ফসল চিবিয়ে খাওয়া পোকার সুসংহত নিয়ন্ত্রণঃ
১) ফসল কাটার পর গভীর চাষ দেওয়া।
২) আলের ধারে বা ফসলের মাঝে ফাঁদ ফসল চাষ করা।
৩) ফেরোমোন ফাঁদ (বিঘা প্রতি ২-৩টি) ব্যবহার করে পোকার উপস্থিতি জানা ও পূর্ণাঙ্গ পোকা ধরে মারা।
৪) ফসল ক্ষেতে বিঘা প্রতি ৫-৬টি পাখি বসার দাঁড় বসানো।
৫) আক্রমণের প্রথম দিকে ক্ষেত থেকে ডিমযুক্ত পাতা ও ল্যাদা পোকার গাদা হাত দিয়ে তুলে নষ্ট করা।
৬) দলবদ্ধভাবে স্প্রে করা, ক্ষেতে ও আলে বিকালে স্প্রে করা।
৭) ফসল ক্ষেতের চারদিকে দু ইঞ্চি গভীরতার নালা কেটে তাতে গুঁড়ো কীটনাশক প্রয়োগ করা।
৮) জমিতে মাঝে মাঝে ঘাস বা খড়ের ঢিবি জড়ো করে রাখলে ওর মধ্যে ল্যাদাপোকা আশ্রয় নেয়। তখন ঐ পোকাগুলো মেরে ফেলা।
৯) ক্ষেতে সেচ দিলে মাটির মধ্যে লুকানো ল্যাদা বাইরে বের হয়ে আসে।
১০) বিষটোপ ব্যবহার করা। ২.৫ কেজি ধানের কুঁড়োর সঙ্গে ১৫০ গ্রাম গুড় ও ১৫০ গ্রাম কার্বারিল মিশিয়ে তৈরী করা বিষটোপ ১ বিঘা ক্ষেতের মাঝে মাঝে টোপ হিসাবে রাখা যেতে পারে।
১১) স্প্রে করার তরলের সঙ্গে লিটার প্রতি ৫ গ্রাম গুড় মেশালে ভালো কাজ হয়।
১২) স্পিনোস্যাড, ইন্ডক্সাকার্ব জাতীয় কীটনাশক ব্যবহারে ভালো কাজ হয়।
১৩) আক্রমণের প্রথম দিকে নিমজাত কীটনাশক স্প্রে করা যেতে পারে।
১৪) বন্ধুপোকা হিসাবে ট্রাইকোগ্রামা, টেলেনোমাস, ক্রাইসোপারলা ছাড়া যেতে পারে।
১৫) জৈব ছত্রাকজনিত কীটনাশক হিসাবে মিটারহিজিয়াম, ভার্টিসিলিয়াম, বিউভেরিয়া ক্ষেতে ছাড়া যেতে পারে।
ফসলের রসশোষক পোকা:
১) মাইট বা মাকড়।
২) অ্যাফিড বা জাবপোকা।
৩) জ্যাসিড বা শোষকপোকা।
8) থ্রিপস বা চোষী পোকা বা চিরুনি পোকা।
৫) হোয়াইট ফ্লাই বা সাদা মাছি।
৬) স্কেল ইনসেক্ট বা আঁশ পোকা।
৭) মিলিবাগ বা দ’য়ে পোকা।
ফসলের রসশোষক পোকার সুসংহত নিয়ন্ত্রণঃ
১) কীটনাশক দিয়ে বীজশোধন জরুরি। প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ৫ গ্রাম ইমিডাক্লোপ্রিড ৭০ শতাংশ ডব্লু এস বা ৪ গ্রাম কার্বোসালফান ২৫ শতাংশ ডি এস মেশানো।
২) বীজ তলায় প্রতি বর্গমিটারে ১৫-২০ গ্রাম কার্বোফুরান জাতীয় দানা কীটনাশক প্রয়োগ করা।
৩) চারা বসানোর ২০, ৪০ ও ৬০ দিনের মাথায় গাছের গোড়া থেকে কিছু উপরে কান্ডের গায়ে গোল করে কার্বোসালফান (১মিলি/ ৪ মিলি জলে) লাগানো যায়।
৪) ফাঁদ ফসল চাষ করলে পোকার আক্রমণ এড়ানো যায়।
৫) সাদা মাছি আক্রমণ প্রবণ এলাকায় হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা যায়।
