১. মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক কারণ:
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম শাখা হল আখ্যানমূলক মঙ্গলকাব্য। মূলত খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এর কালপর্ব। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বহুজ্ঞাত, অজ্ঞাত, খ্যাত ও স্বল্পখ্যাত কবি মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, শিবমঙ্গল (শিবায়ণ ভূমিকা কাব্য), ধর্মমঙ্গল ও রায়মঙ্গল প্রভৃতি অজস্র কাব্য রচনা করেছেন। মঙ্গলকাব্যগুলিতে নানা সাম্প্রদায়িক দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক কীর্তিকলাপ বর্ণিত হয়েছে। মঙ্গলকাব্যের দেবতারা অলৌকিক শক্তির অধিকারী। বিপদকালে ভক্তকে উদ্ধার করেন। তার রোগশোক দুর্গতি মোচন করেন। ভক্তজনের উপর তাঁর অজস্র করুণা বর্ষিত হয়। আর যারা দেবতাকে মান্য করে না-তাদের প্রতি দারুণ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন দেবদেবী। মঙ্গলকাব্যে দেবতার প্রতি ভক্তিপরায়ণ মানুষ অনেক ধনদৌলত পেয়েছে। পেয়েছে রাজসিংহাসন। আর দেবদ্রোহীরা পেয়েছে নিরতিশয় দুঃখকষ্ট, লাঞ্ছনা।
‘মঙ্গল’ কথাটির আভিধানিক অর্থ হল কল্যাণ। সাধারণভাবে যে কাব্যে দেবদেবীর মঙ্গল বা মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে এবং যে কাব্য পাঠে বা শ্রবণে মানুষের মঙ্গল হয় সেটাই মঙ্গলকাব্য। এককথায় যে কাব্যের কাহিনি শুনলে মানুষের সকলপ্রকার অমঙ্গল দূর হয়, মানুষ পাপমুক্ত হয় এবং তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়, তারই নাম মঙ্গলকাব্য। আবার কারও কারও মতে, মঙ্গলকাব্যগুলি এক মঙ্গলবারে গান শুরু হত পরের মঙ্গলবারে শেষ হত। আটদিন ধরে গান হত বলে নাম অষ্টমঙ্গলা। মঙ্গল শব্দটিকে বিজয় অর্থেও ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার মঙ্গল নামক বিশেষ এক রাগিণী বা সুরে মঙ্গলকাব্যগুলি গীত হত বলে এই নামকরণও হতে পারে।
এক এক ধারার মঙ্গলকাব্যে এক এক দেবদেবীর সমস্ত বাধা বিঘ্ন ও বিরুদ্ধ মতবাদ অতিক্রম করে নিজ নিজ পূজা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা অর্জনের বিজয়কর্তা ঘোষিত হয়েছে। সেইসব মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীর মধ্যে স্ত্রীদেবতার প্রাধান্য বেশি। মনসা ও চণ্ডীই মঙ্গলকাব্যের
নামকরণ প্রধান স্ত্রীদেবতা। ধর্মঠাকুর, শিব, কালুরায়, দক্ষিণরায় পুরুষ দেবতা। মঙ্গলকাব্যে দেখা যায় মর্তভূমিতে নিজের মাহাত্ম্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং ভক্তকে মঙ্গলদানের জন্যই এক এক দেবদেবীর আবির্ভাব। এরা উপাসকের সভক্তি পুজো পেলেই নরনারীর সব বিপদবাধা দূর করেন। অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মঙ্গঙ্গল বিধায়ক দেবদেবীর কাহিনি নিয়ে রচিত
কাব্যই মঙ্গলকাব্য, এক মঙ্গলবারে শুরু করে পরের মঙ্গলবার পর্যন্ত যে কাব্য গীত হয় তাই হল মঙ্গলকাব্য।
