১. সাধারণ আলোচনা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
মধ্যযুগের ধর্মীয় প্রথানুবর্তী কাহিনি কাব্যের মধ্যে চৈতন্যজীবনীমূলক গ্রন্থগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতীয় সাহিত্যে আগে সংস্কৃত রাজরাজড়াদের স্তাবকতাধর্মী জীবনীসাহিত্য কিছু রচিত হয়েছে। সেইসব গ্রন্থে আর্থসামাজিক জীবনের পরিচয়ও, মেলে। কিন্তু রাজকীয় মহিমার গুণগান করতে গিয়ে কবিরা সাধারণ মানুষের দিকে ফিরে তাকাননি। বিশুদ্ধ মানবিক চেতনা থেকে তখন জীবনীসাহিত্য রচনা করার প্রবণতা কবিদের ছিল না। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভঙ্গ করল চৈতন্যজীবনীসাহিত্য। আমার তে
প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ রচিত হয়। মুরারি গুপ্তের শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যচরিতামৃত, কবিকর্ণপুরের মহাকাব্য চৈতন্যচরিতামৃত ও নাটক চৈতন্যন্দ্রোদয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর বাংলাভাষায় চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ রচনা করেন কবি বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ, লোচন দাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখ কবি। মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের দিব্যভাবসমৃদ্ধ অলৌকিক জীবন নতুন ধরনের সাহিত্যসৃষ্টিতে বিপুল প্রেরণা দিয়েছে। শ্রীচৈতন্য রক্তমাংসের মানুষ হলেও তাঁর বিরাট চারিত্রশক্তি ও সমুচ্চ প্রেমধর্মের আদর্শ প্রবক্তার জন্য জীবিতকালে ভক্তগণ কর্তৃক অবতাররূপে পূজিত হয়েছেন। ভক্তরা ‘রাধা- ভাবদ্যুতি সুবলিত তনু কৃষ্ণ স্বরূপম’ রূপে শ্রীচৈতন্যকে দেখেছেন। ফলে আমাদের পরিচিত এই সংসারের রক্তমাংসের মানুষের মধ্যে অমর্ত্যলীলামাধুরী প্রত্যক্ষ করে একান্ত অভিভূত হল আপামর জনসাধারণ। আকাশ থেকে তাদের দৃষ্টি ঘরের ছেলের দিকে। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্যের ইতিহাসে জীবনবোধের দিকে পরিবর্তন সূচিত করল। কল্পিত কোনো
দেবদেবী নয়-এবার মানুষই হল দেবপদবাচ্য। মানুষের চরিত্র মহিমা কাব্যে কীর্তিত হল। ঐতিহাসিক ব্যক্তিমানুষ শ্রীচৈতন্যকে কাব্যের অন্তর্ভুক্ত চরিত্র-সাহিত্যের
করা হল। এ এক অভিনব বস্তু। কারণ, ব্যক্তির মহিমা তখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের যুগ তখনও আসেনি। অবশ্য চৈতন্যজীবনীসাহিত্য পুরোপুরি আধুনিক লক্ষণাক্রান্ত জীবনীসাহিত্য নয়। কবিরা মহাপ্রভুর মর্ত্যজীবনকথাকে আন্তরিকভাবে অনুসরণ করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর ফাঁকে ফাঁকে অতিপ্রাকৃত ঘটনার সন্নিবেশ অলৌকিকতার স্পর্শে ও ভক্তির আতিশয্যে মানবজীবনের স্বরূপ মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে গেছে। কিন্তু চৈতন্যজীবনের নানা প্রসঙ্গ বর্ণনায় মানবধর্মের বলিষ্ঠ স্বীকৃতিতে চৈতন্যভক্ত কবিরা বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতার পথে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন। চৈতন্যজীবনী-সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যদেবের