৬) পাতার নিচের দিকে অবশ্যই স্প্রে করতে হবে এবং সকালের দিকে স্প্রে করা ভালো।
৭) সর্বাঙ্গবাহী ঔষধ স্প্রে করা উচিত। ইমিডাক্লোপ্রিড, ক্লোথায়ানিডিন, অ্যাসিটামিপ্রিড, থায়ামেথোক্সাম জাতীয় কীটনাশক স্প্রে করা যেতে পারে।
৮) গাছ প্রতি ২-৩টি ক্রাইসোপার্লা জাতীয় বন্ধুপোকা ছাড়া যেতে পারে।
৯) জৈব ছত্রাকজনিত কীটনাশক ভার্টিসিলিয়াম লেকানি ক্ষেতে প্রয়োগ করা যায়।
মাকড়ের সুসংহত নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ
আজকাল মাকড়ের আক্রমণ অত্যধিক বেশী হতে দেখা যাচ্ছে। মাকড় পাতা থেকে রস চুষে খায়, পাতার কোষ ও সবুজ কণার ক্ষতি করে এবং পাতার মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ ঢুকিয়ে দেয় ফলে, ফসলের বিকৃতি ঘটে। অত্যধিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বন্ধু পোকার বিলুপ্তি, অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলে মাকড় আক্রমণের সম্ভাবনা বেশী। সিন্থেটিক পাইরিথ্রয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের ফলে স্ত্রী মাকড়ের বংশ বিস্তারেব ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শীতের শুরু থেকে মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়, গরমে তীব্র আকার ধারণ করে এবং বর্ষাতে আক্রমণ কমে যায় বা থাকে না।
১) মাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য জোরে জল স্প্রে করলে কাজ হয়।
২) মাকড়নাশক ওষুধ গুলি বিকালে স্প্রে করলে বেশী কার্যকরী হয়।
৩) বিভিন্ন মাকড়নাশক যেমন, ডাইকোফল, মিলবিমেকটিন, ইথিয়ন, ফেনাজাকুইন, প্রোপারজাইট ইত্যাদি স্প্রে করা দরকার।
ফলের মাছির সুসংহত নিয়ন্ত্রণঃ
গ্রীষ্মকালীন লাঙ্গল দিয়ে মাটি চষে রোদ খাওয়ালে পোকার পুত্তলী নষ্ট হয়। ১)
২) কীট আক্রান্ত ফল মাঠ থেকে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলা উচিত।
৩) ২ লিটার জলে ৫০০ গ্রাম ঝোলা গুড়, ২০ গ্রাম কার্বারিল ও ২০ গ্রাম ইস্ট হাইড্রোলাইসেট গুলে ১ বিঘা সবজির ক্ষেতে মাটির ভাঁড়ে বা নারকেল মালায় মাঝে মাঝে রেখে দিলে মাছি আকৃষ্ট হয়ে মারা যায়।
8) ২০ লিটার জলে ৫০০ গ্রাম ঝোলা গুড়, ২০ গ্রাম কার্বারিল ও ২০ গ্রাম ইষ্ট হাইড্রোলাইসেট গুলে ১ বিঘা সবজির ক্ষেতে ১০ বর্গ মিটার অন্তর ফালিতে স্প্রে করা যায়।
নালী পোকা বা ম্যাপ পোকার সুসংহত নিয়ন্ত্রণঃ
১) পোকার পুত্তলী মাটির মধ্যে থাকে। গ্রীষ্মকালীন লাঙ্গল দিয়ে মাটি রোদ খাওয়ানো দরকার।
