দশম অধ্যায় – আরাকান রাজসভার কবিদের কাব্যচর্চার গুরুত্ব

১. সাধারণ আলোচনা

ব্রহ্মদেশের উত্তর-পূর্ব সীমানায় বাংলাদেশের পূর্বপ্রত্যন্ত রাজ্য আরাকান। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ থেকে সুদূর আরাকান রাজসভায় কয়েকজন মুসলমান কবি যে কয়েকটি বাংলা

ভূমিকা

কাব্য সৃষ্টি করেন তা ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এর পূর্বে বাংলা সাহিত্যে দেব-দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। বিশুদ্ধ মানবীয় প্রণয়ঘটিত ব্যাপার নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়নি। মধ্যযুগের সাহিত্য মানে ধর্মসাহিত্য।

সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবিরা দেবদেবীর মাহাত্ম্য-নিরপেক্ষ নরনারীর প্রণয় কাহিনি ও নীতিকথাকে উপজীব্য করে যথার্থ লৌকিক উপাখ্যানমূলক কাব্য রচনা করতে থাকেন।

তখন হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন ভাবচেতনা গড়ে ওঠে।

বাংলার পূর্ব উপকূলে চট্টগ্রাম বন্দরে নগরে আরবদেশীয় মুসলমানদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। অনেকেই বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করেন। আরাকানের মগ জাতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, তাঁদের রাজারাও ছিলেন মগজাতীয় বৌদ্ধ। তাঁদের উৎসাহে পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকজন মুসলমান কবি বাংলা কাব্য রচনা করেন।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিষয়বস্তুর নতুনত্বের জন্য আরাকানের মুসলিম কবিদের রচনা ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁদের রচনা বাংলা সাহিত্যের ধারায় নতুন ঐশ্বর্য সৃষ্টি করেছে।

ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত আমরা দেখি বাংলা সাহিত্যে দেবতার মাহাত্ম্য কিংবা

গুরুত্ব

দেবকল্প মানুষের জীবনকাহিনিই স্থান পেয়েছে। নানা ধর্মসম্প্রদায়ের মতাদর্শের

দ্বারা বাংলা সাহিত্য অধ্যুষিত। অবশ্য সেখানে মর্ত্য মানুষের সুখ-দুঃখের কথা ও বাস্তব জীবনচিত্রের বর্ণনা আছে বটে, কিন্তু তা ধর্মীয় প্রভাব কাটিয়ে জীবনের জয়গানে মানবিক স্বাতন্ত্র্য লাভ করেনি। আরাকানের মুসলমান কবিরা মানব-মানবীর রোমান্টিক প্রণয়ের কাহিনি রচনা করে ধর্মনিরপেক্ষ (secular) মানবতাবাদের মহিমা ঘোষণা করলেন। সৃষ্টির নতুনত্বে বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভঙ্গ হল। ভক্তিকথার বদলে প্রেমের সংগীত, দেবতার বদলে মানুষের কামনা বাসনার অভিব্যক্তিতে জীবনরসের সহজস্রোত প্রবাহিত করলেন। এই নতুন কাব্যাদর্শের দুজন শ্রেষ্ঠ কবি-দৌলত কাজি ও সৈয়দ আলাওল।

২. দৌলত কাজী

দৌলত কাজী আরাকান রাজসভার সম্বর্ধিত শ্রেষ্ঠ কবি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দৈবী পরিমণ্ডলের মধ্যে তাঁর ‘সতী ময়নামতী’ বা ‘লোরচন্দ্রানী’ কাব্যটি লক্ষণীয় স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। এই কাব্যে বাস্তব নরনারীর প্রণয়কথা ও সুখ-দুঃখের চিত্র চিত্রিত। তাতে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের গতানুগতিকতার মধ্যে নতুন জীবনচেতনার আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আরাকান রাজসভার কবিদের কাব্যচর্চার গুরুত্ব

১১১

কবি সুফি মতাবলম্বী ছিলেন। পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের জন্য তিনি আরাকানরাজ সুধর্মার রাজসভায় পরম সমাদর লাভ করেন। আরাকান রাজ্যের সমরসচিব আশরাফ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ও নির্দেশে তিনি ১৬২১ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ‘সতী ময়নামতী’ নামে রোমান্টিক কাব্য রচনা করেন। কাব্যটির দুই-তৃতীয়াংশ রচনার পর কবির তিরোধান ঘটে। আরাকান রাজসভার অন্য কবি সৈয়দ আলাওল আরাকান রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সুলেমানের আদেশে সুদীর্ঘ কুড়ি বছর পরে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে কাব্যের অসম্পূর্ণ অংশ সমাপ্ত করেন।