পূর্বপুরুষদের শ্রীহট্ট ছেড়ে বাংলার নবদ্বীপ আগমন, শ্রীচৈতন্যের জন্ম, বাল্যলীলা ও বিবাহ, শ্রীচৈতন্যপার্ষদদের জীবনকথা, হিন্দুসমাজের অবস্থা, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, বৈশ্বব সমাজের ইতিহাস, প্রচার ও মৃত্যুকাহিনি স্থান পেয়েছে। কিছুটা অলৌকিকতা ও অতিরঞ্জন দোষ থাকলেও ইতিহাস, দর্শন ও কাব্যরসের অপূর্ব সমন্বয়ে চৈতন্যচরিতসাহিত্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। বাংলায় বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ মিশ্র, লোচন দাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যজীবনীকাব্য রচনা করেন। আমরা নীচে দুটি জীবনীকাব্যের আলোচনা করেছি।
২. কবি বৃন্দাবনদাস
বৃন্দাবনদাস বাংলা ভাষায় প্রথম চৈতন্য জীবনীবিষয়ক কাব্য রচনার পথিকৃৎ। পরবর্তী কবিরা বৃন্দাবনদাসের চৈতন্য ভাগবতের কথা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। বৃন্দাবনদাস নবদ্বীপের শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী নারায়ণী দেবীর পুত্র ছিলেন। গ্রন্থমধ্যে আত্মপরিচয় না ভূমিকা থাকায় বৃন্দাবনদাসের জীবনতথ্য সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ বর্তমান। কবির পিতার নাম জানা যায়নি। জন্ম সম্পর্কেও নানা গালগল্প প্রচলিত। গবেষকদের মতে আনুমানিক ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে কবির জন্ম। ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যভাগবত রচিত হয়। সে যা হোক, মহাপ্রভুর সাক্ষাৎলাভের সৌভাগ্য বৃন্দাবনদাসের ঘটেনি। সম্ভবত মহাপ্রভুর নীলাচল বাসকালে কবির জন্ম হয়। কবি তাই আপেক্ষ করে বলেছেন- ‘হইল পাপিষ্ঠ জন্ম নহিল তখনে।/ হইয়াও বঞ্চিত সে মুখ দরশনে।।’
কবির নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার দেনুড় গ্রামে। কবি চিরকুমার ছিলেন। সম্ভবত বর্ধমানে থেকেই তিনি এই সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক কাব্যটি রচনা করেন। কাব্য রচনার সময় মহাপ্রভুর পারিষদগণের মধ্যে অনেকে জীবিত ছিলেন। চৈতন্যজীবনের অনেক উপকরণ তিনি তাঁদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে কৃষ্ণলীলার সমধর্মী বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যলীলা। কাব্য পরিচয় কবি মহাপ্রভুকে কৃষ্মের অবতার রূপেই বর্ণনা করেছেন। মহাপ্রভুর লীলাপ্রচারের উদ্দেশ্যে বইটি লিখিত বলে এতে কিছু অলৌকিক কাহিনি স্থান পেয়েছে। অনেকের মতে পূর্বে এই গ্রন্থের নাম ছিল ‘চৈতন্যমঙ্গল’। ভাগবতের অনুসরণে লেখা বলে বৃন্দাবনের গোস্বামীরা এর নাম দেন চৈতন্যভাগবত। বাংলায় বৈশ্বব সমাজে এই চৈতন্যভাগবত অধিকতর জনপ্রিয় কাব্য। প্রাঞ্জল ভাষায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও ভক্তিভাবুকতার সঙ্গে গ্রন্থটি লিখিত। প্রসাদগুণে ও কবিত্বের স্পর্শে চৈতন্যভাগবত এক সুললিত সুপাঠ্য গ্রন্থ। বৈশ্বব ভক্তগণ বৃন্দাবনদাসকে চৈতন্যলীলার ব্যাস আখ্যা দেন।
চৈতন্যভাগবত আদি, মধ্য ও অন্ত্য খণ্ডে বিভক্ত। আদি খণ্ডে পনেরোটি অধ্যায়ে চৈতন্যের জন্ম, বাল্যলীলা, বিবাহ, বিদ্যাশিক্ষা, পিতৃপিণ্ড দানের জন্য গয়াগমন, ঈশ্বরপুরীর নিকট দীক্ষালাভ ও স্বদেশে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত ঘটনা বিবৃত। মধ্যখন্ডের ছাব্বিশটি অধ্যায়ে