২) আক্রান্ত বীজপত্র ও প্রথম দিকে আক্রান্ত পাতা ছিঁড়ে ফেলে নষ্ট করা উচিত।
৩) প্রথম অবস্থায় প্রতি লিটার জলে ৫ গ্রাম নিমবীজ গুঁড়ো বা ৩ মিলি অ্যাজাডাইরেক্টিন (১% ইসি) গুলে স্প্রে করা যেতে পারে।
৪) রাসায়নিক ওষুধ হিসাবে প্রতিলিটার জলে ১ মি.লি. ফিপ্রোনীল বা ১ মি.লি. অ্যাসিফেট + ফেনভেলারেট বা ০.৭৫ গ্রাম অ্যাসিফেট গুলে স্প্রে করা প্রয়োজন।
নিমাটোডের সুসংহত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাঃ
১) কার্বোসালফান জাতীয় কীটনাশক দিয়ে শিকড় শোধন করা দরকার।
২) মাঠে নিম খোল ব্যবহার করা উচিত (বিঘা প্রতি ন্যূনতম ৫০-৬০ কেজি)।
৩) নিমাটোড আক্রান্ত ক্ষেতে গাঁদা ফুলের চাষ করা উচিত।
৪) নিমাটোড প্রবণ এলাকায় কুষ্মান্ড গোত্রীয় ফসল, ভেন্ডি, সীম, পুঁইশাক ও কন্দ জাতীয় ফসলের চাষ কয়েক বছর বন্ধ রাখা উচিত।
৫) আক্রান্ত ফসলের ক্ষেতে দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
৬) সহনশীল জাতের চাষ করা উচিত।
২. ফসলের রোগ।
বিভিন্ন ধরণের ফসলের প্রধান প্রধান রোগগুলি হলো-
১) চারা ঢলে পড়া।
২) গোড়া পচা, ডাঁটা পচা, শিকড় পচা।
৩) ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া ঘটিত পাতায় দাগ।
৪) জলদি ধ্বসা।
৫) নাবি ধ্বসা।
৬) ডাউনি মিলডিউ।
৭) পাউডারি মিলডিউ।
৮) ফোমস্।ি
৯) মরচে।
১০) ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া।
রোগের সুসংহত নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ
১১) ছত্রাক জনিত ঢলে পড়া।
১২) অ্যানথ্রাকনোজ।
১৩) ফল পচা।
১৪) পাতা কোঁকড়ানো।
১৫) পাতায় হলুদ নক্শা।
১৬) তুলসী বা পাতা ছোট হওয়া।
১৭) ক্লাব রুট বা শিকড় ফোলা।
১৮) কালোশিরা বা একপেশে।
১৯) নরম পচা।
২০) ডগা শুকানো।
১) ট্রাইকোডার্মা ও সিউডোমোনাস জাতীয় জৈব অথবা রাসায়নিক ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ ও চারা শোধন করা।
২) রোগ সহনশীল জাতের চাষ।
৩) ট্রাইকোডার্মা ও সিউডোমোনাস জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় বা জমিতে প্রয়োগ করা।
৪) রোগের আশ্রয়দাতা ক্ষেতের ও জমির আগাছা মুক্ত রাখা।
৫) আক্রমণের প্রথম দিকে আক্রান্ত অংশ তুলে পুড়িয়ে ফেলা।
৬) চারা ঢলা, গোড়াপচা, পাতায় দাগ, জলদি ও নাবি ধ্বসা, অ্যানথ্রাকনোজ, ডাউনি মিলডিউ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম কপার অক্সি ক্লোরাইড বা ১ মি.লি.
