সপ্তম অধ্যায় – তিন মঙ্গলকাব্যের সংক্ষিপ্ত কাহিনি ও তিন বিশিষ্ট কবি

১. সাধারণ আলোচনা

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বৃহত্তম শাখা হল আখ্যানমূলক মঙ্গলকাব্য। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এর কালপর্ব। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বহু জ্ঞাত ও অজ্ঞাত, খ্যাত ও স্বল্পখ্যাত কবিরা মনসামঙ্গল, চণ্ডীমণ্ডল, শিবমঙ্গল (শিবায়ণ), ধর্মমঙ্গল ও রায়মঙ্গল প্রভৃতি অজস্র কাব্য রচনা করেছেন। এইসব কাব্যে নানা সাম্প্রদায়িক দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক কীর্তিকলাপ বর্ণিত হয়েছে। আমাদের পাঠ্য মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গলের কাহিনি এবং এই তিন কাব্যের তিন বিশিষ্ট কবির প্রতিভার পর্যালোচনা।

২. মনসামঙ্গলের কাহিনি

মনসামঙ্গল কাব্যে সর্পদেবী মনসার পুজো প্রচলনের কাহিনি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। মনসা পুজোর সঙ্গে সর্প পুজোর ইতিহাস জড়িত। ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে সর্প পুজো ভূমিকা প্রচলিত ছিল। হিন্দুর দেবী দেবীভাগবত, পদ্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণাদিতে মনসা সর্পকুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ইনি শিবের মানসকন্যা, জরৎকারু মুনির পত্নী, পুত্রের নাম আস্তিক। বৌদ্ধ তন্ত্রসাহিত্যে সর্পদেবতার নাম ‘জাঙ্গুলি’। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষেরা প্রথম সর্পের পুজো আরম্ভ করে। বাংলাদেশে একাদশ-শতাব্দীর পূর্বের ভাস্কর্যশিল্পে দেবী মনসার চিহ্ন পাওয়া গেছে। ইনি সর্পবিভূষিতা। সর্প পুজোর উদ্ভবের কারণ-অরণ্যসংকুল প্রদেশে বসবাসকারী মানুষের সর্পভয়। ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেন সেক্স বা প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসাবেও সাপকে গ্রহণ করা হয়েছে।

শিবের মানসকন্যা বলেই সর্পদেবীর নাম মনসা। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় জাতির পূজিতা মনসা নামের উৎপত্তি সর্পদেবীর নাম ‘মঞ্চাম্মা’ বা ‘মনোমান্ত্রী’। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর মতে মঞ্চাম্মা থেকেই মনসা নামের উদ্ভব। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বৌদ্ধসর্পদেবী জাঙ্গুলিকে মনসার ভিত্তি মনে করেন।

মনসা আসলে অন্-আর্য দেবতা। তিনি পরে আর্যদের অর্বাচীন পুরাণে স্থান পেয়েছেন। শিবের সন্তানলাভের বাসনা থেকে মনসার জন্ম। কালীদহে পদ্মপাতার ওপর জন্ম নিলেন শিবের মানসজাত সুন্দরী কন্যা মনসা। পদ্মপাতায় জন্ম বলে তাঁর এক নাম পদ্মা। পত্নী চণ্ডীর ভয়ে তিনি কন্যাকে ঘরে নিয়ে গেলেন না। মনসা পাতালে আশ্রয় নিলেন। তিনি হলেন সর্পকুলের রানি বা অধিষ্ঠাত্রী দেবী। একদিন ফুল তুলতে গিয়ে শিব পরিত্যক্ত কন্যা মনসার

পরিচয় পেলেন। মনসাকে কৈলালে নিয়ে এলেন। মনসা সৎমা চন্ডীর কাছে দিনরাত প্রচুর প্রহার ও নির্যাতন সহ্য করে। একদিন কুদ্ধা চন্ডী মনসার একটা চোখ প্রচণ্ড আঘাতে কানা করে দিলেন। অশান্তি দূর করার জন্য শিব মনসাকে সিজুয়া পর্বতে রেখে এলেন। কন্যার জন্য শিবের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল। সেই জল থেকে জন্ম নিল সহচরী নেতা। শিব জরুৎকারু মুনির সঙ্গে মনসার বিয়ে দেন। কিন্তু বৈরাগী স্বামী হঠাৎ সংসার ত্যাগ করে চলে গেলেন। স্বামী নেই, সংসারে যন্ত্রণা। আর বাড়িতে থাকা যায় না। তখন সহচরী নেতার পরামর্শে মনসা মর্তধামে নিজ পুজো প্রচারের জন্য সচেষ্ট হলেন।

চম্পকনগরের বিত্তশালী ও সর্বজনমান্য বণিক চাঁদসদাগর। মনসা ভাবলেন তাঁকে দিয়ে পুজো করালে অন্যান্য নিম্নশ্রেণির লোকেরা সহজেই মনসার ভক্ত হবে। স্ত্রী সনকা, ছয় পুত্র ও পুত্রবধূ, দাসদাসী নিয়ে চাঁদের বিরাট সুখের সংসার। তিনি একনিষ্ঠ শিবভক্ত। শিবের বরে ‘মহাজ্ঞান কবচ’ লাভ করেছেন। এর সাহায্যে মৃত ব্যক্তি প্রাণলাভ করে। তাছাড়া বিখ্যাত

সংকর ওঝা তাঁর বন্ধু। চাঁদ সাপকে দুচোখে দেখতে পারেন না।

কাহিনী

হেঁতালের লাঠি দিয়ে সাপ মারেন। চাঁদের কাছ থেকে পুজো আদায় খুবই কঠিন কাজ। জেলে, রাখাল প্রভৃতি সাধারণ মানুস মনসার পুজো করে সুখে আছে জেনে চাঁদবেনের স্ত্রী সনকা গোপনে মনসার ঘট বানিয়ে পূজো করতে লাগলেন। জানতে পেরে পদাঘাতে চাঁদ মনসার ঘট ভেঙে দিলেন। ফলে ক্রুদ্ধ মনসা চাঁদের অনিষ্ট সাধনে ব্রতী হলেন। চাঁদের সুন্দর সুপারি বাগান ধ্বংস হল। মহাজ্ঞানের দ্বারা চাঁদ তা পুনরুদ্ধার করলেন। তখন মনসা কৌশলে শংকর ওঝাকে মেরে ফেলে মোহিনী নারীর বেশে চাঁদের মহাজ্ঞান হরণ করলেন। ভাতে বিষ দিয়ে ছয় পুত্রকে হত্যা করলেন। স্ত্রী ও পুত্রবধূদের কান্নায় হাহাকারে আকাশ ভরে গেল। তবুও চাঁদ এই ভয়ংকর সর্বনাশের মুখে অচল অটল এক পৌরুষমূর্তি-যে হাতে তিনি শিবকে পুজো করেন- সেই হাতে চ্যাংমুড়ি কানি মনসাকে কিছুতেই পুজো দেবেন না। কিছুদিন পরে চাঁদ বাণিজ্য বের হলেন। যাবার সময় সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বলে গেলেন-‘পুত্র হলে নাম থুইও লখিন্দর।’

নদীতে যেতে যেতে কালিদহে মনসার কোপে প্রচণ্ড ঝড় উঠল। সপ্তডিঙা মধুকর ডুবে গেল। চাঁদ জলে হাবুডুবু খেতে লাগলেন। চাঁদ মরে গেলে মনসার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। তিনি চাঁদের সামনে পদ্মফুল ফেলে দিলেন। চাঁদ তা স্পর্শ করলেন না-‘চাঁদ বলে এই পদ্মে মনসার জন্ম/ হেন পদ্ম পরশিলৈ অনেক অধর্ম।’ যাহোক, অনেক দুঃখকষ্ট নির্যাতন ভোগ করে চাঁদ দেশে এলেন। ঘরের অবস্থা শোচনীয়। তবুও আশার কথা-সপ্তমপুত্র লখিন্দর বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে। উপযুক্ত সময়ে উজানি নগরের সায়বেনের নৃত্যগীত পটীয়সী পরমাসুন্দরী কন্যা বেহুলার সঙ্গে লখিন্দরের বিয়ে হল। চাঁদ আগে থেকে জেনেছিলেন সর্পদংশনে লখিন্দরের মৃত্যু অনিবার্য। তাই সান্তালি পর্বতে এক লোহার নিশ্ছিদ্র বাসর ঘর তৈরি করলেন। ওঝারা এসে সর্প আগমনের

প্রতিবন্ধকতায় সচেষ্ট হালেন। সুঃখের বিষয় মনসার নির্দেশে কারিগর বিশ্বকর্মা লোহার বাসরঘরে একটি চুলপ্রমাণ ছিদ্র রেখে দিয়েছিলেন। বাসরঘরে কালীয় নাগের দংশনে লখিন্দর প্রাণ হারাল। চাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। সনকা কাঁদতে কাঁদতে বেহুলাকে কঠিন ভাষায় তিরস্কার করল- ‘খণ্ড কপালিনী বেহুলা চিকুণী-দাঁতি বিভা দিনে খাইলি পতি না পোহাতে রাতি।।’

সব নিন্দা অপমান সহ্য করে বেহুলা বাসরসাজে স্বামীকে নিয়ে অনির্দেশের পথে গাঙ্গুড়ের জলে কলার মান্দাসে ভাসলেন। অনেকের প্রলোভন, লালসা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বেহুলা ভেসে চলেছেন। লখিন্দরের দেহ পচে কঙ্কাল অবশিষ্ট। কোনো কিছুতেই বেহুলা বিচলিত নন। এক নদীর ঘাটে এক ধোপানিকে অদ্ভুত কাজ করতে দেখলেন। দুষ্ট পুত্রকে মেরে ফেলে আবার তাকে বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আসলে মনসার সহচরী নেতা ছদ্মবেশে ধোপানির কাজ করছিল। নেতা বেহুলাকে মনসাদেবীর শরণ নিতে উপদেশ দিলেন এবং স্বর্গে গিয়ে নাচগানে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে অভীষ্ট বর প্রার্থনা করতে বললেন।

