। বীরত্বে, মাধুর্যে, জ্ঞানে, কর্মে ও ভক্তিতে কৃয়কে আদর্শ মানব ও পতিত উদ্ধারের পথিকৃৎ হিসাবে মালাধরের কাব্যে পাওয়া যায়।
মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্রন্থের লক্ষ্য কৃয়মাহাত্ম্য প্রচার হলেও কবির ভাবকল্পনা আশ্চর্যভাবে সমকালীন সামাজিক জীবনকে অনুসরণ করেছে। কৃয়মাহাত্ম্য সমকালীন জীবনরসের সংমিশ্রণে প্রত্যক্ষ ও সজীব। যুগচেতনা ও সমাজচেতনার প্রতি মালাধরের অকৃত্রিম আনুগত্য এবং বাঙালিজীবন ও পরিবেশের প্রতি অনুরাগ তাঁর কাব্যকে মাধুর্যমণ্ডিত করে রেখেছে। বৃন্দাবন, মথুরা / দ্বারকার চিত্র অঙ্কনের মধ্যে বাঙালি মনোভাব ও বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি শিল্পপ্রমূর্তি লাভ করেছে। আমলকী, নারকেল, বাসক, তাল, তমাল, অশ্বত্থ, কামরাঙা, জলপাই ও সুপারি প্রভৃতি বৃক্ষ এবং মালতী, পদ্ম, কনকচাঁপা, টগর ও কুমুদ ইত্যাদি পুষ্পের বর্ণনায় পল্লবঘন ছায়াসুশীতল এবং সৌরভপূর্ণ লাবণ্যময়ী বাংলাদেশের কথাই রসঘন হয়ে উঠেছে। বর্ণনা প্রসঙ্গে বাঙালির অন্নব্যঞ্জন এবং বিভিন্ন প্রথা ও আচার- অনুষ্ঠানের কথাও এসে পড়েছে। শ্রীকৃয়ের বাল্যলীলায় বাঙালি বালকের জীবনলীলার পরিচয় সুস্পষ্ট সেখানে মা যশোদা বাঙালি বালকের মা হয়ে উঠেছেন।
মৌলিক কল্পনায় মালাধর নিঃসন্দেহে একজন শক্তিধর কবি। ভাগবতকে নিজস্ব সৃষ্টির নব রূপায়ণে, সহজ সরল রচনারীতি ও উপাখ্যান মাধুর্যে- বিশেষত তুর্কি আক্রমণোত্তর ধর্মসংকটের
সময় বাংলাদেশে পৌরাণিক চেতনাশ্রয়ী শ্রীকৃয়চরিত্রের আদর্শ স্থাপনে মালাধরের শ্রীকৃয়বিজয় রচনা-বৈশিষ্ট্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক তাৎপর্যময় অবদান। এ স্খলে মনে রাখা দরকার যে শ্রীকৃয়বিজয়ের ভক্তিবাদ বৈয়বীয় রাগাণুণা ভক্তি নয়। শাস্ত্রীয় বৈষী ভক্তিতেই তাঁর আস্থা। কৃয় প্রসঙ্গে মালাধর বসু লিখেছেন-
‘কয়ের চরিত্র নর। শুন একমনে।
কলি ঘোর তিমির। করিতে বিমোচনে।।
হেন কথা শুনিবারে/না করিহ হেলা।
ভবসিন্ধু তরিবারে। এই মাত্র ভেলা।।’
তা সত্ত্বেও ভাগবত ও কৃষ্ণলীলা সম্পর্কে বৈয়বদের প্রথম প্রেমভক্তি সঞ্চারিত হয় এই কাব্যের মাধ্যমে। শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য বৈয়ব ধর্মের ইতিহাসে এক অমূল্য সংযোজন।
‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে পাওয়া যায়-
গুণরাজ খান কৈল শ্রীকৃয়বিজয়।
তাহা এক বাক্যে আছে মোর প্রেমময়।।
নন্দের নন্দন কৃয় মোর প্রাণনাথ।
এই বাক্যে বিকাইনু মোর বংশের হাথ।।