হেক্সাকোনাজল বা ০.৫ গ্রাম মাইক্লোবুটানিল গুলে স্প্রে করা। ৭) পাউডারি মিলডিউ, মরচে রোগের জন্য প্রতি লিটার জলে ০.৭৫ মি.লি. প্রোপিকোনাজোল
বা ১ গ্রাম কার্বেনডাজিম গুলে স্প্রে করা। ৮) ঢলে পড়া রোগ ছত্রাকজনিত ও ব্যাক্টিরিয়াজনিত হতে পারে। সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া।
৯) ক্লাবরুটের জন্য মাটির সংশোধক ব্যবহার করে পি. এইচ, বা ক্ষারাম্নমান ৭.২ এর কাছাকাছি আনা ও প্রতিরোধী জাত চাষ করা।
ভাইরাস রোগের বৈশিষ্ট্যঃ
ঢেঁড়শের সাহেব রোগ, লঙ্কার কুটে রোগের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এগুলি ভাইরাস রোগ। ভাইরাস রোগকে অন্য রোগ থেকে সহজে আলাদা করা যায়। ভাইরাস রোগের লক্ষণগুলি হল:
১) আক্রান্ত গাছের পাতায় ঘন সবুজ ও হাল্কা সবুজ ছোপ।
২) পাতার শিরা-উপশিরা হলুদ হয়ে যায়।
৩) পাতা আস্তে আস্তে হলুদ বর্ণে পরিবর্তিত হয়।
8) পাতার আকৃতি ছোট হয়ে যায় এবং পাতায় বিকৃতি ঘটে।
জাব পোকা (ডানা যুক্ত)
৫) আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিক গাছের বৃদ্ধির তুলনায় কম হয়।
একটা ক্ষেতে সব ফসল একসঙ্গে ভাইরাস আক্রান্ত হয় না, ছড়িয়ে ছিটিয়ে হয়। ৬)
ভাইরাস রোগের সুসংহত নিয়ন্ত্রণ:
কোন গাছ ভাইরাস আক্রান্ত হলে, সে গাছ আর সারানো যায় না। কারণ ভাইরাস রোগ সারানোর ঔষধ নেই। সেই জন্য ভাইরাস রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রধানত বীজ, কন্দ, নানাপ্রকার কলম ও বাহক পোকার মাধ্যমে ভাইরাস রোগ ছড়ায়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ফসলের ভাইরাস রোগ বাহক পোকার দ্বারা এক গাছ থেকে অন্য গাছে সংক্রমিত হয়।
১) ভাইরাস মুক্ত বীজ ব্যবহার করা উচিত। কোন অবস্থাতে ভাইরাস আক্রান্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা উচিত নয়।
২) ভাইরাস আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায়, আক্রান্ত গাছগুলো মাটি থেকে তুলে ফেলে পুড়িয়ে বা গর্ত করে পুঁতে দেওয়া উচিত।
৩) অনেক সময় ফসলের অবশিষ্টাংশের থেকে ভাইরাস ছড়ায়, সে সকল ক্ষেত্রে ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে দেওয়া উচিত।
৪) ভাইরাস আক্রমণ প্রবণ এলাকায় সহনশীল জাতের চাষ করা উচিত।
৫) ভাইরাসের আক্রমণের সময়, রোগের বিস্তার ও বাহক পোকার আক্রমণ বুঝে অন্তর্বাহী কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত।
৬) পাশের জমিতে ভাইবাসের আক্রমণ দেখা গেলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
অণুখাদ্যের অভাবজনিত রোগ লক্ষণ
অণুখাদ্যের অভাবজনিত কারণে ফসলের শারীরবৃত্তীয় বিঘ্ন ঘটে। ফলে গাছে এমন কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়, যেগুলি রোগের মতো দেখতে হয়। এই সমস্যাগুলি দূরীকরণের জন্য ওষুধ প্রয়োগের পরিবর্তে অণুখাদ্য প্রয়োগ করা দরকার। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে পরিক্ষিত মাটির নমুনার ৫০-৯০ শতাংশে বোরণ, ২৫-৬০ শতাংশে জিঙ্ক ও ২৫-৫০ শতাংশে মলিবডেনামের অভাব দেখা গেছে। লাল ও কাঁকুড়ে মাটি এবং তিস্তা ও তরাই অঞ্চলের মাটিতে ওই অণুখাদ্যগুলির ঘাটতির আধিক্য অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি।