নেতার পরামর্শে বেহুলা স্বর্গে পৌঁছে নৃত্যগীতে দেবতাদের সন্তুষ্ট করলেন। দেবতারা বেহুলার দুর্দশার বৃত্তান্ত শুনে মনসাকে ডেকে তাঁর স্বামী ও ভাসুরদের বাঁচিয়ে দিতে বললেন। মনসা একটি শর্তে রাজি হলেন। চাঁদকে দিয়ে তাঁর পূজো করাতে হবে। এই শর্ত মেনে নিয়ে বেহুলা মৃত স্বামী, ছয় ভাসুর, সপ্তডিঙা মধুকর ও সমস্ত হাবানো সম্পদ ফিরে পেলেন। বেহুলা গৃহে ফিরে এলে ভাগ্যহত চাঁদের আনন্দের সীমা নেই। ঠিক সেই মুহূর্তেই অশ্রুকাতর সতীনারী বেহুলার অনুরোধটি এড়াতে পারলেন না। চাঁদ ডান হাত দিয়ে শিবকে পুজো করেন। কাজেই বাম হাত দিয়ে পিছু ফিরে মনসার পুজো করলেন। চাঁদের পুজোর পর মনসার পুজো মর্ত্যে প্রচারিত হল।

৩. চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনি

শিবজায়া দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্যকাহিনি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত। এই দেবী মার্কন্ডেয় পুরাণের মহিষমর্দিনী নন। এই চন্ডী একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ইনি শবরব্যাধ-

ভূমিকা

পূজিতা অষ্টভুজা ও বণিকজাতি-পূজিতা কমলেকামিনী। এই বৈসাদৃশ্যের কারণ তুর্কি আক্রমণোত্তর পৌরাণিক ও লৌকিক সংস্কৃতির সমন্বয়ীকরণ। আর্থীকরণের পূর্বে ভারতবর্ষে অন্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির মধ্যে অরণ্য ও পশুর অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে চণ্ডীদেবীর পুজো প্রচলিত ছিল। অনেকের মতে চন্ডীমঙ্গলের দেবী উক্ত অন্-আর্যদের পূজিতা দেবী।

সমন্বয়ীভাব

আবার অনেক পণ্ডিত একথা মানতে চাননি। তাঁদের মতে মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর

লৌকিক রূপান্তর ঘটেছে মঙ্গলকাব্যে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে-বাংলার লৌকিক দেবদেবী হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের যুগে হিন্দুভাবাপন্ন তন্ত্র বা পুরাণ কর্তৃক প্রভাবিত। চন্ডী বা মঙ্গলচণ্ডী তাঁদের অন্যতম। সেজন্য তন্ত্র বা পুরাণ ও স্মৃতিতে নানাভাবে তাঁর সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য সাধনের প্রয়াস দেখা যায়।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, দেবী ভাগবত ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ প্রভৃতিতে দেবীর আরাধনার পদ্ধতি বর্ণনা প্রসঙ্গে ব্যাধ কালকেতু ও শালবাহন নৃপতি প্রভৃতি চণ্ডী পূজকদের উল্লেখ আছে। সুতরাং মঙ্গলকাব্যের চন্ডী লৌকিক ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে পৌরাণিক ধর্মের মিলনজাত মিশ্রফল। বর্তমানে ছোটনাগপুরের ‘ওরাও’ জাতির মধ্যে ‘চণ্ডী’ নাম্নী দেবীপুজো প্রচলিত। সাঁওতাল সমাজে চন্ডী (চণ্ডী) দেবী ভয়ংকর। এই চন্ডীর কালচন্ডী, শশ্মশান চণ্ডী ও শুকাম চণ্ডী প্রভৃতি সাতটি পরিচয় রয়েছে। ওরাওঁ এবং সাঁওতাল জাতির সঙ্গে বাঙালি জাতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। চন্ডীমঙ্গাল কাব্যের দেবী চন্ডীকার উদ্ভব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘পশুবলি প্রভৃতির দ্বারা যে ভীষণ পূজা এককালে ব্যাধের মধ্যে প্রচলিত ছিল, সেই পূজাই কালক্রমে উচ্চসমাজে প্রবেশলাভ করে। সুতরাং, মঙ্গলকাব্যের চণ্ডীর পশ্চাতে অন-আর্য লৌকিক সংস্কৃতি অধিক পটভূমি সৃষ্টি করেছে।’

চন্ডীমঙ্গলের দুটি কাহিনি: প্রথমটি হল কালকেতু ও ফুল্লরা কাহিনি। দ্বিতীয়টি হল ধনপতি ও খুল্লনার কাহিনি। প্রথম কাহিনিটি প্রাচীন।

  • এক. কালকেতু ও ফুল্লরা: পাগল ও দরিদ্র শিবের ঘরে উত্যক্ত চন্ডী পদ্মার পরামর্শে মর্তে নিজেরা পুজো প্রচারে মনস্থ করলেন। চন্ডীর কৌশলে নিরপরাধ শিবপুজোর পুষ্পচয়নকারী নীলাম্বরকে শাপভ্রষ্ট করলেন শিব। নীলাম্বর মর্তে ব্যাধের গৃহে ধর্মকেতুর পুত্র কালকেতুরূপে জন্মগহণ করলেন। তাঁর পত্নী ছায়া মর্তে ব্যাধকন্যা ফুল্লরারূপে জন্মগ্রহণ করলেন। বড়ো হয়ে কালকেতু রূপেগুণে পরাক্রমে ব্যাধ জাতির নেতা হয়ে উঠল। রূপসি ফুল্লরার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল। কালকেতু বন থেকে কাঠ ও পশুপক্ষী শিকার করে আনে। ফুল্লরা গৃহে গৃহে হাটে মাংস বিক্রি করে। মোটামুটি স্বচ্ছলভাবে সংসার চলে। কালকেতুর বৃদ্ধ পিতামাতা কালকেতুর উপর সংসার ছেড়ে বারাণসী চলে যায়। কালকেতু পশু শিকার করে সংসার চালায়। তার অত্যাচারে বনের পশুরা দেবী চণ্ডীর কাছে বরাভয় প্রার্থনা করল। তখন পশুগণকে অভয় দিয়ে দেবী- ‘সেইখানে সুবর্ণ গোধিকা রূপ হৈলা।’ কালকেতু বনে গিয়ে শিকার পেল না। পথে দেখল স্বর্ণ-গোধিকা-অশুভ লক্ষণ। বিরক্ত হয়ে কালকেতু-‘নকুল বদলে তোমা খাইব’- বলে সাপটিকে ধনুকের ছিলায় বেঁধে নিয়ে বাড়িতে এল। সেটিকে খুঁটিতে বেঁধে কালকেতু বাসি মাংস নিয়ে গেল বাজারে; আর ফুল্লরা গেল প্রতিবেশীর নিকট খুদ ধার করতে। এই নির্জন অবসরে দেবী চণ্ডী গোধিকারূপ পরিত্যাগ করে অপরূপ সুন্দরী বেশে ঘরের দাওয়ায় বসে রইল। ফুল্লরা ফিরে এলে দেবী বললেন- ‘এনেছে তোমার স্বামী বাঁধি নিজ গুণে।’ ফুল্লরা অনেক কাকুতিমিনতি করে তাদের বারোমাসের দারিদ্র্যের বর্ণনা দিয়ে দেবীকে বিদায় করতে ব্যর্থ হয়ে স্বামীকে খবর দিতে বাজারে গেল। স্ত্রীর কাছে সব শুনে বিস্মিত কালকেতু ঘরে এসে দেখে ঘটনা সত্যি। সে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়েও দেবীকে বিদায় করতে পারল না। অবশেষে রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য ধনুকে শর যোজনা করতেই দেবী স্বমূর্তি ধারণ করে বললেন- ‘আমি চণ্ডী আইলাম তোরে দিতে বর।’ আর নির্দেশ দিলেন- ‘পুজিবে মঙ্গলবারে পাতাইবে জাত, গুজরাট নগরের তুমি হবে নাথ।’

দেবী কালকেতুকে সাতঘড়া ধন ও বহুমূল্যের একটি আংটি দিলেন। ধূর্ত বণিক মুরারিশীল সেই আংটি নামমাত্র মূল্যে কিনতে গিয়েছিল, কিন্তু কালকেতুর প্রতি দেবীর কৃপায় ব্যর্থ হল। কালকেতু বিপুল অর্থ দিয়ে বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করলেন। হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে নানা জাতির বসতি গড়ে উঠল। ভাঁড় দত্ত নামে এক ধূর্ত ছিল। ভাঁড়র মাতব্বরি, শঠতা ও অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে অন্যান্য প্রজারা কালকেতুর কাছে নালিশ জানালে কালকেতু তাকে তাড়িয়ে দিলেন, অপমানিত ভাঁড়ু কলিঙ্গরাজকে উত্তেজিত করে যুদ্ধে নামিয়ে দিল। কালকেতু বন্দি হল। কলিঙ্গ কারাগারে অশেষ দুঃখে কালকেতু চণ্ডীর স্তব করে। কলিঙ্গ রাজ্যে দেবী বন্যার সৃষ্টি করলেন। স্বপ্নে রাজাকে ভয় দেখালেন যে শীঘ্র কালকেতুকে মুক্তি না দিলে তার কলিঙ্গ রাজ্য ধ্বংস হবে। কালকেতু চণ্ডীর বরপুত্র জেনে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্তি দিলেন। রাজ্যও ফিরিয়ে দেওয়া হল। ভাঁড় দত্তের মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে রাজ্য থেকে তাড়ানো হল।

কালকেতু মহাসমারোহে দেবীর পুজো করলেন। পরম শান্তিতে দীর্ঘকাল রাজ্য শাসনের পর কালকেতু ও ফুল্লরা পুত্রকে রাজ্যভার দিয়ে শাপান্তে নীলাম্বর ও ছায়ারূপে ইন্দ্রের রথে চড়ে স্বর্গে ফিরে গেলেন। পৃথিবীতে দেবী চণ্ডীর পুজো প্রচালিত হল।