‘নন্দের নন্দন কৃয় মোর প্রাণনাথ’-শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের এই অংশটিকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ভাববিহ্বল হয়ে পড়লেন। যদিও মালাধরের ভক্তি বৈষীভত্তি, স্বরূপত রাগাণুগা ভক্তি নয়, তবুও কৃয়প্রেমভক্তির যে মহিমময় রূপ শ্রীচৈতন্যের জীবনে মূর্ত হয়ে উঠেছিল তারই আভাস রয়েছে শ্রীকৃয়বিজয় কাব্যে। কৃয়ের ঐশ্বর্য বা বীরত্বের বর্ণনা মালাধরের কাব্যে প্রতিপাদ্য বিষয় হলেও সর্বধর্ম সমন্বয়ের রসব্যঞ্জনায় কবি কালান্তরের ভিত্তিভূমি রচনা করেছেন। কবি লিখেছেন- ‘সর্বভূতে হের আমি দেখাল্য তোমার। ভূতে দয়া সেই করে সেইত আমারে।।। ভূত হিংসা যেই করে সেই আমার বৈরী।/ অহিংসা পরম ধর্ম থাকহ আচরি।।’ নিঃসন্দেহে মালাধরের কাব্য গৌড়ীয় বৈয়বধর্মের পটভূমি রচনায় ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ এবং তা পরবর্তীকালে বৈয়ব সাহিত্যের ক্রমবিকাশেও অল্পবিস্তর, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রেরণা দিয়েছে। কারণ, ‘অহিংসা পরম ধর্ম’- এটাই বৈয়বীয় ভক্তিবাদ ও বৈয়বসাহিত্যের উপজীব্য বিষয়। সবচেয়ে বড়ো কথা মালাধর বসু ভাগবতের কাহিনির বাঙালি বুচিসম্মত সূক্ষ্ম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাভাষার শক্তিবৃদ্ধি ও বাঙালির রসানুভূতিকে আরও সুদৃঢ় করে গেছেন। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
৪. মহাভারতের অনুবাদ
ভারতবর্ষের দুটি মহাকাব্য বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ ও মহামুনি বেদব্যাস রচিত ‘মহাভারতম্’। এই দুটি মহাকাব্যের অনুবাদ রয়েছে বাংলা ভাষায়। বাঙালি জীবনে এই দুই মহাকাব্যের প্রভাব অপরিসীম। বাঙালির জীবন গঠনে ও নিয়ন্ত্রণে এই মহাকাব্যের প্রভাব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত বাঙালির মনের অন্নপানের অক্ষয় ভাণ্ডার হয়ে আছে।’
মহাকবি বেদব্যাস রচিত সংস্কৃত মহাভারত ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনের মহাকাব্য।
ভূমিকা একটা জাতির সুদীর্ঘকালের ধ্যানধারণাগত জীবনাদর্শ এই কাব্যের বিপুল কলেবরে স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থে ভারতবর্ষের সমাজধর্ম, রাজধর্ম, পারিবারিক আদর্শ, আধ্যাত্মিক আদর্শ, ন্যায়নীতি ও দর্শনতত্ত্ব প্রভৃতি সন্নিবেশিত।
এই গ্রন্থের মূল কাহিনি কুরুপাণ্ডবের জ্ঞাতিবিরোধ ও বিরাট রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। মূল কাহিনির সঙ্গে নানা উপকাহিনি সংশ্লিষ্ট। এই কাব্যের নায়ক ভগবান শ্রীকৃয়। তাঁরই নির্দেশ পরামর্শে বিপুল রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। অবশ্য পঞ্চপাণ্ডবকে পাঁচখানি গ্রাম মাত্র দিয়ে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রচণ্ড অভিমানী ও দাম্ভিক দুর্যোধন বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী দিতে অস্বীকৃত হওয়ায় আঠারো