মঙ্গলকাব্যগুলির কাহিনি ছড়া, পাঁচালি ও মেয়েলি ব্রতকথা আকারে দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিল। কবে থেকে সেগুলি কাব্যের রূপলাভ করেছে তা বলা কঠিন। কিন্তু এইসব কাব্যের উদ্ভবের পিছনে রয়েছে বাংলাদেশের অধিবাসীদের আধিভৌতিক ভয়-ভাবনা। আর একে পরিপুষ্টি দান করেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক বিপর্যয় ও দীর্ঘকাল জুড়ে রাষ্ট্রীয় ভাঙাগড়ার ইতিহাস।
বাংলাদেশ নদীনালা, খালবিল ও বনজঙ্গলে ভরা। এদেশে ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকত। ব্যাঘ্র, কুমির, সর্প ইত্যাদি হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের উপদ্রব ও আক্রমণে এবং বসন্ত, কলেরা প্রভৃতি মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপে প্রায়শই মানুষের প্রাণহানি ঘটত। এইভাবে বিপর্যস্ত বাংলার মানুষ ছিল তখন বড়ো অসহায়। এভাবে উপদ্রুত বাংলার মানুষ ভেবেছিল সমস্ত আধিভৌতিক দুর্যোগের পিছনে নিশ্চয়ই
জনমানসিকতা
কোনো পরম পরাক্রমশালী দেবতার অদৃশ্য হস্ত কাজ করছে। সেই ক্রুদ্ধ দেবতাকে পূজার্চনা স্তবস্তুতি ও ধ্যানধারণার দ্বারা সন্তুষ্ট করতে পারলেই মঙ্গল সাধিত হবে। তাই সমাজের নিম্নস্তরের মানুষেরা সাপ, বাঘ ও কুমিরের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য মনসা, দক্ষিণরায় ও কালুরায়ু প্রভৃতি দেবদেবীর কল্পনা করল। ঝড়-ঝঞ্ঝার ক্ষেত্রে উদ্ভূত হল দেবী চন্ডী এবং কলেরা-বসন্ত ব্যাধির ক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটল শীতলা দেবীর। পুজোপদ্ধতি পালাপার্বণের প্রচলন শুরু হল। স্বভাবতই লোকচিত্তে এই বিশ্বাসবোধ প্রগাঢ় হল যে, এইসব দেবদেবীকে পুজো করলে, তাঁদের মহিমা কীর্তন করলে তাঁরা সন্তুষ্ট থাকবেন এবং ভক্তকে সকল প্রকার বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। ভক্তদের নিজেদের কল্যাণও সাধিত হবে। এই ধারণা থেকে দেবদেবীর মাহাত্ম্য রচিত হল এবং তা প্রচার হতে থাকল পুরোদমে। মঙ্গলকাব্য রচনার মৌল প্রেরণা এই ভয়-ভাবনা জাত অহেতুক ভক্তি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
“সংসারে যারা পীড়িত, যারা পরাজিত, অথচ এই পীড়া ও পরাজয়ের যারা কোনো ধর্মসঙ্গত কারণ দেখতে পাচ্ছে না, তারা স্বেচ্ছাচারিণী নিষ্ঠুর শক্তির অন্যায় ক্রোধকেই সকল দুঃখের কারণ বলে ধরে নিয়েছে এবং সেই ঈর্ষাপরায়ণা শক্তিকে স্তবের দ্বারা পুজোর দ্বারা শান্ত করবার আশাই এই সকল মঙ্গলকাব্যের প্রেরণা।”
তুর্কি আক্রমণে বিপর্যন্ত উচ্চ-নিম্ন উভয়শ্রেণির বাঙালি হিন্দুর মধ্যে পৌরাণিক ও লৌকিক সংস্কৃতির আদানপ্রদান চলতে থাকে। এই সংস্কৃতি সমন্বয়ের অনুকূল মনোভাব থেকেই নিম্নবর্ণীয়েরাও উচ্চশ্রেণির পৌরাণিক দেবদেবী ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করার সুযোগ পেল। এভাবে বহু অনার্য দেবতা আর্যদের দেবদেবীর পাশে নিজেদের স্থান করে নিলেন। আদিতে চণ্ডী ছিলেন অন্-আর্য ব্যাধ জাতির উপাস্য দেবতা-কিন্তু ক্রমে ক্রমে