নবদ্বীপে হরিনাম সংকীর্তনে বিভোর বিহ্বল লীলাবৈচিত্র্য, কাজি দলন ও সন্ন্যাস গ্রহণের বর্ণনা রয়েছে। অন্ত্যখন্ডের দশটি অধ্যায়ে নীলাচল বাসের কাহিনি মুখ্যত স্থান পেয়েছে। শ্রীচৈতন্যের অন্তিম পর্যায়ের জীবনকাহিনি এর মধ্যে খুবই অসম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত ও অসংলগ্ন। সে যা হোক, আগেই বলা হয়েছে বৃন্দাবনদাস চৈতন্যলীলার প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা নন। সুতরাং তাঁর কাব্যের উৎস সমকালীন রচিত গ্রন্থাদি ও বিশেষ করে চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত আচার্য কথিত কাহিনি। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস যেমন মহাভারতের আদিকবি- তেমনি বৃন্দাবনদাস বাংলা ভাষায় চৈতন্যজীবনীগ্রন্থের আদি ও অন্যতম কবি। কাহিনি গ্রন্থন, রচনা-সৌকর্য, তথ্যপরিবেশন, কবিত্ব, দর্শন ও ইতিহাসের সমন্বয়ে তাঁর কাব্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণের পৌরাণিক মহিমার ভাগবতী চরিত্রধর্মের সাদৃশ্যে বৃন্দাবনদাস মহাপ্রভুকে কলিযুগে পৃথিবীর পাপ মোচনের জন্য অবতীর্ণ নারায়ণের নবরূপী অবতার রূপেই প্রত্যক্ষ করেছেন। ফলে তাঁর কবিদৃষ্টিতে এই মহাপুরুষ মানবিকতা অধ্যাত্মিকতার যুগ্ম আদর্শের জীবন্ত বিগ্রহে পরিণত। তাই বৃন্দাবনের কাব্যে ভক্তিরসের সঙ্গে সঙ্গে জীবনরসের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ঘটেছে। এছাড়া বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ সমাজচেতনার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। এতে বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও লৌকিক ইতিহাসের আলেখ্য চিত্রিত। নবদ্বীপের সমৃদ্ধি, বিদ্যাচর্চা, অন্ধ সংস্কার, নানা জাতি ও পেশার লোক, লোকাচার, ধর্মাচার, আমোদপ্রমোদ, উৎসব-অনুষ্ঠান, খাদ্য, অলংকার, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও মুসলমান শাসকবৃন্দ কর্তৃক হিন্দু উৎপীড়নের কথা ইত্যাদির উল্লেখে তিনি সমকালীন বাংলার অনেক নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন। তবে তিনি দুঃখিত যে নবদ্বীপবাসী কুসংস্কার লোকাচার ধর্মাচারের আড়ম্বরে জীবনের সত্যস্বরূপের চর্চা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। তাঁরা মনসাপুজো, বাশুলিপুজো ও যক্ষপুজো করে মদ্য মাংস নানা উপচারে। রাতভর মঙ্গলচণ্ডীর গীত চলে। কারও বাড়িতে কৃষ্ণপুজো হয় না। সবাই ভক্তিধর্ম বিবর্জিত। পা
মুসলমানরা, চৈতন্য আবির্ভাবে সমাজব্যবস্থায় যে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়, তাকে সর্বশক্তি দিয়ে চিহ্নিত করতে বদ্ধপরিকর হয়। অন্যদিকে বৈশ্বব-বিদ্বেষী মুসলমানদের অত্যাচার, নিষ্পেষণ ও লুণ্ঠন প্রাধান্য পায়। কাজী সাহেবের প্রাসঙ্গিক উক্তি বৃন্দাবনদাস উল্লেখ করেছেন- ‘মোরে লঙ্ঘি হিন্দুয়ানি করে। তবে জাতি নিমু আজি সবার নগরে।।’ অবৈশ্বব সম্প্রদায়ও শ্রীচৈতন্যের উপর দারুণ ক্রুদ্ধ হন- ‘শ্রীবাস বামনায় এই নদীয়া হৈতে/ঘর ভাঙ্গি কালি নিয়া ফেলাইমু স্রোতে। ২১২রা রনিকা সারাও চল