বোরনের অভাবজনিত রোগ লক্ষণ-বাঁধা ও ফুলকপির ফাঁপা কান্ড, ফুলকপির গোলাপী
রঙ; আলু, বেগুন, মূলো, বাঁধাকপি ফেটে যাওয়া; টমাটো ও পেয়ারার ফলের গায়ে উচু দাগ, গাছের ডগা কালো হয়ে শুকিয়ে যাওয়া; মূলো, বীট প্রভৃতির ভিতরে কালো পচন; কুমড়ো জাতীয় ফসলের কান্ড ফাটা; সূর্যমুখীর চিটে দানা ইত্যাদি।
অভাবী জমিতে প্রতিকার হিসাবে জমি তৈরির সময় একর প্রতি ৪ কেজি বোরাক্স জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়। অন্যভাবে প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম বোরাক্স বা ১.৫ গ্রাম অক্টাবোরেট বা ১ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড গুলে ফসলের ১ ও ১.৫ মাস বয়সে যথাক্রমে ১০০ লিটার ও ২০০ লিটার মিশ্রণ এক একর জমিতে গাছের পাতায় স্প্রে করা যায়। লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া ফসলে ১৫ দিন তফাতে ওপরের মিশ্রণ দুবার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
জিঙ্কের অভাবজনিত রোগ লক্ষণ-ধানগাছের খয়রা বা মরচে রোগ, গমের হলদে-
সাদা পাতা, ভুট্টার সাদা পাতা, সর্ষের নীলচে বেগুনি পাতা, আলুর ব্রোঞ্জ রঙের পাতা; টমাটোর মোটা, ছোট ও কোঁচকানো পাতা; লেবুর ছোট ও বিকৃত ফল ইত্যাদি। অভাবী জমিতে প্রতিকার হিসাবে জমি তৈরির সময় একর প্রতি ১০ কেজি জিঙ্ক সালফেট জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়। অন্যভাবে, প্রতি লিটার জলে ০.৫ গ্রাম চিলেটেড জিঙ্ক গুলে ফসলের ১ ও ১.৫ মাস বয়সে যথাক্রমে ১০০ ও ২০০ লিটার মিশ্রণ এক একর জমিতে ফসলের পাতায় স্প্রে করা হয়। লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া ফসলে ১৫ দিন তফাতে দুবার ওপরের মিশ্রণ প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়।
মলিবডেনামের অভাবজনিত রোগ লক্ষণ-ফুলকপির কাস্তের মতো সরু পাতা, বাঁধাকপির পাতা মুড়ে কাপের মতো আকৃতি, টমাটোর পাতা বেঁকে কাপের আকৃতি, আলুর পাতায় ফ্যাকাশে ছোপ; বেগুন, সূর্যমুখী, পেঁপের পাতার ফলক অংশ কমে যাওয়া ইত্যাদি। অভাবী জমিতে প্রতিকার হিসাবে জমি তৈরির সময় একর প্রতি ২০০ গ্রাম অ্যামোনিয়াম মলিবডেট জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়। অন্যভাবে প্রতি লিটার জলে ০.৫ গ্রাম অ্যামোনিয়াম মলিবডেট গুলে ফসলের ১ ও ১.৫ মাস বয়সে যথাক্রমে ১০০ লিটার ও ২০০ লিটার মিশ্রণ এক একর জমিতে ফসলের পাতায় স্প্রে করা হয়। লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া গাছে ১৫ দিন তফাতে দুবার ওপরের মিশ্রণ প্রয়োগ করা যাবে।
কীটনাশকের নিরাপদ এবং বিচক্ষণ ব্যবহার:
১) সকল কীটনাশকই বিষাক্ত পদার্থ। অতএব সব সময় সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
২) কোন কীটনাশক বাড়ীতে রাখা উচিত নয়। বাচ্চাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা উচিত।
৩) জৈব কীটনাশক বিকালে ব্যবহার করা উচিত। প্রখর রৌদ্রে ব্যবহার করা উচিত নয়।
৪) খালি পেটে কোন কীটনাশক স্প্রে করা যাবে না।
৫) কীটনাশক স্প্রে চলাকালীন বিড়ি, সিগারেট, তামাক বা গুটকা খাওয়া বারণ।
৬) পরিণত গাছে বিঘা প্রতি অন্ততঃ ১০০ লিটার জল ব্যবহার করা উচিত।