  • দুই, ধনপতি ও খুল্লনা দেবী চন্ডী মর্তে পুজো প্রচারের জন্য কৌশলে স্বর্গনর্তকী রত্নমালাকে অভিশাপগ্রস্ত করেন। দেবী রত্নমালা মর্তে লক্ষপতি বণিকের ঘরে অপরূপ সুন্দরী কন্যা খুল্লনারূপে জন্ম নেন। তাঁর গর্ভে অভিশপ্ত গন্ধর্ব মালব্য শ্রীমন্ত নাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই শ্রীমন্তের সাহায্যে মর্তে দেবী চণ্ডীর পুজো প্রচারিত হয়।

উজানি নগরের ধনাঢ্য বণিক ধনপতির স্ত্রী লহনা নিঃসন্তানা। ধনপতি একদিন অপরূপ লাবণ্যে ভূষিতা খুল্লনাকে দেখে বিমুগ্ধ হলেন। লহনাকে বস্ত্র ও অলংকার দিয়ে তার সম্মতি নিয়ে ধনপতি বিয়ে করলেন। দুই স্ত্রী নিয়ে সুখে শান্তিতে ধনপতির দিন কাটতে লাগল। কিছুদিন পরে দেশের রাজার আদেশে স্বর্ণপিঞ্জর আনার জন্য ধনপতিকে গৌড়ে যেতে হল। খুল্লনার ভার দিয়ে গেলেন লহনার উপর। দাসী দুর্বলার কুপরামর্শে লহনা স্বামীর লেখা বলে এক জাল চিঠির মর্ম খুল্লনাকে জানিয়ে তার সব বস্ত্র ও অলংকার ছাড়িয়ে নিল। বনে ছাগল চরিয়ে, ঢেঁকিশালে আধপেটা খেয়ে খুল্লনাকে দিন কাটাতে হল। একদিন বনে ‘সর্বশ্রী’ নামে ছাগলটি হারিয়ে যায়। সেটাই খুঁজতে গিয়ে খুল্লনা চণ্ডীপ্রেরিত পঞ্চদেবকন্যাকে দেখতে পায়। তাদের কাছ থেকে চন্ডীপুজো করতে শেখে এবং ভক্তিভরে চণ্ডীপুজো করে। দেবী আবির্ভূতা হয়ে তাকে স্বামীপুত্রলাভে বর দিলেন। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে লহনাও খুল্লনার সঙ্গে ভালো ব্যবহার শুরু করল। ঘরে ফিরে ধনপতি সব শুনে লহনাকে খুব তিরস্কার করলেন। খুল্লনা স্বামীর আস্থা ও প্রীতি ফিরে পেলেন।

এরপর রাজ আজ্ঞায় চন্দন লবঙ্গ ও নীলা প্রভৃতি আনার জন্য ধনপতিকে সিংহলে যেতে হল। যাবার আগে স্বামীর কল্যাণের জন্য খুলনা গোপনে চন্ডীর পুজো করে। এ ব্যাপার জানতে পেরে শৈবসাধক ধনপতি ক্রোধে পদাঘাতে চণ্ডীর ঘট ভেঙে দিলেন। সপ্তডিঙা নিয়ে ধনপতি সমুদ্রে ভেসে চলেছেন। চণ্ডী তার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের মানসে সমুদ্রবক্ষে প্রবল ঝড় তুললেন। ছয়টি ডিঙা ডুবে গেল। কোনোক্রমে একটি ডিঙা নিয়ে ধনপতি সিংহলের পথে কালিদহে এসে পৌঁছোলেন। সেখানে চণ্ডী তাকে কমলেকামিনীরূপে এক অদ্ভুত দৃশ্যে দেখা দিলেন। ভাসমান এক শতঙ্গল পদ্মের উপর এক সুন্দরী নারী একটি বড়ো হাতিকে একবার গিলছে আবার উদ্গিরণ করছে। ধনপতি সিংহলে পৌঁছে এই অলৌকিক কমলেকামিনীর কথা রাজাকে জানালে তিনি বিশ্বাস করলেন না। ধনপতি প্রতিজ্ঞা করলেন-সেই দৃশ্য দেখাতে না পারলে বারো বছর সিংহল কারাগারে কাটাবেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে ব্যর্থ হন। মিথ্যাবাদী বলে কুদ্ধ সিংহলরাজ ধনপতিকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। স্বপ্নে আবির্ভূতা হয়ে চণ্ডী ধনপতিকে তাঁর পুজো করতে বললেন-ধনপতি রাজি হলেন না। এদিকে শ্রীমন্ত বড়ো হয়েছে। পাঠশালায় গুরুমশায় তার জন্ম সম্পর্কে কটাক্ষ করলে শ্রীমন্ত মাতার কাছে সব বিবরণ শুনে পিতৃ অন্বেষণে সপ্তডিঙা নিয়ে সিংহল যাত্রা করলেন। তিনিও কালিদহে সেই কমলেকামিনী দৃশ্য দেখলেন। শ্রীমন্তও পিতার মতো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সিংহলরাজকে সেই দৃশ্য দেখাতে পারলেন না। শ্রীমন্তের শর্ত অনুযায়ী শ্মশানে তার শিরশ্ছেদের ব্যবস্থা করা হল। এদিকে মাতা পুত্রের কল্যাণে চন্ডীর ধ্যান করেন, আর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শ্রীমন্ত চণ্ডীর স্তব করতে লাগল। দেবী বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর বেশে ভক্তকে উদ্ধার করলেন। দেবীর ভূতপ্রেত সিংহল রাজার সব সৈন্য ধ্বংস করল। সিংহলরাজ সমস্ত ব্যাপার বুঝতে পেরে ধনপতি ও শ্রীমন্তকে মুক্তি দিলেন এবং নিজ শর্ত অনুযায়ী শ্রীমন্তকে অর্ধেক রাজ্য এবং একমাত্র কন্যা সুশীলার সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। তারপর চণ্ডীর প্রসাদে সিংহলরাজকে কমলেকামিনী দর্শন করালেন। রাজা শালিবাহন চন্ডীর পুজো করতে মনস্থ করলেন। কিছুদিন সিংহলে বসবাসের পর পুত্র ও পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে স্বদেশে ফিরে এলেন ধনপতি। চণ্ডীর পুজো হল মহাধুমধামে। চণ্ডীর পুজো দেশে প্রচারিত হল। বাকি জীবন স্ত্রী-পুত্রবধূসহ সুখে কাটিয়ে শাপান্তে ধনপতি স্বর্গে ফিরে গেলেন।

৪. ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি

ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য ও তাঁর পুজো প্রচারের কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে ধর্মমঙ্গল কাব্য।

পুরাণের ধর্মরাজ যম, বৌদ্ধদেবতা বা সূর্যদেবতা অনার্যদের চিন্তা কল্পনায় ধর্মঠাকুরে রূপান্তরিত।

ইনি অনার্য কল্পনাপ্রসূত আদিবাসীদের পুরুষ দেবতা। কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গো নানাধর্মের

সমন্বয় ঘটেছে ধর্মঠাকুরের মধ্যে। ইনি প্রাক্-আর্য কৌমধারার দেবতা। ক্রমান্বয়ে শিব, বিন্নু, সূর্য,

বরুণ, কুর্ম, কল্কি এমনকি ইসলামীয় ধর্মের সঙ্গে মিশে ইনি নবরূপ লাভ করেছেন। বিভিন্ন

ভাবধারার বিবিধ তত্ত্ব ও তথ্য, ধর্মবিশ্বাস ও অনুষ্ঠান পদ্ধতির সমন্বয় সাধিত হওয়ায় ধর্মঠাকুর সর্বাত্মক ধর্মের নির্বিশেষ প্রতিভূ রূপে চিহ্নিত। এই দেবতার কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই। প্রস্তরখণ্ডে ধর্মঠাকুরের আকৃতি পাদুকা চিহ্নিত কূর্মাকৃতি, কোথাও ডিম্বাকৃতি, আবার কোথাও পিতলের চক্ষুযুক্ত প্রতীকী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ধর্মঠাকুরকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ দেবতা বলেছেন। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য এঁকে আদিম জাতি পূজিত সূর্যদেবতা বলে প্রমাণ করতে প্রয়াসী। ভাষাতত্ত্ববিদ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ধর্ম শব্দ প্রাচীন কুর্মবাচক অস্ট্রিক ‘দড়ম’ শব্দের সংস্কৃতায়িত রূপ বলে মনে করেন। তাঁর মতে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রাচীন দক্ষিণ জাতির লোকের মধ্যে প্রচলিত ধর্মের বিকৃত অবশেষ এই ধর্মঠাকুর। যা হোক, ধর্মদেবতা আদিতে যেভাবেই থাকুন না কেন নানা ধর্মের সমন্বয়ে ইনি বর্তমানে মিশ্রদেবতায় পরিণত হয়েছেন। এঁর কোনো বিশেষ অবয়ব নেই। শিলামূর্তিতে বিভিন্ন নামে ইনি পূজিত হন।

ধর্মঠাকুরের পুজো রাঢ় দেশে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে সুপ্রচলিত। ধর্মপুজোর পুরোহিতদের মধ্যে নিম্ন শ্রেণির ডোম, হাড়ি, কৈবর্ত, বাগদি ও শুঁড়ি প্রভৃতি প্রসিদ্ধ। ব্রাহ্মণ পূজারি খুবই কম। পূজারিরা পণ্ডিত উপাধি ধারণ করেন। ধর্মঠাকুর ফসল উৎপাদনের দেবতা, নারীর বন্ধ্যাত্ব ঘোচাবার দেবতা ও কুষ্ঠব্যাধি নিরাময়ের দেবতা। ধর্মঠাকুরের কাছে ছাগ, হাঁস, মুরগি ও শূকর প্রভৃতি বলি দেওয়া হয়। এই দেবতা অঘটন ঘটন পটীয়সী অলৌকিক শক্তির অধিকারী ও একান্ত ভক্তবৎসল। এই দেবতার ‘ভক্তরা’ বঁটি ও আগুনের উপর ঝাঁপ দিয়ে হাত পা বুকে শূল বিদ্ধ করে লোহার কাঁটার উপর গড়াগড়ি দিয়ে হাজার হাজার দর্শকের