তিনি শিব-পত্নী উমার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়লেন। অন্-আর্য পূজিত মনসা হলেন শিবের কন্যা। অন্-আর্য দেবতা ধর্মঠাকুর বিস্তুর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে উঠলেন। তখন নিম্নবর্ণের পূজিত দেবতারা উচ্চবর্ণের শ্রদ্ধা ও ভক্তি অর্জন করলেন। উচ্চবর্ণের সংস্কৃত-অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ কবিরা মঙ্গলকাব্য রচনায় ব্রতী হলেন। মঙ্গলকাব্য রচনার আর একটি কারণ রাষ্ট্রিক বিপর্যয়ে বিপন্ন বাঙালির পরস্পর মিলন-অভীপ্সা ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের মনোভাব।
মঙ্গঙ্গলকাব্যে পৌরাণিক ও লৌকিক ধর্মবিশ্বাসের মিলন প্রচেষ্টার ইতিবৃত্ত বিধৃত। তুর্কি আক্রমণে নিপীড়িত নিগৃহীত উপদ্রুত বাঙালিকে রক্ষা করার মতো কোনো রাজশক্তি ছিল না। তাই মঙ্গলকাব্যের কবিরা অন-আর্য দেবতাকে বরাভয় দাতা, নিরাপত্তা রক্ষাকারী কল্যাণবিধায়ক উপসংহার শক্তি হিসাবে স্বীকৃতি জানালেন। আগে যা ছড়া ও ব্রতকথা আকারে প্রচলিত ছিল তাকে সম্পূর্ণতা দান করলেন। শাস্ত্র ও পুরাণের আদর্শকে কিছুটা মার্জিত করে, কিছুটা অলৌকিক শক্তির কল্পনা করে সমসাময়িক বাস্তব জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করা হল। বিভিন্ন সময়ে একই কাহিনির পুচ্ছগ্রাহিতা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন কবির কাব্যে। একই কাহিনি বারংবার অনুসরণের পিছনে সমাজের ভাঙাগড়ার ইতিহাসও কাজ করেছে যথেষ্ট।
২. মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য
সাধারণ লক্ষণ বা সাধারণ রীতি (convention) অনুসারে প্রতিটি মঙ্গলকাব্য চার ভাগে বিভক্ত। প্রথম বন্দনা অংশে সৃষ্টি স্থিতি বিষয়ক ইষ্ট দেবতাসহ বহু দেবদেবীর বন্দনা বা স্তবস্তুতি থাকে। এই বন্দনা নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক। দ্বিতীয় অংশে থাকে গ্রন্থ রচনার কারণ। কাব্য রচনার জন্য কবির প্রতি দেবদেবীর স্বপ্নাদেশ। সঙ্গে থাকে কবির আত্মপরিচয়। তৃতীয় অংশটি হল দেবখণ্ড। এতে পৌরাণিক দেবতার সঙ্গে লৌকিক দেবতার সম্বন্ধ স্থাপনের ইতিহাস পাওয়া যায়।
মঙ্গলকাব্যের সাধারণ লক্ষণ
চতুর্থ অংশ নরখণ্ডে দেবতার পুজো প্রচারের জন্য কোনো কোনো দেবতার শাপভ্রষ্ট হয়ে মর্তধামে জন্মগ্রহণের কথা রয়েছে। কাব্যের নায়ক-নায়িকারা স্বর্গের শাপভ্রষ্ট দেবতা স্থানীয়। চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু হল দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র এবং ফুল্লরা হল ইন্দ্রের পুত্রবধূ ছায়া। মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা লখিন্দর হলেন ঊষা ও অনিরুদ্ধ। সমস্ত মঙ্গলকাব্যে অভিশাপগ্রস্ত দেবদেবীরা মর্তজীবনের লীলা শেষ করে আবার স্বর্গে ফিরে যান। কাব্যের নায়ক-নায়িকার মাধ্যমে দেবদেবীরা মর্তধামে নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচার করেন।