বৃন্দাবনদাস সমকালীন হিন্দুর বর্ণবৈষম্য ও মুসলমান রাজন্যবর্গের নিষ্ঠুরতা নিপুণভাবে তুলে ধরে ইতিহাস-নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। এসবের ঊর্ধ্বে ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থটিকে বৃন্দাবনদাস ভাগবতী মাহাত্ম্যে উন্নীত করেছেন। চৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ দুজনে কৃষ্ণ ও বলরামের অবতার রূপেই চিত্রিত। চৈতন্যভাগবতের সর্বত্র শ্রীচৈতন্যের ভুবনমনমোহিনী রূপমাধুর্য উচ্ছলিত। প্রগাঢ় ভক্তিভাবুকতা সহজ কবিত্ব গ্রন্থটিকে পরম আস্বাদের বস্তু করে তুলেছে। তাই কৃন্মদাস কবিরাজ লিখেছেন- ‘চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবনদাস।’ তা সত্ত্বেও এই মূল্যবান গ্রন্থটি
অল্পস্বল্প ত্রুটিযুক্ত। প্রথমত এই গ্রন্থ অসম্পূর্ণ, ঘটনার ক্রম সর্বত্র রক্ষিত হয়নি। অলৌকিক ঘটনার প্রচুর সমাবেশ ঘটায় বাস্তবতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বিশেষ করে বৌদ্ধবিদ্বেষ পীড়াদায়ক এই সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি বাদ দিলে উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও ছন্দের ললিত প্রয়োগে এবং গীতিকাব্যের সুরমাধুর্যে চৈতন্যভাগবত একটি উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ। সর্বোপরি ষোড়শ শতাব্দীর সমাজজীবন ও বৈশ্বব সম্প্রদায়ের নানাবিধ তথ্যের সমাবেশে কাব্যটির মূল্য অপরিসীম।
৩. কৃষ্ণদাস কবিরাজ
কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম চৈতন্যচরিতামৃত। সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের মতো অগাধ মনীষাসম্পন্ন বিরাট প্রতিভাশালী কবিব্যক্তিত্ব বিরল। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কবি কৃষ্ণদাস। ভূমিকা পাণ্ডিত্য ও মনীষীর দিক থেকে দর্শনশাস্ত্রে তাঁর যে বিপুল পরিমাণে অধিকার ছিল তা সুবিস্তৃত হয়ে আছে চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে। চৈতন্যজীবনকে অবলম্বন করে গৌড়ীয় বৈশ্বব দর্শনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন কৃষ্ণদাস। সমগ্র গৌড়ীয় বৈশ্ববদর্শনের অন্যতম প্রবক্তা হিসাবে বাংলা সাহিত্যে তিনি অমরত্ব অর্জন করেছেন। বাংলা, উড়িষ্যা ও বৃন্দাবনের ভক্তিধর্ম ও দার্শনিক মতাদর্শকে কবি গভীর নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম দিয়ে যথাসাধ্য কাব্যকৌলীন্য দান করেছেন।
কবির আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়-বর্ধমান জেলার কাটোয়ায় নিকটবর্তী ঝামটপুর গ্রামে সুপ্রসিদ্ধ স্বচ্ছল বৈদ্যপরিবারে কবির জন্ম। পিতার নাম ভগীরথ, মাতা সুনন্দা দেবী। কবি ছিলেন নিত্যানন্দের শিষ্য। নিষ্ঠাবান বৈশ্ববভক্তের বাড়িতে মাঝে মাঝে সংকীর্তন হত। বাড়িতে কৃষ্ণমূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। একবার কীর্তনের আসরে নিমন্ত্রিত হলেন