সামনে পুজো নিষ্পন্ন করে।

ধর্মঠাকুর মূলত অস্ট্রিক কল্পনাজাত দেবতা। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য এবং ইসলামীয় সংস্কৃতি ধর্মঠাকুরের ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। তাই ধর্মমঙ্গলকাব্যে বর্ণবিরোধ নেই, দেব মানবের প্রবল হিংসা নেই-আছে উচ্চ ও নিম্নবর্ণের মেলামেশা ও আচার-সংস্কারের সহযোগিতার ভাব। ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমিতে রাঢ় বঙ্গের ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র ও জনজীবনের চিত্র প্রতিবিম্বিত। পাঠান, মোগল ও বর্গি প্রভৃতি বিদেশি শক্তির প্রতিরোধে বাঙালির শৌর্যবীর্যের পরিচয় এই কাব্যে প্রতিফলিত। সেজন্য ডা. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ধর্মমঙ্গলকে রাঢ় দেশের National epic বা জাতীয় মহাকাব্য নামে অভিহিত করেছেন।

ধর্মমঙ্গলকাব্যের নায়ক লাউসেন ও ইছাই ঘোষ ছাড়া অন্যান্য নরনারী দেবতা- সম্পর্কহীন সাধারণ মানুষ। আত্মশক্তির উপর নির্ভর করেই তারা জীবন সমস্যার সামনে এসে অগ্রসর হয়েছে। কালু ডোম, লখাই ডোমনি প্রভৃতি তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণির নরনারী এবং কলিঙ্গ ও কানাডা প্রভৃতি অভিজাত বংশের নারীরা সবাই প্রবল শৌর্য ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। on

ধর্মঠাকুরের পুজো উপাসনা প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত থাকলেও ধর্মমঙ্গল কাব্যের উদ্ভব ষোড়শ শতাব্দীতে। কাব্যটি বীররসাত্মক ও যুদ্ধবিগ্রহে পরিপূর্ণ এবং পুরুষ চরিত্র

অপেক্ষা স্ত্রী চরিত্রগুলি বেশি জীবন্ত ও ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যে ধর্মঠাকুর সংক্রান্ত রচনাগুলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক। রামাই পণ্ডিতের শূন্য পরান ও ধর্মপুজোর বিধিবিধান। দুই ধর্মমঙ্গল কাহিনি কাব্য।

ধর্মমঙ্গল কাব্যে দুটি কাহিনি সন্নিবেশিত। একটি হল পুরাণকেন্দ্রিক রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি, অন্যটি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বীর লাউসেনের কাহিনি।

প্রথম কাহিনিটি খুব প্রাচীন। রাজা হরিশচন্দ্র ও রানি মদনা নিঃসন্তান ছিলেন। ফলে তাঁদের অনেক বিদ্রূপ ও তিরস্কার সহ্য করতে হত। মর্মান্তিক দুঃখে রাজা-রানি ঘুরতে ঘুরতে একদিন এক নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলেন। দেখতে পেলেন সেখানে ভক্তরা ধর্মঠাকুরের পূজার্চনায় রত। তাঁদের কাছে ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য শুনে পুত্রলাভের আশায় রাজা-রানি ভক্তিভরে ধর্মঠাকরের আরাধনা করলেন। পুজোয় সন্তুষ্ট ধর্মঠাকুর পুত্রলাভের বর দিলেন একটি শর্তে। পুত্র জন্মালে যথাসময়ে তাঁকে ঠাকুরের কাছে বলি দিতে হবে। পুত্রমুখ দেখার আশায় রাজা হরিশচন্দ্র সেই প্রস্তাবে রাজি হলেন। ধর্মঠাকুরের বরে রানি পুত্রবর্তী হলেন। ধর্মের বরপুত্রের নাম রাখা হল লুই ধর। সে বড়ো হয়ে উঠল। রাজা রানি প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন। একদিন ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তাঁদের বাড়িতে এলেন। সেদিন একাদশীর ব্রত। রাজা ব্রাহ্মণকে ইচ্ছামতো খাবার দিতে চাইলেন। আর যায় কোথায়! ছদ্মবেশী ধর্মঠাকুর লুই ধরের মাংসাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজা প্রচণ্ড বেদনা সত্ত্বেও অবিচলিত চিত্তে লুই ধরকে কেটে মাংস রান্না করলেন। রাজার নিষ্ঠায় অত্যন্ত খুশি হয়ে ধর্মঠাকুর লুই ধরকে পুনর্জীবিত করলেন। মহাসমারোহে রাজা-রানি ধর্মঠাকুরের পুজোর আয়োজন করলেন।

ধর্মমঙ্গলের দ্বিতীয় কাহিনি গড়ে উঠেছে লাউসেনের বীরত্বকে কেন্দ্র করে। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো এখানের প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় চেতনা সুস্পষ্ট। ধর্মঠাকুর মর্তে পুজো প্রচারের জন্য উৎসুক। সে সুযোগ এসে গেল। স্বর্গের নৃত্যসভায় নর্তকী জাম্ববতীর তাল ভঙ্গ হওয়ায় শাপভ্রষ্ট হয়ে তিনি মর্তে বমতি নগরে বেণুরায়ের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করলেন। নাম হল রঞ্জাবতী। রঞ্জাবতীর বড়দি গৌড়েশ্বরের পাটরানি। আর বড়ো ভাই মহামদ গৌড়েশ্বরের মন্ত্রী।

ঢেকুরগড়ের অধিপতি কর্ণসেন গৌড়েশ্বরের অধীনে সামন্ত রাজা ছিলেন। ইছাই ঘোষ গৌড়েশ্বরের আর এক সামন্ত। সে চন্ডীর বরপুত্র। অসীম তার শক্তি। সে প্রচন্ডভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে গৌড়েশ্বরের নির্দেশে তাকে দমন করতে গিয়ে কর্ণ সেন পরাজিত হলেন। ছয় পুত্র ও পুত্রবধূরা যুদ্ধে মারা গেলেন। কর্ণসেন অত্যন্ত কারত হয়ে পড়লেন। বৃদ্ধ সামন্তরাজ কর্ণসেনের সঙ্গে গৌড়েশ্বর নিজ শ্যালিকা রঞ্জাবতীর বিয়ে দিলেন। বিয়ের পর কর্ণসেন রঞ্জাবতীকে নিয়ে ময়নাগড়ে নতুন সামন্ত পদে অধিষ্ঠিত হলেন।

বৃদ্ধ কর্ণসেনের বিবাহে মহামদের ঘোরতর আপত্তি ছিল। সে অত্যন্ত রুদ্ধ হয়ে উঠল। সামনাসামনি গৌড়েশ্বরকে কিছু বলার তার সাহস ছিল না। তাই সে কর্ণসেনের সঙ্গে শত্রুতা শুরু করল। কর্ণসেনকে আঁটকুড়া বা পুত্রহীন বলে বিদ্রূপ করল। ক্ষোভে দুঃখে অভিমানে রঞ্জাবতী খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন।

একদিন রাজপথ দিয়ে ধর্মঠাকুরের গাজন উৎসবের মিছিল যাচ্ছিল। পুরোহিতকে ডেকে রঞ্জাবতী ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্যের কথা বিশদভাবে জানালেন। ধর্মঠাকুরের পুজোয় অপুত্রকের পুত্রলাভ হয়। রঞ্জাবতী কঠোর কৃচ্ছসাধন শুরু করলেন। কণ্টকশয্যায় তাঁর শরীর ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে গেল। শালে ভর দিয়ে প্রাণ দিতে উদ্যত হলেন। অবশেষে ধর্মঠাকুর আবির্ভূত হয়ে তাঁকে পুত্রবর দিলেন। যথাসময়ে রঞ্জাবতীর গর্ভে জন্ম নিল স্বর্গের শাপভ্রষ্ট এক দেবতা। নাম লাউসেন। এই সংবাদে গৌড়েশ্বর খুবই খুশি হলেন। কিন্তু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মহামদ। লাউসেনের অনিষ্ট করার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। তাঁর নির্দেশে ইন্দা মেটে নামে এক অনুচর লাউসেনকে অপহরণ করল। পুত্রশোকে রঞ্জাবতী পাগল হয়ে উঠল। ধর্মঠাকুর কপূরবিন্দু থেকে এক শিশু তৈরি করে তাঁর কোলে দিলেন। নাম হল কপূর ধবল। আর অচিরে ধর্মঠাকুরের আজ্ঞায় হনুমান লাউসেনকে উদ্ধার করে এনে রঞ্জাবতীর কোলে তুলে দিল। রঞ্জাবতী হলেন দুই পুত্রের মা।ী কাটে চলেীপ তি চেতনা তেন

লাউসেন বড়ো হয়ে লেখাপড়া ও অস্ত্রবিদ্যায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করল। মল্লবিদ্যায় কেউ তাঁর সঙ্গে পেরে ওঠে না। গৌড়েশ্বরের কাছে নিজের বীরত্ব দেখিয়ে খ্যাতি অর্জনের জন্য একদিন লাউসেন ভাই কপূর ধবলকে নিয়ে গৌড় যাত্রা করল। পথে বাঘ, কুমির প্রভৃতি হিংস্র পশুদের বধ করল। ভ্রষ্টা রমণীদের প্রলোভন এড়িয়ে লাউসেন নৈতিক শুচিতার পরিচয় দিলেন। তাঁর খ্যাতি বেড়ে গেল।

গৌড়ে পৌঁছেই মহামদের চক্রান্তে লাউসেন কারারুদ্ধ হলেন। কিন্তু শীঘ্রই বাহুবল দেখিয়ে গৌড়েশ্বরকে সন্তুষ্ট করে কারামুক্ত হলেন। প্রচুর পুরস্কারসহ ময়নাগড়ের ইজারা পেলেন। দেশে ফেরার পথে কালু ডোম ও পত্নী লখ্যার সঙ্গে লাউসেনের বন্ধুত্ব হল। লাউসেন এদের নিয়ে ফিরলেন ময়নাগড়ে। কালু হল তাঁর সেনাপতি। এদিকে মহামদ চুপ করে বসে থাকার লোক নন। তাঁর চক্রান্তে গৌড়েশ্বর কামরূপরাজকে দমন করার জন্য লাউসেনকে পাঠালেন। মহামদ ভেবেছিলেন যুদ্ধে লাউসেনের মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু লাউসেন কামরূপরাজকে হারিয়ে তাঁর কন্যা কলিঙ্গকে বিয়ে করে দেশে ফিরলেন। মহামদ এতে জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল। তাঁর চক্রান্তে গৌড়েশ্বর লাউসেনকে নিয়ে শিমুল রাজ্য আক্রমণ করলেন এবং লোহার গণ্ডার কেটে লাউসেন শিমুলরাজ হরিপালের কন্যা কানাড়াকে বিয়ে করলেন। আবার মহামদের চক্রান্তে অজয় নদের তীরে ইছাই ঘোষের সঙ্গে লাউসেনের তুমুল যুদ্ধ বাধল। ধর্মঠাকুরের কৃপায় লাউসেন বিজয়ী হলেন। যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হল ইছাই ঘোষ। এবার অন্যভাবে মহামদ লাউসেনকে জব্দ করতে সচেষ্ট হলেন। গৌড়েশ্বরকে দিয়ে আদেশ