দৌলত কাজীর ‘সতী ময়নামতী’ মিয়া সাধন নামে হিন্দি কবির গোহারি হিন্দি ভাষায় নামক কাহিনি কাব্যের অনুসরণে লেখা। তবে আক্ষরিক অনুবাদ নয়। দৌলত কাজীর কবিপ্রতিভার স্বকীয়তাও এর মধ্যে যথেষ্ট। সতী ময়নামতী গল্প সারা ভারতেই সুপ্রচলিত ছিল। দৌলত কাজীর কৃতিত্ব সেই লোককাহিনিকেই রোমান্টিক কাব্যের রূপ দিয়েছেন পয়ার ত্রিপদী ছন্দে। জানা কাহিনিকে অজানা রহস্যে মন্ডিত করে স্বকীয় সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

এই কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে এই গোহারি দেশের রাজা মোহারার চন্দ্রাণী নামে এক সুন্দরী কন্যা ছিল। ভাগ্যদোষে তাঁর বিয়ে হয় নপুংসক এক বামনের সঙ্গে, রাজকন্যা চন্দ্রাণীর জীবন তাই অতীব দুঃখে কাটতে থাকে। একদিন আর এক রাজা লোরক মৃগয়ায় গিয়ে এক যোগীর কাছে চন্দ্রাণীর প্রতিকৃতি দেখে একান্ত বিমুগ্ধ হয়ে কাব্য কাহিনি

পড়েন এবং চন্দ্রাণীকে লাভ করার জন্য গোহারি যাত্রা করেন। সমস্ত

প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে লোরক মিলিত হন চন্দ্রাণীর সঙ্গে। সুযোগ বুঝে দুজনে পালিয়ে এলেন। বামন তাদের পিছু নিল। অরণ্যে লোরকের সঙ্গে যুদ্ধে দোর্দণ্ড-প্রতাপশালী বামন মারা গেল। চন্দ্রাণীর মৃত্যু ঘটল সর্পাঘাতে। তাঁকে বাঁচিয়ে দিল এক যোগীবর। এমন সময়ে গোহারির রাজদূত এসে সাদর আমন্ত্রণে দুজনকে রাজপুরীতে নিয়ে গেল। লোরক গোহারি দেশের রাজা হলেন। পরমসুখে নববধূকে নিয়ে তাঁর দিন কাটতে লাগল। ময়নার কথা ভুলে গেলেন। এদিকে পতিবিরহে ময়নামতীর দুঃখযন্ত্রণার শেষ নেই। ময়নার বিরহ দৌলত কাজী বারামাস্যার মধ্য দিয়ে শতধারায় উৎসাহিত করে দিয়েছেন। স্বামীর সংবাদ কিছুই জানেন না ময়না। তাঁর মঙ্গলকামনা করে ময়না নিত্য হরগৌরীর পুজো করে। ছাঁতন নামে এক লম্পট রাজকুমার ময়নার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে লাভ করার জন্য রত্নমালিনী নামে এক কুট্টনীকে পাঠায়। রত্নমালিকার সমস্ত প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ময়না। এরপর কাব্য অসমান্ত রেখে দৌলত কাজী ইহধাম পরিত্যাগ করেন। দৌলত কাজীর এই অসমাপ্ত কাহিনিকে সম্পূর্ণতা দান করেন সৈয়দ আলাওল। সংযুক্ত কাহিনি হল এই কুট্টনীকে ময়না রেগেমেগে চরম শান্তি দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিল। ময়নার বিরহযন্ত্রণা লাঘব করার জন্য এক সখী একটি উপকাহিনি শোনায়: ধর্মবতী নগরীর রাজা উপেন্দ্রদেব তাঁর গর্ভবতী পত্নী রতন কলিকাকে কোনো কারণে পরিত্যাগ করেন। এক ব্রাহ্মণ তাঁকে আশ্রয় দেন। সেখানে ‘আনন্দ’ নামে তাঁর এক পুত্র জন্মে। পুত্র বড়ো হয়ে পিতার সাক্ষাৎ পান। রাজা ও রানি অতঃপর পুনর্মিলিত হন। এই গল্প শোনার পর ময়নার পতিমিলন-বাসনা দুর্বার হয়ে ওঠে। এক