মহাভারতের আদর্শ দিন ব্যাপী যুদ্ধে কৌরবপক্ষের প্রায় সকলেই নিহত হন। বিজয়ী হন পঞ্চপাণ্ডব। কিন্তু এই ভয়ংকর যুদ্ধের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি দেখে রাজ্যভোগে যুধিষ্ঠিরের বিতৃয়া জাগে এবং তিনি দ্রৌপদীসহ ভায়েদের নিয়ে পরমার্থের সন্ধানে স্বর্গারোহণে যাত্রা করেন। যা হোক, নানা কাহিনির মধ্যে মহাভারতে সেকালের সমাজ, ইতিহাস, রাজতন্ত্র ও মানবচরিত্রের বিবিধ পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। আর এই সবকিছুর মধ্যেই মানুষের জীবন সাধনার চিরায়ত আদর্শ পরিস্ফুট। তাই বলা হয়- ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে’। অর্থাৎ মহাভারতে যা নেই, তা ভারতবর্ষের জনজীবনেও নেই। এককথায় মহাভারতের আদর্শ অনুযায়ী ভারতীয় জীবনধারা প্রবহমান। মহাভারত ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনেরই ছন্দোসংগীত-একটা ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে পাঠান সুলতান হোসেন শাহের রাজত্বকাল ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত। তিনি হাবশি দৌরাত্ম্য থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা পটভূমি করেন। শাসক ও সামরিক নৃপতি হিসাবে তাঁর বিশেষ পারদর্শিতা ছিল।
সর্বোপরি তিনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সংস্কৃতির অনুরাগী। তাঁর দরবারে হিন্দু কর্মচারীরা যথাযোগ্য মর্যাদায় নিযুক্ত হন। তাঁর উৎসাহে অভিজ্ঞ কবিরা সংস্কৃত মহাভারতের অণুবাদ কর্মে ব্রতী হন।
মহাভারতের বাংলা অনুবাদের ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আপামর বাঙালি জনসাধারণের নিবিড় যোগ সাধিত হয়েছে। এতে বাঙালির জীবনচর্যায় মহাভারতীয় আদর্শ যেমন বিশেষভাবে প্রভাবিত-তেমনি বাংলা সাহিত্যের ধারায় অনুবাদকর্ম বাংলাভাষাকে যথেষ্ট শক্তি দিয়েছে, পরিপুষ্টি দান করেছে, বাংলাসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
- কবীন্দ্র পরমেশ্বর
বাংলা ভাষায় সংস্কৃত মহাভারতের আদি অনুবাদক হিসাবে গৌরবের অধিকারী কবীন্দ্র পরমেশ্বর। এই গ্রন্থ রচনার সময়ে বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন স্বনামখ্যাত হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)। এই মুসলমান নৃপতি বাংলা সাহিত্যের প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন। হোসেন শাহের প্রধান সেনাপতি (লস্কর) পরাগল খাঁ চট্টগ্রাম অভিযানে প্রেরিত হন। তিনি চট্টগ্রামকে হোসেন শাহের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে তিনি অন্যান্য কার্যে মনোনিবেশ করেন।
হোসেন শাহের মতো বিদ্যোৎসাহী ছিলেন পরাগল। মুসলমান তুর্কি হলেও হিন্দুর সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। পরাগল খাঁর সভাপতি ছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর। কবীন্দ্র হচ্ছে পরমেশ্বরের উপাধি। সম্ভবত এই উপাধি পরাগল খাঁ-ই দিয়ে থাকবেন। পরাগল খাঁর নির্দেশেই পরমেশ্বর মহাভারতের অনুবাদ করেন। অনুমান করা যেতে পারে যে, মহাভারতে বিবদমান রাজশক্তির যুদ্ধবিগ্রহ, ব্যুহনির্মাণ, সৈনাপত্যকৌশল, কূট ষড়যন্ত্র ও মানবিক ঘাতপ্রতিঘাত তুর্কি