৭) স্প্রে করার আগে চশমা (সানগ্লাস্), গ্লাভস্, নাকে রুমাল/গামছা, এবং সমস্ত গা, হাত, পা জামা / কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারলে ভালো হয়।
৮) মনোক্রটোফস্ জাতীয় কীটনাশক সবজিতে এবং কারবারিল জাতীয় কীটনাশক ফুল আসার পর ব্যবহার করা উচিত নয়।
৯) কীটনাশকের সাথে আঠা জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা উচিত।
১০) জৈবকীটনাশকের ক্ষেত্রে যে সকল কোম্পানীর CIB Registration Number (CIR No.) আছে, সেগুলিই কেবল ব্যবহার করা উচিত।
১১) তীব্র বিষযুক্ত কীটনাশক কম ব্যবহার করাই ভাল।
১২) বোর্দো মিশ্রণের সাথে কোন কীটনাশক মেশানো যাবে না।
১৩) একই কীটনাশক বারবার ব্যবহার করা উচিত নয়।
১৪) আগাছানাশক-এর সাথে কোন প্রকার কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা উচিত নয়।
১৫) সব সময় সঠিক মাত্রায়, পদ্ধতিতে ও সময়ে কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত।
১৬) স্প্রে নজেল্ আটকিয়ে গেলে কখনও মুখ দিয়ে ফুঁ দেওয়া উচিত নয়।
১৭) বিষক্রিয়া ঠিক আছে কিনা তা দেখবার জন্য কখনও কোন দানাদার কীটনাশক চেখে দেখা একেবারেই উচিত নয়।
১৮) সরাসরি নাক দিয়ে কোনও কীটনাশক এর গন্ধ শোঁকা একেবারেই উচিত নয়।
১৯) সব সময় বীজ শোধন করা উচিত। এতে ভবিষ্যতে অনেক কম পরিমাণ রোগ দেখা দেয়। ফলে চাষের খরচ অনেক কমানো যায়।
২০) সিন্থেটিক পাইরিথ্রয়েড গ্রুপের কীটনাশক একই ফসলে বারবার প্রয়োগ করা উচিত নয়।
ঘরে তৈরি উদ্ভিদজাত কীটনাশক:
আমাদের চেনা জানা গাছপালার পাতা, ছাল, বীজ ও অন্য অংশ থেঁতো করে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ছেঁকে স্প্রে করলে সস্তায় অনেক রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সাধারণত ২০০ গ্রাম ভেষজ উপাদান থেঁতো করে ১০ লিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে ৪০ গ্রাম নরম কাপড় কাচা সাবান গুলে স্প্রে করলে উপকার পাওয়া যায়। নিমপাতা, আতা পাতা, আতা বীজ ২০০ গ্রাম হারে এবং নিমবীজ, তামাক পাতা ১০০ গ্রাম হারে মেশানো হয়। একইভাবে নিমখোল ২০০ গ্রাম মিশিয়ে ছেঁকে কাজে লাগানো হয়। এছাড়া পাট বীজ, পেঁয়াজ ও রসুন এর নির্যাস, কাঁচা লঙ্কা, তুলসী, চোতরা বা বিচুটি, ভাটি, আকন্দ, ধুতরা, নিশিন্দা, ঢোলকলমি পাতা এবং করঞ্জা, মহুয়া খোল প্রভৃতি ব্যবহার করা যায়।
উদ্ভিদজাত ছাড়া অন্য কিছু ঘরোয়া কীটনাশক যেমন ২-৩ দিন রোদে রেখে সক্রিয় করা গোমূত্র, কেরোসিন মেশানো ছাই গুঁড়ো ব্যবহারও কার্যকরী।
৩. ফসলের আগাছা
সুসংহত আগাছা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ
সুসংহত আগাছা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মূলকথা হ’ল, সুপরিকল্পিতভাবে পরিচর্যা (Cultural), যান্ত্রিক (Mechnical), জৈবিক (Biological) ও রাসায়নিক (Chemical) নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সুষম ও সুসংহত প্রয়োগের মাধ্যমে আগাছার মাত্রা বা পরিমান অর্থনৈতিক চরমসীমা (ETL) র নীচে রাখা।
পরিচর্যা (Cultural):
এই পদ্ধতির মধ্যে পড়ে-
১) পরিচ্ছন্ন ভাবে জমি তৈরী করা, ফসল তোলার পর জমি চাষ দিয়ে রাখা, গ্রীষ্মে খালি জমি চষে রাখা, ফসল লাগানোর আগে চাষ দিয়ে ও আগাছামুক্ত জমি তৈরী করা ইত্যাদি।