ব্রাহ্মণকে স্বামীর নিকট দূত করে পাঠান। লোরক ময়নার কথা স্বারণ করে অধীর হয়ে পড়েন। তখন চন্দ্রাণীর গর্ভজাত তাঁর এক পুত্র বেশ সাবালক হয়ে উঠেছে। তাঁর হাতে গোহারির রাজ্যভার সমর্পণ করে লোরক চন্দ্রাণীকে নিয়ে ময়নার কাছে ফিরে এলেন। দুই রানি স্বামীর সেবা করে সুখে দিন কাটাতে লাগল। বৃষ্ণ বয়সে লোরকের মৃত্যু ঘটলে তাঁরাও স্বামীর সঙ্গে অনুমৃতা হয়ে পরলোক যাত্রা করলেন।

আলাওলের সংযোজিত এই কাহিনির বাঁধুনি শিথিল, অনাবশ্যক ও অপ্রাসঙ্গিক ঘটনায় ভারাস্তাও। আলাওল দৌলত কাজীর কবিত্ব ও তাঁর মনঃপ্রকৃতি অনুসরণ করতে পারেননি। এতে প্রতিভার কোনো স্বাক্ষর নেই। কিন্তু দৌলত কাজীর রচনা সৃষ্টিশীলতায় উজ্জ্বল। অপরের কাহিনি অনুসরণ করলেও সেখানে তাঁর মনের মাধুরী প্রদীপ্ত। নারী চরিত্রসৃষ্টিতে

রচনা-বৈশিষ্ট্য দৌলত কাজী বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। যৌবনোচ্ছল প্রণয়চঞ্চল চন্দ্রাণী, পতিপ্রেমে অচঞ্চল সর্বংসহা সতী ময়না ও ভ্রষ্টাচরিত্র রত্না স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। অনুভূতির গভীরতায়, মানবচরিত্রের সার্থক রূপায়ণে, প্রেমের মুক্ত মহিমা প্রচারে ও সরস রচনারীতিতে দৌলত কাজীর রচনা যথেষ্ট শিল্পসৌকর্যমণ্ডিত। নারীত্বের যে আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন তা হিন্দু ঐতিহ্যে অনুপ্রাণিত। সংস্কৃত সাহিত্যে দৌলত কাজীর প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল-তাই সংস্কৃত সাহিত্যের নারীচরিত্রের আদর্শে তিনি ময়নাকে গড়ে তুলেছেন। রোমান্টিক ও ক্লাসিক ধর্মের সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে তাঁর কাব্যে।

বাংলা ভাষায় দৌলত কাজীর যথেষ্ট পারদর্শিতা ছিল। কাব্যের কায়াগঠনে তিনি জয়দেব ও কালিদাসকে সার্থকভাবে অনুসরণ করেছেন। ব্রজবুলি ও সংস্কৃত ভাষা প্রয়োগে কাহিনি বর্ণনায় অলংকার ব্যবহার ও ছন্দসৃষ্টিতে তিনি কাব্যোৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছেন।

‘সতী ময়নামতী’র উৎস ভিন্নরাজ্যের ভিন্নভাষার গ্রন্থ হলেও স্বভাবজাত বাঙালি সংস্কার ও বাংলার কবিপ্রাণে উজ্জীবিত দৌলত কাজীর কল্পনার রঙেরসে তা ধর্মাশ্রিত ও দেবমাহাত্ম্য মূলক বাংলা কাব্যের যুগে মানবিক ভিত্তিতে বিশুদ্ধ বাস্তব জীবনরসের পরিবেশনে রোমান্টিক কাব্যের পূর্ব সূচনা করেছে। গল্পের কাব্যিক রূপায়ণে রোমান্টিকতা, মনস্তাত্ত্বিক ঘাতপ্রতিঘাত, নাট্যরস, গীতিরস ও ট্রাজিক আবহ সৃষ্টিতে দৌলত কাজি অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী। কাব্যে মাঝেমধ্যে রূপকথার আমেজ ও অবিশ্বাস্য অলৌকিকতার সঞ্চার ঘটলেও তা যুগরুচির বশবর্তী এবং তা বাস্তবতাকে ক্ষুণ্ণ করেনি।