করালেন, লাউসেন যদি ধর্মের বরপুত্র তবে দেখাক না পশ্চিমে সূর্যোদয়। না পারলে শান্তি মৃত্যু। ‘হাকন্দ’ নামক স্থানে ধর্মঠাকুরের তপস্যা করে এই অসাধ্য সাধন করলেন লাউসেন। লাউসেনের হাকন্দে তপস্যার সুযোগে মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করে। যুদ্ধে পুত্র পত্নীসহ কালুরায় মারা যায়। লাউসেনের প্রথমা স্ত্রী কলিঙ্গাও নিহত হন। কিন্তু অবশেষে বীরাঙ্গনা কানাড়ার হাতে মহামদ পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হন। লাউসেন দেশে ফিরে ধর্মঠাকুরের স্তব শুরু করলেন। ঠাকুরের কৃপায় সবাই বেঁচে উঠল। মর্তে ধর্মঠাকুরের পুজো প্রচারিত হল। এদিকে মহাপাপের জন্য মহামদের কুষ্ঠ ব্যাধি হল। দয়াপরবশ হয়ে লাউসেন ধর্মঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করায় মহামদ কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্ত হল। ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার করে পরম গৌরবে কিছুকাল রাজত্ব করে স্বর্গারোহণ করলেন লাউসেন। পুত্র চিত্রসেন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন।

লাউসেনের কাহিনি পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। রাঢ়ভূমি পশ্চিমবঙ্গের প্রবেশদ্বার ছিল। এই অঞ্চলকে বীরভূমি বলা হয়। এখানকার মানুষকে বার বার পাঠান, মোগল ও বর্গি প্রভৃতি বৈদেশিক শক্তির আক্রমণের সম্মুখে দাঁড়াতে হয়েছে। দেশের মানুষের বীরত্ব, সাহস ও স্বদেশপ্রেমের পরিচয় ইতিহাসে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছে। লাউসেনের বীরত্ব ও কার্যকলাপের মধ্যে জাতির সেই শক্তিমত্তার ইতিহাস বিধৃত। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যে হিন্দু যোদ্ধা নারী ও পুরুষের বীর্যবত্তার কাহিনি ধর্মমঙ্গলেই স্থান পেয়েছে।

৫. চন্ডীমঙ্গলকাব্যের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মানিক দত্ত, দ্বিজমাধব, মুকুন্দরাম, মুক্তারাম সেন, জয়নারায়ণ সেন, ভবানীশংকর ও আরও অনেকে চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। তাঁদের সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভাশীল কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মঙ্গলকাব্যের প্রচলিত কাহিনির মধ্যে তিনি মৌলিক সৃজনীশক্তি ও অভিনব কলানৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেবতার মহিমাকাহিনি লিখতে বসে তিনি আমাদের চিরপরিচিত এই লৌকিক সংসারে সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না বিজড়িত মানব-মানবীর

ভূমিকা

জীবনচিত্রকেই পরম শ্রদ্ধাসহকারে পরিস্ফুট করেছেন। অপরিমেয় মানবরসের শিল্পসৌকর্য সৃষ্টিতে ও মানবতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি আধুনিক জীবনচেতনার সিংহদ্বারে এসে পৌঁছেছেন। মুকুন্দরামের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। কবি যে কাহিনি

আত্মপরিচয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে পরস্পরবিরোধী তথ্যের সন্নিবেশ ঘটেছে। আত্মপরিচয়টি সংক্ষেপে এই-বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে সাতপুরুষের বসবাস ছিল। পিতামহ জগন্নাথ

  • এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সব পুথিতে মুকুন্দ চক্রবর্তী-র নাম পাওয়া গেছে। কিন্তু ‘মুকুন্দরাম’ নামটি বহুল পরিচিত হয়ে গেছে।

মিশ্র, পিতা হৃদয় মিশ্র, মাতার নাম দৈবকী, কবিচন্দ্র দাদা। কবি চণ্ডীর স্বপ্নাদেশে কাব্য রচনা করেন। চাষবাষই ছিল কবিদের জীবিকা। দামুন্যার তালুকার গোপীনাথ নন্দীর জমি ভোগ আধাপরিচয় করতেন। বেশ শান্তিতেই কবির দিন কাটছিল। এমন সময় দারুণ রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হল। গৌড়বঙ্গ উৎকলের অধিকর্তা সুশাসক মানসিংহের সুবেদারির কালে ডিহিদার অর্থাৎ পরগনার শাসনকর্তা মামুদ শরিফের অত্যাচারে দেশের শান্তি নষ্ট হল। অত্যাচারে গ্রামের লোকেরা সাতপুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে দেশান্তরী হতে লাগল। কবিও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে নিয়ে পথে বের হলেন। পথে গোপড়িয়া গ্রামের এক পুকুরপাড়ে স্নান সেরে কবি শালুক পোড়া দিয়ে গৃহদেবতার পুজো করলেন। পরিশ্রমে ক্লান্ত ও ক্ষুধা তৃয়ায় কাতর কবি ঘুমিয়ে পড়লেন। আর স্বপ্নে দেবী চণ্ডী তাঁকে কাব্য লিখতে নির্দেশ দিলেন- ‘মা কৈল পরম দয়া/দিল চরণের ছায়া/আজ্ঞা দিল রচিতে কবিত্ব।’ স্বপ্নকে দেবীআজ্ঞা বলে শিরোধার্য করে আবার পথ হাঁটতে শুরু করলেন। শেষে মেদিনীপুরের ব্রাহ্মণভূমির জমিদার বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় পেলেন। বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায়ের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন কবি- ‘সুধন্য বাঁকুড়া রায়/ভাঙ্গিল সকল দায়/শিশুপাঠে কৈলা নিয়োজিত।’ বাঁকুড়া রায়ের মৃত্যুর পর রঘুনাথ জমিদারিতে বসলেন। তাঁরই অনুরোধে কবি মুকুন্দরাম চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন এবং রঘুনাথ কবিকে কবিকঙ্কণ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। মুকুন্দরামের কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’। কবিকঙ্কণ চণ্ডী নামেও এটি অভিহিত। মুকুন্দরামের আত্মজীবনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এতে সমকালীন রাষ্ট্রিক ইতিহাস ও

বাস্তব সমাজচিত্র এবং কবির ব্যক্তিগত দুঃখ-দুর্দশাময় জীবনের অকৃত্রিম পরিচয় লিপিবদ্ধ। আবির্ভাব কিন্তু মুশকিল হয়েছে তাঁর আবির্ভাব কাল ও গ্রন্থ রচনার তারিখ নিয়ে।

কবি গ্রন্থ রচনার কালজ্ঞাপক যে পরিচয় দিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায় ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে- ‘শাকে রস রসে বেদ শশাঙ্ক গণিতা। কতদিনে দিলা গীত হরের বণিতা।’ কাব্যরচনার কাল নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তবে পণ্ডিতেরা অনুমান করেছেন মুকুন্দরাম ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। মুকুন্দরামের আত্মপরিচয়ে তৎকালীন দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিশ্বস্ত পরিচয় মেলে। রচনাটি সরস ও সাহিত্য গুণান্বিত।

চন্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রবেশক হিসাবে এটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ‘অম্বিকামঙ্গল’, ‘গৌরীমঙ্গল’ ও ‘অভয়ামঙ্গল’ নামগুলি পাওয়া যায়, তবে সাহিত্যের আলোচনায় ‘অভয়ামঙ্গল’ই অধিক ব্যবহৃত। মুকুন্দরাম

কাব্য-বৈশিষ্ট। পূবর্তন কাহিনিকেই নবতর রূপদান করেন। তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব মানুষের

কাহিনির মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি। তৎকালীন সমাজের প্রতি বাস্তব দৃষ্টি নিয়ে অসীম কৌতূহল ও শ্রদ্ধাসহকারে দারিদ্র্য লাঞ্ছিত মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনযাত্রার তিনি

নিখুঁত ছবি এঁকেছেন। আর এই জীবনের কাহিনি রূপায়ণে তিনি হুবহু বাস্তবকেই সোজাসুজি তুলে ধরে ানি, বাস্তবকে কল্পনার অনুভূতিতে রসাশ্রিত করে তুলেছেন। কবির উদার মনোভাবের