এই নরখণ্ড বর্ণনার মধ্যে কয়েকটি আঙ্গিক রয়েছে। বারমাস্যা ও চৌতিশা সেগুলির মধ্যে অন্যতম। বারমাস্যায় কাব্যের নায়িকার বারোমাসের সুখ-দুঃখের কাহিনি বর্ণিত। চৌতিশায় রয়েছে বিপন্ন নায়ক-নায়িকা কর্তৃক চৌত্রিশ অক্ষর যোগে ইষ্টদেবের স্তবস্তুতি। এছাড়া নায়িকার সাজসজ্জা ও রন্ধন প্রণালী এবং সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠান ও নানা রীতিনীতির কথাও বর্ণিত।
সকল মঙ্গলকাব্যের গঠন প্রকৃতি বা রূপায়ণ এক ধরনের। কবিরা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণনায় লেখনী ধারণ করেন, কাব্যের নায়ক-নায়িকারা শাপভ্রষ্ট স্বর্গের দেবদেবী। সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনা, পৌরাণিক দেবদেবীর বর্ণনা, নায়ক-নায়িকার রূপ বর্ণনা, কুলকামিনীর পতি নিন্দা, রন্ধন বিবরণ, বারোমাস্যা ও চৌতিশা বর্ণনা এবং আরও অনেক কিছু হল মঙ্গলকাব্যের সাধারণ লক্ষণ। সেজন্যই মঙ্গলকাব্যের সাধারণ লক্ষণকে পুচ্ছগ্রাহিতা বলা হয়।
৩. মঙ্গলকাব্যে তৎকালীন সমাজজীবন
কবি সমাজসত্তার জাগ্রত প্রতিনিধি। সমাজজীবনে রাষ্ট্রিক, ধর্মনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার টানাপোড়েনে মানুষের জীবন যে সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা ও আনন্দ-বেদনার তরঙ্গে দোলায়িত হয়, কবির সদাজাগ্রত চিত্ততন্ত্রীতে তা বিচিত্র সুরের ঝংকার তোলে। তাই সাহিত্য প্রাচীন বা আধুনিক, যে কালেরই হোক না কেন, তাতে কম-বেশি সমাজজীবনের প্রতিফলন ঘটবেই। সামাজিক পরিবেশ ও যুগধর্মের জীবন্ত উপাদানকে আশ্রয় করেই কবি, সাহিত্যিকের ভাব-ভাবনার অভিব্যক্তি ঘটে।
মঙ্গলকাব্য কাহিনি-প্রধান, সমাজজীবনের চরিত্র ও ঘটনাশ্রয়ী বলেই মধ্যযুগের বাঙালি সমাজের প্রায় সমস্ত রীতিনীতি ব্যাবসাবাণিজ্য ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় ভিড় করে এসেছে। সমস্ত মঙ্গলকাব্যে মধ্যযুগের সমাজচিত্র ও জনজীবন সম্পর্কে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটেছে। মানুষের ধর্মবিশ্বাস, দৈনন্দিন ঘরকন্না, আহারবিহার, পোশাক-পরিচ্ছেদ, পালপার্বণ, বিবাহ, উৎসব, অনুষ্ঠান, স্ত্রীআচার, অন্নপ্রাশন, বিভিন্ন শ্রেণির নরনারীর জীবনচর্চার বিভিন্ন বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য দিক ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য-সহমরণ, বস্ত্র, অলংকার ও খাদ্যবস্তুর ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় ভিড় করে এসেছে। মঙ্গলকাব্যের সমালোচক ড. আশুতোষ ভট্টাচর্যের মতে- ‘মঙ্গলকাব্য সমাজের দর্পণ স্বরূপ।’ বাস্তবিকই সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম দলিল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যের মূলত তিনটি প্রধান ধারা- (১) মনসামঙ্গল, (২) চন্ডীমণ্ডল ও (৩) ধর্মমঙ্গল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থে কে এগুলি রচিত বলে এই তিনটি মঙ্গলকাব্যের মধ্যে কালগত ব্যবধানের জন্য সমাজজীবনের নানা পরিচয় মেলে। সামগ্রিকভাবে তা আলোচিত হল।