শাসককে অকৃষ্ট করে। মহাভারতের আনুপূর্বিক ঘটনা সংক্ষেপে শোনার জন্য পরমেশ্বরকে নির্দেশ দেন অত্যন্ত সংক্ষেপে অনুবাদ করতে, যাতে তিনি একদিনের মধ্যেই সমগ্র মহাভারত শুনতে পারেন। বোধহয় শাসনকার্যে অতিশয় ব্যস্ত পরাগল খাঁর বিস্তৃত মহাভারত কাহিনি শোনার অবসর ছিল না। যাইহোক, নির্দেশমতো পরমেশ্বর অতি সংক্ষেপে মহাভারতের মূল ঘটনা বিবৃত করেন। পরাগল খাঁ নির্দেশে মহাভারত পাঁচালি রচিত হয়েছিল বলে পরমেশ্বরের অনুবাদ ‘পরাগলী মহাভারত’ নামে পরিচিত। আসলে গ্রন্থটির নাম ‘পাণ্ডববিজয়।’
ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে তাঁর রচনা সমাপ্ত হয়। কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাঁর মহাভারতে হোসেন শাহকে কৃয়ের অবতার বলে বর্ণনা করেছেন- ‘কলিকালে হল যেন কৃষ্ণ অবতার।’ মহাভারতের মূল কাহিনি অনুসরণে পরমেশ্বরের গ্রন্থ অতি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। তত্ত্বকথা মুসলমান সেনাপতির মনোরঞ্জন করতে পারবে না ভেবে পরমেশ্বর শুধু কাহিনিটি অনুসরণ করেছেন। প্রতিভার বিশেষ কোনো নিদর্শন নেই। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে পরমেশ্বরের গুরুত্ব স্বীকার্য। পরমেশ্বর মহাভারতের আদি অনুবাদক। তাঁর রচনা অকিঞ্চিৎকর হলেও মহাভারত অনুবাদের প্রাথমিক দিগ্দর্শনি। তাছাড়া সুদূর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসে পরমেশ্বর পূর্বসূরিদের কোনো আদর্শ পাননি। পথিকৃৎ হিসাবে তিনি নিজ ক্ষমতাবলে ভাষাপথ তৈরি করে মহাভারতের কাহিনিকে পয়ার ত্রিপদী ছন্দবন্ধে গ্রথিত করলেন। রাজসভার কবি হয়েও পরমেশ্বর কাব্যে নাগরিক বৈদগ্ধ্য ও চমক সৃষ্টির দিকে নজর দেননি। কাব্যে ফারসি শব্দের ব্যবহারও নেই। মূলানুগ তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। এদিক দিয়ে তার সংক্ষিপ্ত রচনা প্রশংসার যোগ্য।
কবীন্দ্রের রচনা শিল্পগুণসমৃদ্ধ না হলেও প্রাঞ্জল ও অলংকৃত, সাবলীল ও সুখপাঠ্য। শ্রীকৃষ্ণের রূপবর্ণনাত্মক একটি দৃষ্টান্ত এই-‘পরিধান পীতবাস কুসুম বসন।নর মেঘ শ্যাম অঙ্গ কমললোচন।। মেঘের বিদ্যুৎ তুল্য হসিত মুখেতে। শংখচক্রগদাপদ্ম এ চারি করেতে।।’ আখ্যান বর্ণনায় নাটকীয়তা ও চিত্ররূপ সৃষ্টি কবীন্দ্রের রচনার লক্ষণীয় বিষয়। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচনার সুযোগ পাননি বলে কবিপ্রতিভার সম্যক পরিচয় এই কাব্যে নেই।
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন ‘সঞ্জয়’ নামে এক কবিকে মহাভারতের প্রথম অনুবাদক বলেছেন। ড. সুকুমার সেন উত্ত সঞ্জয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। তাঁর মতে সঞ্জয় কোনো অনুবাদকের নাম নয়। সঞ্জয় ভারত অর্থে সংস্কৃত বৈশম্পায়ন ভারত। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন কথিত সঞ্জয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পাওয়ার জন্য কবীন্দ্রই মহাভারতের প্রথম অনুবাদক হিসাবে স্বীকৃত।