জন্যই উেচ্চনীচ, ভদ্র-অভদ্র, সাধু-ভণ্ড, হিন্দু-মুসলমান সকল শ্রেণির চরিত্রের লীলারস তিনি নিরপেক্ষ সমাজসচেতন শিল্পীর মতো উপলব্ধি করে তাঁদের চরিত্র চিত্রণে প্রয়াসী হন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আরোপ ও জীবনরসের প্রাচুর্যে মুকুন্দরাম মধ্যযুগের মাটিতে দাঁড়িয়েও আধুনিক মানবধর্মের প্রবক্তা। কারোর প্রতি তাঁর বিদ্বেষ, ঘৃণা বা কোনো প্রকার অনুদার মনোভাব ছিল না। জীবনরসিক কবি জীবনের রসসৃষ্টিতে সকলকেই সমদৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন। মুসলমানদের বর্ণনা প্রসঙ্গে তাঁদের রীতিনীতি আচার- ব্যবহার ও ধর্মকর্মের নিপুণ বর্ণনা পাওয়া যায়। কবির অঙ্কিত প্রত্যেকটি চরিত্র জীবন্ত ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। গ্রামবাংলার সমাজ ও সর্বশ্রেণির মানুষ তাঁর কাব্যে ভিড় করে এসেছে। নীচ জাতি থেকে শুরু করে ঠগ, ভণ্ড, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বৈদ্য, দাসী, স্বর্ণকার ও দরিদ্র ব্যাধ প্রভৃতি বিচিত্র ব্যাপক বাঙালি জীবনের রূপকার। কবির অঙ্কিত ধূর্ত বেনে মুরারিশীল, প্রবঞ্চক ভাঁড় দত্ত, স্বার্থপরায়ণ দুর্বলা দাসী প্রভৃতি চরিত্র একান্তভাবে এই ধূলা মাটি সংসারের মানুষ। স্থূলবুদ্ধি অশিক্ষিত ও অমার্জিত কিন্তু সরল মনের অধিকারী কাব্যের নায়ক কালকেতুর ব্যাধসুলভ বা স্বভাবসুলভ চরিত্রটি খুবই জীবন্ত। প্রকৃতিগত সারল্য, বিশ্বাসপ্রবণতা, বীরত্ব, ক্রোধ, ভীরুতা ও সন্ধিগ্ধচিত্ততা প্রভৃতি বিচিত্র গুণের সমাবেশে কালকেতুকে কবি আকৃতি প্রকৃতিতে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে অখন্ড ব্যাধচরিত্রের সামগ্রিকতায় একান্ত বাস্তবানুগ ও জীবন্ত করে গড়ে তুলেছেন। তার স্ত্রী ফুল্লরা যথার্থ পতিভক্তিপরায়ণা কর্মঠ ও পরিশ্রমী ব্যাধপত্নী। সে বুদ্ধিমতী ও বাক্চাতুর্যে অতুলনীয়। মধ্যযুগের শ্রমজীবী নারীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফুল্লরা ফুটে উঠেছে। ভাঁড় দত্ত এক অসাধারণ ঈর্ষাপরায়ণ শঠ ব্যক্তি। শাঠ্যবৃত্তিতে খল স্বভাবে ও বাচাতুর্যে সে অদ্বিতীয়। জুয়াচোর ভাঁড়ুদত্তের বেশভূষা, বাক্চাতুর্য ধূর্তামি, স্বার্থপরতা ও নিলজ্জতা কবি দক্ষ শিল্পীর মতো ফুটিয়ে তুলেছেন।

মুকুন্দরামের মুরারি শীল এক অভিনব সৃষ্টি। এই চরিত্রটি মুকুন্দরামের পূর্বে রচিত হয়নি। এটি মুকুন্দয়ামের মৌলিক সৃষ্টি। উপস্থিত বুদ্ধি, ধূর্ততা ও বানৈপুণ্যে সে অদ্বিতীয়। কালকেতু দেবীপ্রদত্ত সোনার আংটিটি ধূর্ত প্রবঞ্চক বেনে মুরারি শীলের কাছে বিক্রি করতে গেলে সে নামমাত্র মূল্যে সেটা আত্মসাৎ করতে চায়। মুরারি জানে কালকেতু রাস্তাঘাটে কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছে আংটিটি। সোনার জিনিস সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা নেই। কাজেই অশিক্ষিত ও স্বর্ণঅনভিজ্ঞ কালকেতুকে সোনার জিনিসকে পিতল বললে কিছু মনে করবে না। সে বলে আংটিটি পিতলের, তার মূল্য যৎসামান্য। ‘সোনারূপে নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল। ঘসিয়া মাজিয়া বাপু কর‍্যাছ উজ্জ্বল।।’

কিন্তু যখন দেখল কালকেতু আংটিটি অন্যত্র বিক্রয় করতে উদ্যত, তখন সে সব কথাকেই পরিহাস করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল- ‘এতক্ষণে পরিহাস কৈলু ভাইপোরে’। মুরারির পত্নীও স্বামীর শাঠ্যের যোগ্য সহচরীরূপে জীবন্ত। ভাঁড় ও মুরারি দুজনেই শঠতায় সমাজের কলঙ্ক। রবীন্দ্রনাথের মতে মুকুন্দরামের সহানুভূতির সংস্পর্শে ভাঁড় দত্ত তার সমস্ত

অনাবশ্যক বাহুল্য বর্জন করে একটি সমগ্র রসের মূর্তিতে প্রতিভাব হয়েছে। মুকুন্দরামের সব চরিত্র সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য। ধনপতি, লহনা, খুল্লনা প্রভৃতি সুখেদুঃখে জয়পরাজয়ে ঈর্শায় কুটিলতায় পরম আকর্ষণীয় রসবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

মুকুন্দরামের সহানুভূতি ছিল অতিশয় ব্যাপক। পশুপ্রকৃতির মধ্যে মানবীয় ভাবের আরোপ করে মূক ইতর প্রাণীর মর্মবেদনাকে রস-সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। কালকেতুর আক্রমণে বিপর্যন্ত ও ভয়ার্ত বনের পশুরা দেবী চণ্ডীর নিকট আত্মরক্ষার্থে করুণা প্রার্থনা পশুপ্রকৃতি জানায়। ভালুক বলে- ‘উই চোরা খাই পশু নামেতে ভালুক/নেউগী চৌধুরী নই না করি তালুক।।’ হস্তিনীর বিলাপও করুণ বেদনায় হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠেছে। হাতির বিরাট দেহ, বিরাট আকার-তার পক্ষে কালকেতুর দৃষ্টি এড়িয়ে বনে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তার পুত্র কমললোচন কালকেতুর হাতে মারা গেছে। হস্তিনী কেঁদে বলে- ‘বড় নাম বড় গ্রাম বড় কলেবর।/ লুকাইতে স্থান নাই বীরের গোচর।/ পলাইয়া কোথা যাই কোথা গেলে তরি।/ আপনার দত্ত দুটা আপনার অরি।। চিক কায়

আদি বীর বরাহ জানায় সে কাউকে হিংসা করে না। মুথা ঘাস খেয়ে জীবনযাপন করে। তবুও কালকেতু তার স্বামী, পুত্র, ননদ, ভাসুর সবাইকে মেরে ফেলেছে। নানাপ্রকার হরিণ, ধূলায় লুটিয়ে কেঁদে বলে-‘কেন হেন জন্ম বিধি কেন পাপ বংশে/হরিণ ভুবন বৈরী আপনার মাংসে।’ কবি প্রতিভার চূড়ান্ত উদ্‌ঘাটিত হয়েছে করুণ রসসৃষ্টিতে। মানবজীবনের দুঃখদুর্দশার কাহিনি তাঁর কাব্যে নিবিড় রসসৌকর্য তৈরি করেছে। তাই বলে তিনি দুঃখবাদী বা Pessimistic রসসৃষ্টি কবি নন। তিনি দুঃখ বর্ণনার কবি। জীবনের প্রতি তাঁর কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, ছিল স্নিগ্ধ প্রশান্ত মমত্ববোধ। কবি নিজে অনেক দুঃখ পেয়েছেন এবং বিপুল বাঙালি সমাজের শোচনীয় দুঃখকষ্টের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক যোগ সাধিত হয়েছিল। কিন্তু ব্যঙ্গবিদ্রূপে ‘তির্যক দৃষ্টিতে’ স্মিত কৌতুকে তিনি জীবনের সমস্ত দুঃখবেদনা হতাশার উর্ধ্বে আনন্দলোকে বিচরণ করেছেন। তাঁর কাব্যে দুঃখের বর্ণনা আছে, তার থেকে বড়ো কথা আছে দুঃখ অতিক্রমণের আনন্দ সংগীত। করুণরসের সঙ্গে সঙ্গে রঙ্গব্যঙ্গ হাস্যরস সৃষ্টিতে মুকুন্দরাম মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভের মতো বিরাজমান। তিনি ছিলেন একজন বড়ো হিউমারিস্ট (Humourist)। শিবপার্বতীর বিবাহে, কালকেতুর ভোজনের তালিকায়, গুজরাট নগর পত্তনে মুসলমান ব্রাহ্মণদের বর্ণনায় ও সর্বোপরি ভাঁড় দত্তের কাহিনি সৃষ্টিতে মুকুন্দরাম অনাবিল হাস্যরস উজাড় করে দিয়েছেন। এতে কোথাও ব্যঙ্গের জ্বালা বা জীবনের তিক্ততা প্রকাশ পায়নি। সর্বত্রই রয়েছে এক প্রসন্নতা সজীবতা। কালকেতুর ভোজনে, শিবের দারিদ্র্য, মুরারির শঠতা, ধনপতির লালসা ও ভাঁড়ুর নির্লজ্জতার মধ্যে হাস্যরসের নির্মল স্রোত প্রবাহিত।

ফুল্লরার বারোমাসের দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে মুকুন্দরাম তাঁর কবিপ্রতিভাবে সম্পর্ণ উজাড় করে দিয়েছেন। কালকেতু ফুল্লরার দুঃখদুর্দশার মধ্যে মধ্যযুগের মধ্যবিত্ত বাঙালির

জীবনকথাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ‘মাংসের পসরা লইয়া ফিরি দ্বারা দ্বারে। কিছু গান কুঁড়া পাই উদর না ভরে।।’ কিংবা ‘দুঃখ কর অবধান, দুঃখ কর অবধান/আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।। ফুল্লরার বারোমাসের দুঃখবর্ণনায় বাংলার ঋতুচক্র মানুষের দারিদ্র দুর্দশার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়ে জীবন্তরূপ লাভ করেছে।