আত্মপরিচয় নিত্যানন্দের শিষ্য মীনকেতন দাস। নিত্যানন্দশিষ্য মীনকেতনের সঙ্গে কৃষ্ণদাসের ভাই রামদাসের অভ্যর্থনা ব্যাপারে বচসা বাধে। এতে নিত্যানন্দশিষ্য কৃষ্ণদাস খুবই বেদনাবিদ্ধ হন এবং সেদিনকার রাত্রে নিত্যানন্দের স্বপ্নাদেশ পেয়ে প্রৌঢ় কবি বৃন্দাবনে চলে যান। বৃন্দাবনে বৈশ্বব গোস্বামীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভক্তিশাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন।
কৃষ্ণদাস কবিরাজের জন্মকাল ও গ্রন্থরচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক আছে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কোনো এক সময়ে কবির জন্ম হয় এবং ষোড়শ শতাব্দীর শেষপাদে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে তাঁর কাব্য রচনা সম্পূর্ণ হয়।
‘চৈতন্যচরিতামৃত’- কৃষ্ণদাস কবিরাজের তৃতীয় ও সর্বশেষ গ্রন্থ। এর আগে তিনি সংস্কৃতে দুখানি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রৌঢ় বয়সে কৃষ্ণদাস বৃন্দাবনে যান। বৈশ্ববাচার্যগণের নিকট শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করে যখন তিনি কাব্য রচনায় ব্যাপৃত হন, তখন
কবিকথা
বার্ধক্যে নানা রোগে শরীর জীর্ণ। তবুও কবির মন যে কত নবীন ও সতেজ ছিল তার জাজ্বল্যমান স্বাক্ষর রয়েছে চরিতামৃতে। চৈতন্যচরিতসাহিত্যের এটিই সম্পূরক ও পূর্ণাঙ্কা গ্রন্থ।
আদি, মধ্য ও অন্ত্য-এই তিনটি লীলাপর্বে গ্রন্থটি বিভক্ত। প্রত্যেকটি লীলা আবার কয়েকটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। আদিলীলায় বৈশ্ববীয় দর্শন, চৈতন্যাবতারের প্রয়োজনীয়তা, অদ্বৈত নিত্যানন্দের সঙ্গে মহাপ্রভুর পরিচয়, শ্রীচৈতন্যের বাল্যলীলা কৈশোর ও সন্ন্যাস বর্ণিত। আদিলীলায় কৃষ্ণদাস ভক্তিনগ্রচিত্তে বৃন্দাবনদাসকে অনুসরণ করে আগের বিস্তৃত কাহিনি সংক্ষিপ্ত করেছেন। বৃন্দাবন যেখানে সংক্ষিপ্ত, কৃষ্ণদাসের হাতে তা কিছুটা বিস্তৃত। আদিলীলাই চৈতন্যচরিতামৃতের প্রধান অংশ। শ্রীমদ্ভাগবত, গীতা, ব্রহ্মসংহিতা প্রভৃতি নানা শাস্ত্র-সমুদ্রে ডুব দিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে গৌড়ীয় বৈঘ্নবধর্মের প্রতিষ্ঠাভূমি তৈরি করলেন এবং জোর দিয়ে বললেন- ‘কৃষ্ণ ভজনে নাই জাতি-কুলাদি বিচার’।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যদর্শন বর্ণনা করার সঙ্গে সঙ্গে সমকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার সামগ্রিক একটা আলেখ্য চিত্রিত করেছেন। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সত্ত্বেও তখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের সূচনা হয়েছে। দর্জি জীবিকা মুসলমানদের একচেটিয়া ছিল। ব্রাহ্মণপন্ডিতরা মুসলমান দর্জির সাহায্য নিত। জিনিসপত্রের দাম বেশ সস্তা ছিল। বৈশ্ববদের খাদ্য ছিল নিরামিষ। নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হত। তবে শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে প্রবল বিরোধ ছিল। আ