শ্রীকর নন্দী
কবীন্দ্র পরমেশ্বরের সমসাময়িক ও চট্টগ্রামের অধিবাসী শ্রীকর নন্দী বা শ্রীকরণ নন্দী ভূমিকা মহাভারতের দ্বিতীয় অনুবাদক। তিনি জৈমিনী ঋষি রচিত মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের বাংলা অনুবাদ করেন। তখন পরাগল খাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ বা ছোটো খাঁ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা।
ছুটি খাঁ পিতার মতো সুদক্ষ শাসক, বিদ্যোৎসাহী ও কাব্যানুরাগী ছিলেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি সভাকবি শ্রীকর নন্দীকে মহাভারত অনুবাদ করতে অনুরোধ করেন। যুদ্ধবিগ্রহপূর্ণ বীররসের কাহিনি মুসলমান সেনাপতির মনোরঞ্জন করতে সমর্থ হবে। এই ভেবে কবি জৈমিনী মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব অনুবাদ করেন। ছুটি খাঁর নির্দেশে রচিত বলে শ্রীকরের অনূদিত গ্রন্থকে ‘ছুটিখানি মহাভারত’ বলা হয়। শ্রীকর নন্দী যখন মহাভারতের অনুবাদ করেন, তখন গৌড়েশ্বর ছিলেন হোসেন শাহের পুত্র নুসরৎ শাহ (১৫১৯- ১৫৩২)। সুতরাং বলা যেতে পারে তিনি ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অশ্বমেধপর্ব অনুবাদ করেন। জৈমিনী মহাভারতের প্রসঙ্গে শ্রীকর নন্দী লিখেছেন- ‘শুনিব ভারত-পোথা অতি পুণ্য
কথা।/মহামুনি জৈমিনীর পুরাণ-সংহিতা।। অশ্বমেধ কথা শুনি প্রসন্ন হৃদয়। সভাখন্ডে আদেশিল খান মহাশয়।।’ শ্রীকর নন্দীর অনুবাদ বিশেষত মূলানুগ, যদিও কিছুটা সংক্ষিপ্ত। যৌবনাশ্ব, অনুশাল্ব, নীলধ্বজ,
কাব্য-বৈশিষ্ট্য
জনা, প্রমীলা, বহুবাহন, অম্লধ্বজ, চন্দ্রহাস, হংসধ্বজ, চণ্ডিকা, সুরথ প্রভৃতি উপাখ্যান কবি সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন।
শুধু অশ্বমেধ পর্ব রচনা করেছিলেন বলে শ্রীকর নন্দীর রচনায় স্বাধীনতার সুযোগ ঘটেছে। তাছাড়া পরমেশ্বর অপেক্ষা এঁর কবিত্ব শক্তি কিছু পরিমাণে বেশি ছিল। রচনাশক্তি সহজ ও পান্ডিত্যবর্জিত। শব্দযোজনায়ও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। রচনায় স্বভাবকবিসুলভ লঘুকৌতুক বা তরল চটুল হাস্যপরিহাস সৃষ্ট এবং ভাষার বক্রতা যথেষ্ট। এতে রচনার স্বাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য এই রঙ্গব্যঙ্গের আদর্শ জৈমিনী ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শ্রীকর নন্দী সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও রচনায় নিজস্বতার যথেষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার সঙ্গে ভীমের যাবার কথা উঠলে শ্রীকৃয় বললেন যে ভীমের মতো স্থূলোদর পেটুক লোককে গুরুত্বপূর্ণ কাজে পাঠানো সংগত নয়। তখন ভীম ক্রোধান্বিত হয়ে ব্যঙ্গের সুরে কৃয়কে জবাব দেন- ‘তোয়ার উদরে যত বৈসে ত্রিভুজবন। আত্মার উদরে কত অন্নব্যঞ্জন।। তুমি শূলোদর নহে, আমি স্কুলোদর!’