৩. সৈয়দ আলাওল

আরাকান রাজসভার দ্বিতীয় কবি সৈয়দ আলাওল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক প্রচারিত ও পরিচিত কবি। তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ

ভূমিকা

মুসলমান কবি নামেও অভিহিত করা হয়। আলাওল বিচিত্র বিষয়কে অবলম্বন করে কবিপ্রতিভার ব্যাপকতর পরিচয় দিয়ে গেছেন।

আলাওল তাঁর আত্মপরিচয় দিয়েছেন যে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে চট্টগ্রামে তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু ঘটে। কবির পিতা ফতেহাবাদের মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন। জলদস্যুদের হাতে তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটে। কবি ছিলেন সুনিপুণ যোদ্ধা। পিতৃহীন কবি মগরাজের সেনাবাহিনীতে চাকুরি নিতে বাধ্য হন। অল্প সময়ের মধ্যে আরাকানের মুসলিম সমাজে তাঁর প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং আরাকানের রাজসভায় তিনি সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হন। শাসকবর্গের উৎসাহে তিনি আরবি, ফরাসি, হিন্দি কাব্য আত্মত্মপরিচয় অবলম্বনে বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করে খ্যাতি অর্জন করেন। ইতিমধ্যে তিনি রাজরোষে পতিত হয়ে পঞ্চাশ দিন কারারুদ্ধ হন। পরে অবশ্য রাজকর্মচারীদের আনুকূল্যে কারামুক্ত হয়ে পূর্ব মর্যাদা ফিরে পান। আলাওলের জীবন সৌভাগ্যের প্রাচুর্যে, আনন্দে এবং দুর্ভাগ্যের দুঃখদুর্দশায় বড়োই বৈচিত্র্যপূর্ণ।

আরাকানরাজ থিরিথু ধম্মা বা শ্রীসুধর্মা ও রাজমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল বিবিধ কাব্য অনেকগুলি কাব্য রচনা করেন। তবে তাঁর সবগুলি গ্রন্থ অনুবাদমূলক, মৌলিক সৃষ্টি নয়। আরবি ও ফারসি থেকে অনূদিত চারটি গ্রন্থ এবং হিন্দি থেকে অনুদিত একটি।

‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জমাল’ (১৬৫৮-৬০) ইস্লামীয় রোমান্টিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত। এই কাব্য রচনার কালেই কবি কারারুদ্ধ হন। নায়ক সয়ফুলমূলক ও নায়িকা বদিউজ্জমালের প্রেমকাহিনি এর বিষয়বস্তু। এই কাব্যটি মুসলিম সমাজে খুবই জনপ্রিয়। মানব নায়কের সঙ্গে পরি প্রেমিকার মিলন কাহিনি লিখে আলাওল মানবলোক ও স্বপ্নলোকের মধ্যে স্বপ্নমেদুর লোকাতীত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন।

‘হপ্তপয়করে’ (১৬৬৫) আরবের রাজকুমার বাহরামের যুদ্ধজয় ও সপ্তপরির গল্প বর্ণিত হয়েছে। ইরানীয় কবি নেজামি সমরকন্দের ‘সপ্তপয়কর’ গ্রন্থের আখ্যানই এর আশ্রয়। ‘তোহফা’ (১৬৬৩-৬৪) ফারসি নীতিকাব্য ‘তুহফাতুন্নেসা’ গ্রন্থের অনুবাদমূলক্ রচনা। নীতিশাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থ বলেই এটি অত্যন্ত নীরস।

১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘সেকান্দারনামা’ গ্রন্থটি প্রসিদ্ধ। নেজামি সমরকন্দের ফারসিকাব্য ‘ইসকান্দারনামা’র সরস অনুবাদ। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের সমরাভিযান, যুদ্ধবিগ্রহ ও রূপকথাধর্মী অনেক গল্প ইসলামীয় কায়দায় স্থান পেয়েছে। সেগুলি চিত্তাকর্ষক হলেও কাব্যগুণের দিক থেকে নগণ্য এবং হিন্দু সমাজে অনাদৃত।