উচ্চ অভিজাত বণিক শ্রেণি ও নিম্নজাতির সামাজিক নিত্যকর্ম ও নৈমিত্তিক অনুষ্ঠানের বিবরণ আছে। সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাশন ও দশবিধ সংস্কারের বর্ণনা অতি নিখুঁতভাবে এতে চিত্রিত। সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। পুত্র-কন্যার বিয়েতে পিতামাতার সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। পাত্রপাত্রীর শিক্ষাদীক্ষা রূপগুণ ছাড়াও কৌলীন্য ধর্মকে অগ্রগণ্য করা হত। পাত্রী ঘরকান্নার রান্নাবান্নার কাজে সুপটু কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হত। পাত্রীর চরিত্রধর্ম বা তার সতীত্ব সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হত। বিবাহ অনুষ্ঠানে স্ত্রীআচারের
প্রাধান্য ছিল এবং বাসর জাগার রীতি ছিল। সহমরণ প্রথা সম্ভবত প্রচলিত ছিল। নারীর সতীত্ব সম্পর্কে কঠোর নিয়মরীতি ছিল। সমাজে নারীর কোনো স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল না। নারীরা অলংকারপ্রিয় ছিল। বাঙালি বেশ ভোজনরসিক ছিল। আমিষ ও নিরামিষ রান্নার জন্য পাচক-পাচিকা ছিল। সর্পদষ্ট ব্যক্তির বিষ নিবারণের জন্য ওঝা শ্রেণির গুণিন ব্যক্তির খুব কদর ছিল। তন্ত্রমন্ত্রে জনসাধারণের প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্রণদের বৃত্তি ছিল যজন যাজন। সমাজে অভিজাত শ্রেণির মেয়েদের নৃত্যগীত শেখানো হত। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে রাজকর্মচারীরা ছিল অসাধু, দুর্বৃত্ত ও অত্যাচারী। প্রাদেশিক রাজকর্মচারীদের অত্যাচার উৎপীড়নে সাধারণ কৃষকশ্রেণির মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রজারা কম দামে জিনিসপত্র বেচে খাজনা মেটাত। দেশে ন্যায়বিচার বলতে কিছু ছিল না। শাক্ত ধর্মের প্রতিপত্তি ছিল। দুর্গোৎসবের সময় ঘরে ঘরে ছাগ বলি দেওয়া হত। নীচজাতি থেকে শুরু করে ঠগ, ভন্ড, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বৈদ্য, ব্যবসায়ী, বহু বিচিত্র লোকচরিত্রের সাক্ষাৎ মেলে চন্ডীমঙ্গলে। ব্রাহ্মণদের সামাজিক বৃত্তি ছিল পূজার্চনা, শিক্ষকতা ও ঘটকালি। কেউ কেউ জমিজমাও চাষ করতেন। বৈদ্য সমাজ চিকিৎসা বৃত্তির অধিকারী ছিল। কায়স্থরা হিসাব নিরীক্ষার কাজে ব্যাপৃত থাকত। এছাড়া তেলি ও মৎস্যজীবীরা ছিল। ডোমরা সৈন্যবিভাগে খ্যাতি অর্জন করেছিল। ব্যাধরা ছিল শিকারবিদ্যায় পারদর্শী। টাকাপয়সার বিনিময়ে হাটে- বাজারে জিনিসপত্র কেনা হত। ক্রীতদাস প্রথার তখন প্রচলন ছিল। স্বর্ণকাররা অলংকার ব্যাবসা করত। ধূর্ত স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা সরল অশিক্ষিত ব্যক্তিকে তার ন্যায্য পাওনা