- কাশীরাম দাস
সপ্তদশ শতাব্দীতে মহাভারতের সর্বপেক্ষা বিখ্যাত ও সর্বশ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি কাশীরাম দাস। এই কবির মহাভারতের কাছে অন্যান্য অনুবাদগুলি নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। দুরুহ সংস্কৃত ভাষা থেকে মহাভারতের রসস্রোত বাংলা ভাষায় প্রবাহিত করে কাশীরাম দাস আপামর
ভূমিকা
বাঙালি জনসাধারণের অশেষ কল্যাণ সাধন করেছেন। বাঙালির জাতীয় জীবনে তাঁর মহাভারত অক্ষয় বটবৃক্ষের মতো চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কৃত্তিবাসি রামায়ণের মতো ধনীর রাজপ্রসাদ থেকে আরম্ভ করে দরিদ্রের পর্ণকুটির পর্যন্ত কাশীদাসি মহাভারতের সমান কদর।
কাশীরামকৃত আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, বর্তমানের ইন্দ্রাণী পরগনার সিঙ্গি বা সিদ্ধিগ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম কমলাকান্ত। জাতিতে কায়স্থ। তিনি মেদিনীপুর জেলার কাব্য-ভাবনা অসিগড়ের জমিদার বাড়িতে থেকে পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন। সেখানে কথক ও পণ্ডিতদের মহাভারতের গল্প শুনে কাশীরাম সমগ্র মহাভারত সরল প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। কাব্য রচনা শুরু হয় যোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং কবি আদি সভা, বন ও বিরাটপর্বের কিছুটা অনুবাদ করে লোকান্তরিত হন- ‘আদিসভা বন বিরাটের কতদূর। ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।’
কিন্তু সমগ্র মহাভারতটি কাশীরামের নামে সুপ্রচলিত। কবির পরিবারের সকলেই অল্পবিস্তর কবিপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন। পণ্ডিতদের মতে বাকি পর্বগুলি কবির তিরোধানের পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্র দুজনে কাব্যটি সমাপ্ত করেন। কাশীরাম দাসের মহাভারত ব্যাপক জনপ্রিয়তার ফলে বহুল প্রচারিত হয়েছিল। তাই মূল
রচনায় ভাষায় অনেক পরিবর্তন ও বিষয়বস্তুতে অনেক প্রক্ষেপ ঘটেছে। কাশীরাম সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাই তাঁর রচনা সংস্কৃত প্রভাবিত। অর্থাৎ অনেক তৎসম শব্দ কবি ব্যবহার করেছেন। সমগ্র মহাভারত সাবলীল গতি হারায়নি। কারণ কাশীদাসি মহাভারত হুবহু আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুসারী অনুবাদ। এতে নানা পুরাণ, উপপুরাণের আখ্যান স্থান পেয়েছে। কবিকল্পনার মৌলিকতাও যথেষ্ট। কায়স্থ পরিবার বংশানুক্রমে বৈয়বধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। চৈতন্যোত্তর যুগের প্রেমভক্তিরস কবিজীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। অর্জুনের রূপসৌন্দর্য বর্ণনায় এই বীর নায়ক তাই নবঘন কান্তি শ্যামের মোহনমুরতিতে রূপান্তরিত- ‘অনুপম তনুশ্যাম নীলোৎপল আভা। /মুখবুচি কত শুচি করিয়াছে শোভা।।’ কাশীরামের মহাভারত ঘটনাবিন্যাসে, নাটকীয়তায়, সরস উক্তি প্রত্যুক্তিতেও হাস্যরস পরিবেশনে চিত্তাকর্ষী। সর্বোপরি ব্যাসদেবের কাহিনিতে কাশীরাম লোকশিক্ষার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক আদর্শকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