একমাত্র প্রথমকাব্য ‘পদ্মাবতী’র (১৬৪৬) জন্য কবি হিন্দুসমাজে সুবিখ্যাত হয়ে আছেন এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। এই গ্রন্থটি খুবই জনপ্রিয় হিন্দু- মুসলমান উভয় সমাজেই এটি সমাদৃত। এই গ্রন্থটি অযোধ্যার জায়স গ্রামবাসী মালিক মুহম্মদ জায়সী নামে এক সুফি মতাবলম্বী ভক্ত কবির ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের অনুবাদ। সিংহল রাজকন্যা ও মেবারের রত্নসেনের রানি অনিন্দ্যসুন্দরী পদ্মাবতী বা পদ্মিনীকে শক্তিবলে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আলাউদ্দিন খিলজি চিতোর আক্রমণ করেন। এই দস্যুর কবল থেকে সতীত্বধর্ম রক্ষার জন্য পদ্মিনী জহরব্রতে আত্মত্যাগ করেন।

আলাওল ‘পদুমাবৎ’ কাব্যকে হুবহু অনুসরণ করেননি। তিনি জায়সীর আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে এড়িয়ে গেছেন। আলাওলের লক্ষ্য ঈশ্বর-ভাবনা নয়, তিনি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের প্রেম ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের কাহিনিকাব্য রচনা করেছেন। পদ্মাবতী ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক প্রেমকাব্য। প্রেমিক-প্রেমিকার চরিত্রচিত্রণ ও প্রেমাদর্শ তুলে ধরতে গিয়ে আলাওল

মূল কাহিনির অনেক কিছু বর্জন করেছেন। আবার তারই মধ্যে স্বকীয় ভাবভাবনার সংযোজনও ঘটেছে। আলাওল এই কাব্যে সমকালীন আরাকানরাজ শ্রীসুধর্মার রাষ্ট্রিক ও সামরিক এবং রাজ্যের আর্থসামাজিক বিষয়েরও কিছু বর্ণনা করেছেন। প্রেমের মহিমা প্রকাশ করতে গিয়ে আলাওল লিখেছেন- ‘প্রেম বিনে ভাব নাহি, ভাব বিনে রস। ত্রিভুবনে যত দেখ প্রেমহস্তে বশ/প্রেমতুল্য বস্তু নাই পৃথিবী ভিতর।।’

সেই অমূল্য প্রেমের নায়িকা পদ্মিনী। পদ্মাবতী কাব্যে ধর্মসংস্কারমুক্ত মর্ত্য মানব- মানবীর প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার ভাবলোক সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের জন্যই বিশেষভাবে স্মরণীয়।

এই কাব্যে বহুভাষাবিদ ও শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত জীবনরসিক আলাওল বহু পাত্র থেকে জীবনের রস আহরণ করেছেন। সৃজনীশীলতার দিক থেকে তিনি দৌলত কাজীর সমতুল্য না হলেও ধর্মশাসিত ও দৈবশক্তি নিয়ন্ত্রিত মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে মানবিকতার মহিমা প্রতিষ্ঠায় তিনি দৌলত কাজীর মতো ঐতিহাসিক মর্যদাসম্পন্ন কবি।

সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবিরা যে প্রণয়মূলক কাব্য রচনা করেন পরবর্তীকালে তা হিন্দু কবি রচিত বিদ্যাসুন্দরের মতো আদি রসাত্মক প্রণয়কাব্য রচনায় প্রেরণা দান করেছে-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। বস্তুত এই সকল কাহিনিই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে

পরবর্তীকালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আখ্যায়িকা কাব্য রচনায় প্রভাব বিস্তার করেছে।

অনুশীলনী

১। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরাকান রাজসভার কবিদের কাব্যরচনার গুরুত্ব কোথায়? এই রাজসভার

প্রধান দুজন কবির নাম লেখো। এঁদের মধ্যে যে-কোনো একজনের কাব্য ও কবিপ্রতিভা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৯৫) ৩+২+১০

২। সৈয়দ আলাওলের কবিপ্রতিভার পরিচয় দিয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করো। (উ.মা. ২০০১)

৩। দৌলত কাজীর পরিচয় দিয়ে তাঁর লেখা কাব্যের কাহিনি বর্ণনা করো। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই কাব্যটির গুরুত্ব কতখানি বলো। (উ.মা. ২০০৩)