ফাঁকি দিত। জমির পরিমাণ ও উৎপন্ন শস্যের হারে খাজনা নির্ধারিত হত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা কোনো কারণে অজন্মা হলে খাজনা মুকুব করা হত এবং দরিদ্র কৃষকদের সরকারি সাহায্য দেওয়া হত। জিনিস বন্ধক রেখে সুদে লেনদেনের ব্যবস্থা ছিল। নিম্নশ্রেণির লোকেরা কৃষির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করত। ধীবররা মাছ বেচত। ব্যাধ শ্রেণির লোকেরা পশুপক্ষীর মাংস ও বনের কাঠ ফলমূল বিক্রি করে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাত। ঐশ্বর্যশালী অভিজাত ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভোগবিলাস, অসংযম ও অমিতাচার ছিল। উচ্চবর্ণের সমাজে অবরোধ প্রথা ছিল। নিম্ন শ্রেণির সমাজে নারীদের এত কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকতে হত না। তাদের স্বাধীনতা ছিল। তারা সংসারের জন্য নানাভাবে উপার্জন করত। দরিদ্র নিম্নশ্রেণির ব্যক্তিরা কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাত। তারা ছিল সৎ, সরল ও নীতিবান। সমাজের ধুরন্ধর বুদ্ধিমানেরা তাদের ঠকাত। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সম্ভাব ও সম্প্রীতি গড়ে উঠেছিল।
ধর্মমঙ্গল কাব্যে রাঢ় অঞ্চলের বাঙালির সমাজ, জীবনযাত্রা, ধর্মবিশ্বাস, রীতিনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নিখুঁত ও বিস্তৃত পরিচয় রয়েছে। ধর্মমঙ্গলে বিবাহ, অন্নপ্রাশন, যৌতুক, দক্ষিণা, তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, লৌকিক সংস্কার ও নানা অনুষ্ঠানের পরিচয় মেলে। বিবাহে কন্যাকে যৌতুক ও দক্ষিণা দেওয়া হত। নানাপ্রকার লৌকিক বিশ্বাস ও সংস্কার মানার রীতি ছিল, তন্ত্রমন্ত্র ঝাড়ফুঁকে মানুষের আস্থা ছিল। পুত্রলাভের জন্য নানা অনুষ্ঠান ও ব্রত মানা
হৃত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রাদি পড়ানো হত। নারীরা গজমতি হার, দুল, নোলক, আংটি, কঙ্কণ ও শাঁখা ইত্যাদি পরত। ডোমজাতিরা যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণ ছিল। স্থানীয় শাসকেরা প্রজাদের উপর নানা ধরনের অত্যাচার করত। দেশে ভূমিসংস্কার ও কর আদায়ের নতুন পদ্ধতি গৃহীত হয়। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ধীবর, হাড়ি, ডোম, ছুতোর প্রভৃতি বিভিন্ন বৃত্তিধারী লোক ছিল দেশে। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্ভাব ছিল।
অনুশীলনী
১। মঙ্গলকাব্য কাকে বলে? মঙ্গলকাব্যের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ বিবৃত করো।
(উ.মা. ১৯৮২/৮৫)
২। মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক কারণ বিবৃত করো।
৩। মজঙ্গলকাব্যে তৎকালীন সমাজজীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে বর্ণনা করো।
৪। মঙ্গলকাব্যে প্রতিফলিত সে যুগের সামাজিক জীবনের একটি লেখচিত্র অঙ্কন করো। মঙ্গলকাব্য রচনার ঐতিহাসিক কারণ কী?