মধ্যলীলায় আছে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর মহাপ্রভুর নীলাচলে অবস্থান পর্যন্ত ছয় বছরের জীবনকাহিনি। এর মধ্যে রাঢ়দেশ ভ্রমণ, নীলাচলে গমন, সার্বভৌমকে স্বমতে আনয়ন, দাক্ষিণাত্যে নানাতীর্থ পর্যটক, রায় রামানন্দের সঙ্গে সাধ্যসাধনতত্ত্ব আলোচনা, বৃন্দাবন যাত্রা, প্রয়াগে রূপ গোস্বামী ও বারাণসীতে সনাতন গোস্বামীকে ধর্মশিক্ষা প্রদান, রূপ গোস্বামীকে বৃন্দাবনে প্রেরণ ইত্যাদি ঘটনা লিপিবদ্ধ। অন্ত্যলীলায় শ্রীচৈতন্যের শেষ আঠারো বছরের জীবনের বিস্তৃত পরিচয় আছে। এই অংশে মহাপ্রভুর কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদ বাহ্যজ্ঞানহীন ঊর্ধ্বভাব বিভোর অবস্থার স্বরূপ ও কারণ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি। নীরস তত্ত্বদর্শনকে তিনি কবিতার অন্তর্ভুক্ত করে রসাশ্রিত করে তুলেছেন। কৃষ্ণদাসের কবিতায় গীতিমূর্ছনা নেই। কিন্তু গীতিমূর্ছনাই কবিত্বের একমাত্র মাপকাঠি নয়। দুরূহ, জটিল তত্ত্বকথা কৃষ্ণদাসের হাতে একান্ত সরল সহজ ও ঋজু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্ব, সাধ্যসাধনতত্ত্ব, রাগানুগাভক্তি, প্রেমবিলাস বির্বত, সখীসাধনা ও রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি জটিল ধর্মতত্ত্বকে কৃষ্ণদাস এক একটা উপমা, সুভাষিত শব্দচয়ন ও ছন্দের ব্যবহারে এবং ঋজু বর্ণনাগুণে সহজবোধ্য করে তুলেছেন। রাধাকৃষ্মতত্ত্বের বর্ণনায় অবিচ্ছেদ্য রাধাকৃষ্ণের যুগলতত্ত্বের স্বরূপ খুব সহজ সুন্দর হয়েছে। ‘রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ। লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ।।’
কাম ও প্রেমের পার্থক্য বিচারে- ‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা, তারে বলি কাম। কৃষ্মেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।’ জীব ও ঈশ্বরের পার্থক্য বুঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘অনন্ত স্ফটিক যৈছে এক সূর্য ভাসে/তেছে জীব গোবিন্দের অংশ পরকাশে।’
রাধাকে কবি মহাভাব স্বরূপিণী বলে জ্ঞানমার্গ ও ভক্তিমার্গের তুলনা করে বলেছেন যে- ‘অরসঙ্গ কাক চুষে জ্ঞান নিম্বফলে। রসজ্ঞ কোকিল চুষে প্রেমাম্রমুকুলে।।’ কৃষ্ণপ্রেমের স্বরূপ কবির বর্ণনায় খুবই প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। কবির গভীর ভক্তিভাবুকতার শান্ত অভিব্যক্তি ঘটেছে এখানে। কৃষ্ণপ্রেম সুখসিন্ধুর নির্মল বারি। তার এক বিন্দু জলে জগৎ প্লাবিত হয়ে যায়।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাপ্রভুর জীবনীকে অবলম্বন করে তাঁর জীবনের পবিত্র আদর্শ বা জীবনামৃত এককথায় চৈতন্য প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের সরল ব্যাখ্যাকে গণচেতনামুখী করতে প্রয়াসী হয়েছেন। এটাই তাঁর গ্রন্থের বড়ো তাৎপর্য, বৃন্দাবনের যড় গোস্বামী যে বৈশ্ববদর্শনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন, কৃষ্ণদাস তাকেই শিল্পমণ্ডিত ভাষায় এক সর্বগ্রাহ্য রূপ দেন। তাই জীবনী বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণদাস চৈতন্য প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের সরল ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হন। বাস্তবজীবনবোধ, ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি, দার্শনিক মননশীলতা, ভক্তিভাব, বিচারবুদ্ধি ও কবিত্বশক্তির সমন্বয়ে চৈতন্যচরিতামৃত অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যে দেদীপ্যমান। সরল সহজ ভাষায় শুধু তত্ত্ববিশ্লেষণ নয়, সঙ্গে সঙ্গে কবিকুশলতার চমৎকার নিদর্শন মেলে কৃষ্ণদাসের রচনায়। প্রকাশরীতির সারল্যে, উপমা, অনুপ্রাস প্রয়োগের যাথার্থ্যে ও সুভাষিত বাক্বিন্যাসে তাঁর রচনা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। যেমন-আপন মাধুর্যে হরে আপনার মন/আপনা আপনা চাহে করিতে আলিঙ্গন। (অনুপ্রাস)- ‘দীপ হৈতে যৈছে বহু দীপের জ্বলন/মূল এক দীপ তাহা করি যে গণন।। (সুভাষিত)।
যুগন্ধর মহাপুরুষ প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে যে গৌড়ীয় বৈষ্ণুব ধর্ম বঙ্গভূমিকে প্লাবিত করে দিকে দিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিপুরুষের জীবনসাধনায় যে আধ্যাত্মিকতার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটেছিল, – কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাকেই নয় বছরের অতন্দ্র সাধনায় সুবিস্তৃত ধর্মনৈতিক পটভূমিতে সামগ্রিক রূপদানে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেন। চৈতন্যচরিতামৃত নানাশাস্ত্রের সূত্রানুসরণে গৌড়ীয় বৈশ্ববদর্শনের রসভাষা। বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীরা-রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, জীব গোস্বামী, রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট ও গোপাল ভট্ট-চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্মতত্ত্ব ও সাধন পদ্ধতিতে সংস্কৃত ভাষায় যখন লিখে চলেছেন, সেই সময়ে কৃষ্ণদাস বাঙালি ছেলের আচরিত ধর্মতত্ত্বের স্বরূপ ও তাঁর মহিমাকে বাংলা ভাষায় সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করলেন। এটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
অনুশীলনী
১। বাংলায় রচিত জীবনীকাব্যের সূত্রপাত কখন কীভাবে ঘটেছিল?
২। শ্রীচৈতন্যের জীবন অবলম্বনে রচিত বাংলা জীবনীকাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
(উ.মা. ১৯৬১)
(উ.মা. ১৯৬৯)
৩। বাংলা ভাষায় রচিত প্রধান চৈতন্যজীবনীগ্রন্থগুলির উল্লেখ করে কোনখানিকে তুমি শ্রেষ্ঠ মনে করো তা কারণসহ লেখো।
(উ.মা. ১৯৮০)
৪। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যের রচয়িতার ব্যক্তিজীবনের পরিচয় দাও। এই কাব্যের বিষয়বস্তু বিচার করে কাব্যটির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করো।
৫। টীকা লেখো:’
চৈতন্যচরিতামৃত’ (উ.মা. ১৯৮৬, উ.মা. ১৯৮৪, ত্রিপুরা ১৯৮৫), বৃন্দাবন দাস (উঃমা. ১৯৮২), ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, চৈতন্য ভাগবত (উ.মা. ত্রিপুরা, ১৯৮২)।
৬। চৈতন্য-জীবনী কাব্যের ঐতিহাসিক মূল্য কতখানি? এই প্রসঙ্গে চৈতন্যভাগবত ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ দুটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
(উ.মা. ২০০২)
৭। বাংলা ভাষায় রচিত প্রধান দুটি চৈতন্যজীবনীকাব্যের নাম উল্লেখ করো। এদের মধ্যে কোন্টি শ্রেষ্ঠরূপে বিবেচিত হয়? এই কাব্যের কবি কে? তাঁর কাব্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।