২) সারি থেকে সারি ও গাছ থেকে গাছের মধ্যবর্তী দূরত্ব ফসল ও জাতের সুপারিশ অনুযায়ী মেনে চলা।
৩) সঠিক সময়ে ও পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ, সার প্রয়োগের আগেই নিড়ানি দেওয়া।
8) সাথী ফসলের চাষ স্বল্পমেয়াদী সাথী ফসলের চাষ আগাছা নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত অর্থ রোজগারের সহায়তা করে।
৫) উন্নত মানের বীজের ব্যবহার।
৬) উন্নতমানের সেচের ব্যবহার।
৭) আচ্ছাদন ফসলের চাষ (Cover Crop) যেমন ধইঞ্চা, শন ইত্যাদি।
৮) আচ্ছাদন দেওয়া (Mulching) ইত্যাদি।
যান্ত্রিক (Mechnical):
নিড়ানি, খুরপী, বিদে, কোদাল ইত্যাদির সাহায্যে আগাছা তুলে ফেলে জমিকে আগাছামুক্ত রাখা, চাষের সঙ্গে সঙ্গে মই দেওয়া ইত্যাদি এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত।
জৈবিক (Biological):
আগাছার শত্রু রোগ বা পোকামাকড় সংরক্ষন করা এবং বাইরে থেকে প্রয়োগের মাধ্যমে আগাছা নিয়ন্ত্রনে আনাই হলো এই প্রক্রিয়ার মূল কথা। বিভিন্ন উদ্ভিদের বিষরস (Toxins) নিষ্কাষন করেও আগাছা নাশকের অনুরূপ রাসায়নিক উদ্ভাবন করা সম্ভব হচ্ছে যেমন অ্যানিসোমাইসিন, সিনেকাল, ইপরেন্সিল, মেথক্সিফেনোন ইত্যাদি। জৈব আগাছা নাশকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাইআলোফস, টেনটক্সিন ইত্যাদি।
জিন কারিগরী ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে বর্তমান শষ্য উদ্ভিদের মধ্যে রাসায়নিক আগাছানাশক সহনশীল ও প্রতিরোধী গুণ সংযুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে, আগাছানাশক প্রয়োগের ফলে ফসলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা কমে যাবে। বন্ধু পোকার মাধ্যমেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আগাছার আকার ও ঘনত্ব, ফসলের ক্ষতির মাত্রা, পরিবেশ, পরিস্থিতি ইত্যাদির বিচার বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন পোকার আক্রমণ ঘটিয়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরা আগাছা খেয়ে ধ্বংস করে। লেস বাগ এর পূর্ণাঙ্গ ও ল্যাদা (Nymph) এবং শুয়োপোকা পাতা খায়। কন্দ খেকো উইভিল জাতীয় পোকার পূর্ণাঙ্গ ও গ্রাব, টরসিসিড্ কান্ড ছিদ্রকারী পোকার ল্যাদা মুথা ঘাসের কন্দ, কান্ড পাতা খায়। পার্থেনিয়াম গাছের বিশেষ উইভিল জাতীয় পোকার কীড়া গাছের পাতা ও কান্ড খেয়ে ধ্বংস করে।
রাসায়নিক (Chemical) :-
সবরকম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও আগাছার উপদ্রব দেখা গেলে রাসায়নিক আগাছানাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাসায়নিক আগাছা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সস্তা ও সহজ। তবে ফসল, পরিবেশ ও লক্ষ্য (Target) নয় এমন জীবের স্বাস্থ্যহানি যাতে না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। ফসল ক্ষেতে নির্বচানক্ষম (Selective) আগাছানাশক প্রয়োগ করা উচিত এবং একই রকম রাসায়নিক বার বার ব্যবহার না করে বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা প্রয়োজন। চারা বের হওয়ার আগে বা ঠিক পরই কার্য্যকর হয়, এমন আগাছা নাশক ব্যবহার করলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।