মুকুন্দরামের ভাষা ও রচনারীতি পূর্বের কবিদের থেকে অনেক মার্জিত ও অলংকারসমৃদ্ধ। বর্ণনার প্রাঞ্জলতায়, উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহারে, লোকিক আবহ সৃষ্টিতে তিনি যথেষ্ট শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। মঙ্গলকাব্যের সীমাবদ্ধ আবেষ্টনীর অনেক ঊর্ধ্বে মানবজীবনের স্বচ্ছন্দ লীলাভূমিতে বিচরণ করেন। তিনি সীমাবদ্ধ কালকে পেরিয়ে চিরকালীন মানুষের উপসংহার জীবনধর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। সামাজিক মানুষের সংঘাত বিক্ষুব্ধ জীবনের বাস্তব কাহিনি রূপায়ণে তিনি যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত চরিত্রগুলি তুলে ধরেছেন-তাতেই তাঁর কবিপ্রতিভা ঔপন্যাসিকের সমধর্মী হয়ে আধুনিক জীবন-চেতনার সগোত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুকুন্দরামের কাব্যে মনুষ্য জীবনই দেবতার ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পেয়েছে এবং অলৌকিক আখ্যানবস্তু নামমাত্রই ক্ষীণ সংযোগ রক্ষা করে অপ্রধান হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন যে, মুকুন্দরামের কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে স্ফুটোজ্জ্বল বাস্তবচিত্রে, দক্ষ চরিত্রাঙ্কণে, কুশল ঘটনাসন্নিবেশ ও সর্বোপরি অখ্যায়িকা ও চরিত্রের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপনে আমারা ভবিষ্যৎকালের উপন্যাসের বেশ সুস্পষ্ট পূর্বাভাস পেয়ে থাকি। দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই তাঁর মধ্যে বর্তমান ছিল। এযুগে জন্মগ্রহণ করলে তিনি যে কবি না হয়ে একজন ঔপন্যাসিক হতেন, তাতে সন্দেহ নেই।

৬. মনসামঙ্গলের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ

পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বহু কবি মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে বিজয়গুপ্ত, নারায়ণ দেব, বিপ্রদাস বিপলাই, দ্বিজবংশীদাস, তন্ত্রবিভূতি ও জগজ্জীবন ঘোষালের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সপ্তদশ শতাব্দীর মনসামঙ্গল কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে ক্ষেমানন্দ অন্যতম কবি। এই শতাব্দীতে রচিত মনসামঙ্গল কাব্যগুলি পূর্বযুগের তুলনায় ততটা গৌরবপূর্ণ নয়। তবে যুগের পরিবর্তনে কবিদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবানুগ হয়ে উঠেছে। পরিবেশ সচেতনতা ও ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিচয় মেলে সেইসব গ্রন্থে। মনসামঙ্গল কাব্যের সব কবি প্রায় পূর্ববঙ্গের লোক; ক্ষেমানন্দ পশ্চিমবঙ্গের লোক এবং পশ্চিমবঙ্গবাসী। আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, ক্ষেমানন্দ বর্ধমানের কাঁদড়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। প্রসিদ্ধ কায়স্থ বংশে তাঁর জন্ম।

মনসার এক নাম কেতকা। কারণ কেয়াপাতায় তাঁর জন্ম হয়েছিল। ‘বনের ভিতর জন্মাইল মনসাকুমারী/কেয়া-পাতে জন্মাইল কেতকাসুন্দরী।’ কবি ক্ষেমানন্দ, মনসা বা কেতকার পরমভক্ত

বলেই কেতকাদাস উপাধি গ্রহণ করেন। মনসার পরমভক্ত বলেই কাব্যের স্থানে স্থানে কেতকাদাসের উল্লেখ আছে। সুতরাং কেতকাদাস ও ক্ষেমানন্দ একই ব্যক্তি। গ্রস্বমধ্যে গ্রন্থরচনার সন তারিখের উল্লেখ নেই। আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর রচনা রীতি মাঝামাঝি কাব্যটি রচিত হয়। কবির পিতা শংকর ফৌজদার বারা খাঁর অধীনে চাকরি করতেন। বারা খাঁ ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উক্ত অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। সর্পভূষণ দেবী মনসা মুচিনী বেশে দেখা দিয়ে কবিকে মঙ্গলকাব্য রচনা করতে নির্দেশ দেন। ক্ষেমানন্দ পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর কাব্যের সর্বত্র পান্ডিত্যের নিদর্শন মেলে। পান্ডিত্য প্রকাশের দিকে সচেতন থাকায় তাঁর রচনাশৈলীতে সংস্কৃত ছন্দ ও অলংকার রীতি অনুসৃত হয়েছে। বেহুলার স্বর্গপুরী অভিমুখে যাত্রার মধ্যে কবির ভৌগোলিক জ্ঞান ও ঐতিহাসিক তথ্যনিষ্ঠার পরিচয় মেলে। পশ্চিমবাংলার গ্রাম, পথঘাট ও নদনদীর নিপুণ বর্ণনা রয়েছে তাঁর কাব্যে। চাঁদসদাগরের বাণিজ্যপথের বর্ণনায় তিনি ভৌগোলিক তথ্য ও বাস্তব পরিবেশ তুলে ধরেছেন। ক্ষেমানন্দের কাব্যে দেশকাল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য ঐতিহাসিক মূল্যবত্তায় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাঁতালি থেকে স্বর্গ পর্যন্ত বেহুলার যাত্রাপথে কবি দামোদর ও তাঁর শাখা নদীগুলির নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। বাইশটি যে ঘাটের বর্ণনা দিয়েছেন, তার মধ্যে চৌদ্দটি ঘাট এখনও বর্তমান।

হাস্য ও কৌতুকরস সৃষ্টিতে কবি বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন। চাঁদের চরিত্রমহিমা তিনি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেননি। তবে বেহুলার চরিত্রটি কবির হৃদয় উজাড়-করা সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। সতী নারী-লক্ষ্মী সীতার পবিত্রাদর্শে কবি বেহুলাকে আত্মমর্যাদা পাতিব্রত্য ও দুঃখসহনশীলতায় মহিমান্বিত করে তুলেছেন। মনসার ঈর্ষাকুটিল চরিত্রটিও ক্ষেমানন্দের হাতে অল্প পরিসরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিষপানে শিবের মৃত্যুতে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ায় তিনি পরম আনন্দে ফেটে পড়েন। কারণ, তাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণা বিমাতা এবার থেকে বিধবা হল। ‘বিষ পানে মরিল মহেশ মোর বাপ/চন্ডিকা রান্ডিকা হৈল ঘুচিল সন্তাপ।’

চরিত্রচিত্রণে ক্ষেমানন্দের যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় মেলে। পুত্রহারা সনকার ব্যথাদীর্ণ হৃদয়ের বর্ণনা দিয়েছেন কবি সাবলীল ভাষায়। মনসার কেয়াবনে জন্ম-কাহিনিটি ক্ষেমানন্দের নতুন সংযোজন। এছাড়া কাব্যে তিনি ধুয়া ব্যবহার করে মঙ্গলকাব্যের একঘেয়েমির মধ্যে কিছুটা অভিনবত্ব এনেছেন। সামাজিক পরিবেশ ও রীতিনীতি সম্পর্কেও তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি।

ক্ষেমানন্দের কবিপ্রতিভা কল্পনার বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব সত্ত্বেও প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পেতে পারে না। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির শ্রেষ্ঠ কবি- ‘First of the second grade poets.’ তাঁর কাব্যে কাহিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও মধ্যেকার যোগসূত্র খুবই ক্ষীণ। তবুও ক্ষেমানন্দ বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। কবির ভৌগোলিক জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং রচনার স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীলতার জন্য তাঁর কাব্যের জনপ্রিয়তা বেশি। ক্ষেমানন্দের রচনা উচ্চশ্রেণির না হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এটা তাঁর সৌভাগ্যের পরিচয়।

৭. ধর্মমঙ্গলের কবি ঘনরাম চক্রবর্তী

ধর্মমঙ্গল কাব্য অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের থেকে অনেক পরবর্তীকালের রচনা। সপ্তদশ- অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমরা রূপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, সীতারাম দাস, যদুনাথ রায় ও ঘনরাম চক্রবর্তীর নাম পাই। এছাড়াও আরও কয়েকজন কবি ধর্মঠাকুরের মহিমাজাপক কাব্য রচনা করেন।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের সর্বাধিক প্রচারিত কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। এঁর কাব্য প্রথম মুদ্রণসৌভাগ্য ভূমিকা লাভ করায় কাব্যের প্রচার হয়েছে বেশি। বঙ্গবাসী কার্যালয় (কলিকাতা) থেকে বাংলা ১৯২০ সনের চৈত্রমাসে ঘনরামের কাব্য মুদ্রিত হয়। আচার্য

দীনেশচন্দ্র সেন এটিকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেছেন। ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কবি স্বল্প পরিচয় দিয়েছেন। বর্ধমান জেলার দামোদর নদের তীরে কৃয়পুর গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। ঘনরাম অল্পবয়সে কবিপ্রতিভার পরিচয় দেন।

কবিজীবনী

তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে শিক্ষাগুরু তাঁকে ‘কবিরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে কাব্যটি রচিত। কাব্যে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের উল্লেখ আছে। এতে মনে হয় তিনি বর্ধমানরাজের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। কবি কাব্য সমাপ্তির পূর্বে যে তারিখের উল্লেখ করেছেন তা থেকে ১৭১১ খ্রিস্টাব্দ পাওয়া যায়। কাজেই এই সময়ে গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত হয়। ঘনরামই মঙ্গলকাব্যের একমাত্র কবি যিনি কাব্য রচনায় স্বপ্নাদেশের কোনো উল্লেখ করেননি।

ঘনরামের কাব্যে দুটি কাহিনি সন্নিবেশিত। পূর্বপ্রচলিত ধর্মমঙ্গলের কাহিনিকে কবি বিভিন্ন ভাব, বিচিত্র আখ্যান ও বিবিধ রসের সমন্বয়ে মহাকাব্যের বিশাল আকৃতি ও আভিজাত্য দান করেন। ঘনরাম ভণিতায় এই কাব্যকে ‘শ্রীধর্মসঙ্গীত’, ‘অনাদিমজঙ্গল’ ও ‘মধুর ভারতী’ প্রভৃতি নামে অভিধাযুক্ত করেছেন। কাব্যটি বারো দিন গান করার উপযোগী চব্বিশটি পালায় বিভক্ত। ঘনরাম শাস্ত্রপুরাণাদিতে পণ্ডিত ছিলেন। তাই তাঁর কাব্যে রামায়ণ, ভাগবত ও মহাভারতের ছায়াপাত ঘটেছে।