কাশীদাসি মহাভারতের চরিত্রগুলি বাঙালির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, জীবনচর্যা ও ধ্যানধারণায় বাঙালির সমধর্মী। শিল্পরীতিতে কাশীরাম দাসের প্রতিভার মৌলিকতার স্বাক্ষর মেলে। কৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনায় ক্লাসিক সমুন্নতি সাধিত হয়েছে সংস্কৃত শব্দের দ্যোতনায়- ‘সহস্রমন্তক শোভে
সহস্র নয়ন। সহস্র মুকুট মণি কিরীটি ভূষণ।।’
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় অর্জুনের লক্ষ্যভেদের যোগ্যতা বোঝাতে গিয়ে কবি অর্জুনের ক্ষাত্রজনোচিত চরিত্রধর্ম ও শারীরিক সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য অনুপম ভাষায়, অনুপ্রাসের ঝংকারে ও বিবিধ অলংকারের সৌন্দর্যে এক বর্ণদীপ্ত ভাবগাম্ভীর্যের শিল্পমূর্তি গঠন করেছেন।- “দেব দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মুরতি। পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি।।/ অনুপম তনুশ্যাম নীলোৎপল আভা। মুখ বুচি কত শুচি করিয়াছে শোভা। । দেখ চারু যুগ্মভুরু ললাট-প্রসর।কি আনন্দ গতি বন্দ মত্ত কবিবর।। মহাবীর্য যেন সূর্য জলদে আবৃত।।/অগ্নিঅংশু যেন পাংশু জালে আচ্ছাদিত।”
কাশীদাসি মহাভারতে কৃত্তিবাসি রামায়ণের মতো বাঙালিয়ানা নেই। কিন্তু এর মূল্য আলাদা। এই গ্রন্থ কেবল সংস্কৃত না-জানা বাঙালির রসপিপাসা চরিতার্থ করেনি, মানবজীবনের
সমুচ্চ আদর্শে কাশীরাম দাস বাঙালির মানস-প্রকৃতিকে সুগঠিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। গল্পরস পরিবেশনের সঙ্গে কবি সামাজিক ও পারিবারিক আদর্শ, ধর্মপ্রাণতা, নৈতিকতা ও ঈশ্বরভক্তির আদর্শ প্রচারে সচেষ্ট হয়েছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে অতিথিসেবা, জীবে দয়া, পরোপকারিতা ও স্বার্থত্যাগের মহিমা প্রচার করে উদার উন্নত মানবধর্মে কবি বাঙালিকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিপুল শক্তি ও অনুপ্রেরণা জোগায়।
কঠিন সাধনায় কাশীরাম দাস অমৃতসমান মহাভারতের বাণীকে বাঙালির হৃদয়দ্বারে পৌঁছে দিয়েছেন। মহাভারতের অমৃতবাণী বুকে ভরে বাঙালি জীবনের রাঙামাটির পথ দিয়ে অমৃতলোকে যাওয়ার জন অগ্রসর হয়। বাঙালি জনসাধারণের জীবনের ‘গীতা’ কাশীদাসি মহাভারত। বাঙালির জীবনে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রিক ও সামাজিক দিক থেকে কত পরিবর্তন হয়ে গেল। সভ্যতার রূপ বদল হচ্ছে অনবরত। কিন্তু কাশীরামের মহাভারতের কাব্যরসধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার ন্যায় বাঙালির অন্তর্জীবনে কুলুকুলু নাদে প্রবাহিত। বাংলাদেশের হৃদয় থেকেই কাশীরাম দাসের কাব্যের উদ্ভব। মধুসূদন যথার্থই বলেছেন যে কাশীরাম- ‘ভারত রসের স্রোত আনিয়াছ তুমি। জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে।’ আর বাঙালি জাতিকে মহাভারতের অমৃতবাণী প্রদানের জন্য-‘হে কাশী কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান্।’