কবিত্ব ও পাণ্ডিত্যের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে ঘনরামের কাব্যে। সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনের অনেক উপকরণে তিনি কাব্যকে সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যমন্ডিত করে তুলেছেন; কবির রুচিবোধ অতিশয় মার্জিত ও পর্যবেক্ষণশক্তি গভীর। গ্রাম্য স্থূলতা ও কুরুচি থেকে তাঁর কাব্য মুক্ত-স্বচ্ছন্দ সাবলীল ও পরিশীলিত। কবির প্রখর বাস্তববোধ, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তি ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি বিভিন্ন চরিত্রগুলিকে ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যে স্পষ্টোজ্জ্বল করে তুলেছে। লাউসেনের চরিত্রটিকে কবি অনমনীয় পৌরুষ, অদম্য বীরত্ব ও নৈতিক পবিত্রতায় গৌরবসমুন্নতির শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারী জাতিকেও তিনি শক্তিমন্ত্রের আদর্শে প্রবুদ্ধ করতে প্রয়াসী হন। দৈবানুকূল্যের কথা বাদ দিলে লাউসেন মানবিক গুণে বৈশিষ্ট্যদ্যোতক। পিতামাতার প্রতি

ভক্তি, ধর্মপথ অনুসরণ, নির্ভীকতা ও অসামান্য বীরত্বের জাজ্বল্য মূর্তি লাউসেন। রঞ্জাবতী

স্বর্গের শাপভ্রষ্ট নর্তকী হলেও স্নেহময়ী, সর্বদা পুত্রচিন্তায় অধীর মাতৃত্বের চিরন্তনী প্রতিমৃতি

বাঙালি নারীর বীরত্ব ও সাহসিকতার উপরও ঘনরাম উজ্জ্বল আলোকপাত করেছেন। কবি দেখিয়েছেন যে বঙ্গনারী সংসারে রান্নাবান্নার কাজেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা কেউ কেউ প্রেমের বীর্যে অশঙ্কিনী। কালুডোম, লখাই প্রভৃতি অপ্রধান ছোটোখাটো চরিত্রগুলির আলেখ্য চিত্রণে কবি কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রধান চরিত্রগুলি কমবেশি দেবপ্রভাবযুক্ত-তাই অনেক ক্ষেত্রে অনৈসর্গিক ঘটনা স্থান পাওয়ায় তাঁদের স্বাভাবিকতা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু অপ্রধান চরিত্রগুলি খুবই জীবস্ত, বাস্তবনিষ্ঠ ও স্বকীয় মহিমায় দীপ্ত। পাতিব্রত্য ও স্নেহশীলতায় দুর্জয় সাহস ও অবিচলিত কর্তব্যবোধে অপ্রধান চরিত্রগুলিকে যথোচিত চরিত্র ধর্মে অসামান্য মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। এইসব চরিত্রসৃষ্টিতে বাস্তব জীবনের সামাজিক পটভূমি গড়ে ওঠার সুযোগ এসে যায়। ভিলেন বা খলচরিত্র হিসাবে মহামদ চরিত্রটি ঘনরামের অনবদ্য সৃষ্টি। শঠতা, ক্রুরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতায় মহামদ খুবই স্বাভাবিক ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

হাস্যরস ও কৌতুকসৃষ্টিতে ঘনরাম উচ্চাঙ্গ রুচিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর হাস্যরস গ্রাম্য স্থূলতা ও ভাঁড়ামি থেমে মুক্ত। অণুপ্রসাদি অলংকার প্রয়োগে তিনি যথেষ্ট নৈপুণ্যের পরিচয় রেখেছেন। ছন্দের দ্রুত দোলায়, ভাবানুযায়ী সুষম শব্দ বিন্যাসে যুদ্ধের ঘনঘটা খুবই উপাদেয় হয়ে উঠেছে-‘টন্‌ টান্‌ ঠন্ ঠান্/ ঢাল চলে ঢন ঢান । ঝন্ ঝান ঘন রণ নাদ।/ দেখিতে বিপরীত, চৌদিকে চমকিত / মামুদা ভাবে পরমাদ।’

ঘনরাম বিষয়বস্তু ও শিল্পরীতির বিচারে মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্রের মধ্যবর্তী কবি ঘনরাম স্বকীয়তায় মহিমান্বিত। বাংলাদেশের রাঢ় অঞ্চলের মানুষের বীরত্বের বিচিত্র কাহিনি তাঁর কাব্যে গৌরবমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বীররসে ভাসি মহাগীতরচনায় প্রয়াসী হন। তাঁর রচনায় তির্যক বাভঙ্গি ও শিল্পচাতুর্য পরবর্তীকালের কবি ভারতচন্দ্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ভারতচন্দ্র যে ঘনরামের কাছে কিছুটা ঋণী তা অস্বীকার করা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয়ী সাহিত্যাদর্শের মধ্যে ঘনরাম এক বলিষ্ঠ প্রাণবান, সতেজ ও নৈতিকতায় পরিশুদ্ধ উন্নত চরিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যে।

অনুশীলনী

১। যে মূল কাহিনি অবলম্বন করে মনসামঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে তার বিবরণ দাও। মনসামঙ্গল রচয়িতা যে-কোনো কবি সম্বন্ধে যা জানো লেখো। (উ. মা. ১৯৬৬)

২। মনসামঙ্গল কাব্য মঙ্গলকাব্যের মধ্যে কোন্ কোন্ গুণ শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়? এই কাব্যে চাঁদসদাগরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা বিবৃত করো। (উ.মা. ১৯৭৯)

৩। ‘মাল’ শব্দটির অর্থ কী? মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি কী? মনসামঙ্গল অথবা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের যে-কোনো একজন শ্রেষ্ঠকবির কাব্যপ্রতিভার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। (উ. মা. ১৯৮২)

৪। টাকা লেখো: মনসামঙ্গালের একজন কবি (উ. মা. ১৯৮৩), একজন মক্কাল কবি (১৯৮৫), কেতকাদাস (ত্রিপুরা ১৯৮১)

৫। মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে লেখো। মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান তিনজন কবির নাম করো। যে-কোনো একজন কবির কাব্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৯৩)

৬। মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করো। মনসামঙ্গলের দুজন প্রধান কবির নাম লেখো। এদের মধ্যে যে কোনো একজনের কাব্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো। তোমার নির্বাচিত কবির কাব্যটি কোন সময়ে লেখা বলে অনুমান করা হয়? (উ. মা. ১৯৯৫)

৭। মঙ্গঙ্গলকাব্য কাকে বলে? মনসামঙ্কাল কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে লেখো। মঙ্গলকাব্যের একজন প্রধান কবি সম্বন্দ্বে আলোচনা করো।(উ. মা. ১৯৯৭) কবির কাব্য-প্রতিভার

৮। মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে লেখো। মনসামঙ্গলের একজন প্রধান মূল্যায়ন করো।(উ. মা. ২০০০) কবির কাব্য-কৃতির

৯। মনসামঙ্গাল কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে এই কাব্যধারার একজন বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।(উ. মা. ২০০২)

১০। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর দুঃখপূর্ণ ব্যক্তিজীবনের পরিচয় দাও। চরিত্রাঙ্কণে তাঁর দক্ষতা সংক্ষেপে আলোচন করো। ও করুণরস সৃষ্টিতে

১১। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের যে কোনো একটি গল্প সংক্ষেপে বিবৃত করো। এই ধারার(উ. মা. ১৯৮১) পরিচয় দাও। শ্রেষ্ঠ কবির প্রতিভার

১২। চন্ডীমঙ্গল কাব্যের যে-কোনো একটি কাহিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করো। এই কাব্যের দু-জন প্রধান কবির নাম উল্লেখ করো। এঁদের মধ্যে যে-কোনো একজনের কবিপ্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করো।(উ. মা. ১৯৮৬)

১৩। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে কটি কাহিনি আছে? কোন কাহিনি প্রাচীনতর? (উ. মা. ১৯৯৫) ৭+২+৬

যে-কোনো একটি কাহিনি সংক্ষেপে লেখো এবং মুকুন্দরামের কবিপ্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করো। (উ. মা. ১৯৯২)

১৪। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর দুঃখপূর্ণ ব্যক্তি-জীবনের পরিচয় দাও। চরিত্রাঙ্কনে ও করুণ রসসৃষ্টিতে

তাঁর দক্ষতা সংক্ষেপে আলোচনা করো। (উ. মা. ১৯৮১) ১+১+৫+৮=১৫

১৫। চন্ডীমঙ্গলের দুটি কাহিনি সংক্ষেপে বিবৃত করো। চন্ডীমঙ্গলের দুজন কবির নাম করো। তাদের

মধ্যে যে কোনো একজন কবির কাব্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। (উ মা. ১৯৯৪) ৬+৩+৬

১৬। চন্ডীমঙ্গলের কাব্যের যে-কোনো একটি কাহিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করো। এই কাব্যের দুজন প্রধান কবির নাম উল্লেখ করো। এদের মধ্যে যে-কোনো একজনের কবিপ্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৯৬)

১৭। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনি কয়টি ও কী কী? চন্ডীমঙ্গলের যে-কোনো একটি কাহিনি সংক্ষেপে লেখো। চন্ডীমঙ্গলের একজন প্রধান কবি সম্বন্দ্বে আলোচনা করো। (উ. মা. ১৯৯৮)

১৮। চন্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি কে? তাঁর আবির্ভাবকাল, জীবন ও রচনা-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে(উ. মা. ২০০১)আলোচনা করো।

১৯। ধর্মমঙ্গল কাব্য কাকে বলে? এই কাব্যের কাহিনি সংক্ষেপে লেখো।

২০। ধর্মমঙ্গলের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় ঘনরাম চক্রবর্তীকে-এ সম্পর্কে আলোচনা করো।

২১। মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক কারণ কী? ‘ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনিকে সংক্ষেপে বর্ণনা করো এবং ওই (উ. মা. ১৯৯৯)

কাব্যের একজন প্রধান কবির কাব্যপ্রতিভার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দাও।

২২। ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি বর্ণনা করে মঙ্গলকাব্যের ধারায় এর স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

(উ. মা. ২০০৩)