অনুশীলনী
১। বাংলা রামায়ণের আদি কবি কে? কবির পরিচয় ও কাব্য রচনাকাল সম্পর্কে যেসব উল্লেখ ওই রামায়ণকাব্যে রয়েছে তা বিবৃত করো। বাঙালি জীবনে এ-কাব্যের প্রভাব কতখানি তা নির্ণয় করো।
(উ. মা. ১৯৮০)
২। কৃত্তিবাস কার লেখা কোন্ কাব্যের অনুবাদ করেছিলেন? কৃত্তিবাসের ব্যক্তিগত পরিচয় সংক্ষেপে লেখো। তাঁর কাব্যের জনপ্রিয়তার কারণ কী, সংক্ষেপে বলো। (উ. মা. ১৯৮২)
৩। ভাগবত পুরাণের প্রথম বাংলা অনুবাদ কে করেছিলেন তা উল্লেখ করো। তাঁর জীবন ও কাব্য সম্বন্ধে যা জানো লেখো।
(উ. মা. ১৯৭৯)
৪। টীকা লেখো: কৃত্তিবাসের আত্মজীবনী (উ. মা. ১৯৮৩)। কৃত্তিবাসি রামায়ণ (ত্রিপুরা, ১৯৮২,
‘৮৫)। মালাধর বসু (উ. মা. ১৯৭৮, ‘৭৯, ‘৮৬)। শ্রীকৃয়বিজয় (উ. মা. ১৯৮২)।
৫। কবি কৃত্তিবাস কোন ভাষায় রচিত, কোন্ কবির কাব্য অনুসরণে তাঁর কাব্যটি রচনা করেন? কৃত্তিবাসের কাব্যের নাম কী? কবির আত্মবিবরণী থেকে তাঁর জন্মকাল সম্পর্কে কোনো ধারণা করা যায় কি? বাঙালি পাঠকের কাছে তাঁর কাব্যের জনপ্রিয়তার কারণ কী, বুঝিয়ে দাও।
৬। কবি কৃত্তিবাস কোন্ সময়ে কাব্য রচনা করেন? তাঁর জীবনী সংক্ষেপে লেখো। তাঁর কাব্যের নাম কী? তিনি কোন্ ভাষায় কাব্য অনুসরণ করে এই কাব্যটি রচনা করেছেন? কৃত্তিবাসের কাব্যের জনপ্রিয়তার
কারণ কী? (উ. মা. ১৯৯৭)
৭। বাংলা রামায়ণের আদি কবি কে? ওই কবির ব্যক্তিগত পরিচয় সংক্ষেপে লেখো। তাঁর কাব্যের জনপ্রিয়তার কারণগুলি আলোচনা করো।
(উ. মা. ২০০০)
৮। কবি কৃত্তিবাসের ব্যক্তি-জীবনের পরিচয় দাও। তাঁর রচিত রামায়ণের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করো।
৯। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের পরিচয় দিয়ে তাঁর কাব্য আলোচনা করো।
১০। শ্রীকর নন্দীর মহাভারতের নাম কী? এই কাব্য রচনার পিছনে পটভূমি কী ছিল? এই কাব্যের বৈশিষ্ট্য কী?
১১। মহাভারতের অনুবাদের পিছনে চট্টগ্রামের শাসনকর্তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল-আলোচনা করো।
১২। বাংলা মহাভারতের সর্বপ্রধান রচয়িতা কে? তিনি কোন কোন কবির অনুসরণে তাঁর কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন? তাঁর কাব্য কোন সময়ে রচিত হয়? কবির জীবন সম্পর্কে যা জানো লেখো। তাঁর কাব্যের মূল বৈশিষ্ট্যটি সংক্ষেপে বিচার করো।
(উ. মা. ১৯৯৪)
১৩। বাংলা মহাভারত কে কবে কার উৎসাহে অনুবাদ করেন? যিনি মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক, তাঁর জীবন ও কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
(উ. মা. ১৯৯৪)
১৪। বাংলায় মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? তাঁর কাব্যের নাম কী? তিনি কোন্ সময়ে কাব্য রচনা
করেন? তাঁর জীবনী সংক্ষেপে লেখো ও তার কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও। (উ. মা. ১৯৯৮)
১৫। কবি কাশীরাম দাসের জীবন ও তাঁর কাব্য সম্বন্দ্বে যা জানো লেখো।
(উ. মা. ২০০১)
১৬। কাশীরাম দাস ও তাঁর কাব্য সম্পর্কে যা যা তুমি জানো, বিস্তৃতভাবে লেখো। (উ. মা. ২০০৩)