ভূমিকা
মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির তাগিদে মানুষ কৃষিকাজকে জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তখন ছিলনা উচ্চফলনশীল জাতের ফসল চাষ, ছিলনা সেচ-এর জন্য কোন তাগিদ, কোন ভাবনা চিন্তা, ছিলনা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। কৃষক ফসল ফলাতো দৈনন্দিন খাওয়া-শোওয়ার মতোই স্বাভাবিক নিয়মে ও স্বাভাবিক ছন্দে। তবুও ফসল ফলতো। উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ছাড়াই হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে আমাদের দেশ তথা বিশ্বের কৃষি-প্রায় স্বাভাবিক ছন্দেই। ছন্দ পতন যেটুকু হয়েছে তা হয়েছে নিজেদের চাহিদা পূরণের তাগিদে উচ্চফলনশীল ও সংকর জাতের চাষ, সেচ এর জলের ব্যবহার, শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক-এর প্রয়োগ এর ফলে। আগে কৃষকের ঘরে ছিল গোয়ালভরা গবাদিপশু, অবাধ ছিল চারণভূমি। গবাদিপশুর সারাদিনের মলমূত্র জমিতেতো পড়তোই, আবার গোয়াল ঝাঁট দেওয়া মলমূত্র জমা হতো পাশের সার গর্তে। সেই সার গাড়ি ভর্তি হয়ে জমিতে পড়তো। জমির মাটিতে যোগ হতো পর্যাপ্ত জৈব সার। ঐ জৈব সারইতো মাটিতে বসবাসকারী লক্ষকোটি জীবাণুর অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান। জৈববস্তু ছাড়া জীবাণু বাঁচে না, আবার জীবাণু না থাকলে জৈব বস্তুর পচন হয় না। রাসায়নিক সারের কার্যকারিতাও পাওয়া যায় না জীবাণুর অনুপস্থিতিতে। তাই, স্বভাবচাষী স্বাভাবিক নিয়মেই, নিজের অজান্তেই হয়তো বা, জীবাণুর উপযুক্ত লালন-পালনের ব্যবস্থা করতো। ফসল থাকলেই তার রোগ-পোকা থাকবে। অল্প হলেও তা তখনও ছিল। মানুষ গোবর জল ছিটাতো, রসুন এর রস ছিটাতো, গোমূত্র ছিটাতো, লতা-পাতা পচিয়ে ঘরে তৈরী তরল সার ছিটাতো, তাতেই ফসল রক্ষা পেতো। পুরানো গ্রন্থাদিতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, জৈব বস্তু প্রয়োগের মাধ্যমে জমির মাটিকে সুস্থ রাখার পরম্পরা সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই প্রবহমান। ডালশস্য চাষ হওয়া জমির মাটি নিয়ে আনকোরা নতুন জমিতে ছড়িয়ে দিয়ে ডালশস্য বোনার সংস্কৃতি আমাদের দেশের কৃষক সমাজের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
কীট শত্রু নিয়ন্ত্রণেও জীবাণু ব্যবহারের ইতিহাস বহু প্রাচীন। খ্রীষ্টের জন্মের ২৭০০ বছর আগেই চীন দেশে মৌমাছির দেহে রোগজীবাণুর অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যেও মৌমাছির রোগাক্রান্ত হওয়ার উল্লেখ আছে। বিভিন্ন পোকা-মাকড়, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া, রিকোট্রিক্সয়া, মাইকোপ্লাজমা এবং নিমাটোড দ্বারা ফসল আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে রাশিয়ার বিজ্ঞানী মেটনিক সর্ব প্রথম খাদ্যশস্যের বিটল জাতীয় কীট শত্রুর ‘গ্রাব’ এর উপর মাসকারডাইন ছত্রাক দ্বারা সংক্রমণ ঘটিয়ে প্রমাণ করেন যে, জীবাণুর সংক্রমণ ঘটিয়ে কীটশত্রু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ঐ ছত্রাক (মেটারহিজিয়াম এনিসোপ্লি) দ্বারা সংক্রমণ ঘটিয়ে সুগারবীট এর ‘কারকুলিও’ জাতীয় পোকার ‘গ্রাব’ বা অপূর্ণাঙ্গ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। ৩০০০-এরও বেশী অণুজীব (Micro organism) কীটশত্রুর দেহে সংক্রমণ ঘটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। ১৯২৬ সালে স্যান্ ফোড মাটিতে জৈব সার প্রয়োগের মাধ্যমে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে আলুর দেদো রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। ১৯৩০ সালে গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে উপকারী অণুজীব দ্বারা উৎপাদিত অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতিকারক ছত্রাক বা ব্যাক্টেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ।
জীবাণু কি?
জীবাণু বা অণুজীব (Microbes) হলো প্রকৃতিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীব যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবদেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অধিকাংশ জীবাণু উপকারী হলেও বেশকিছু জীবাণু ক্ষতিকারক ভূমিকা পালন করে। জীবাণু হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম জীব; এরা জল, মাটি ও বাতাসের ধূলিকণার সাথে মিশে থাকা লক্ষকোটি ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক বা ফাংগাস, ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা, অ্যান্টিনোমাইসিটিস্ ইত্যাদি। এই অসংখ্য অণুজীব সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-এর সাথে নিজেদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রেখেছে। কৃষিক্ষেত্রে এদের ভূমিকা সর্বাধিক ব্যাপক ও বিস্তৃত। মাটিতে বসবাসকারী জীবাণু, ছত্রাক ও অ্যান্টিনোমাইসিটিস্না বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে উদ্ভিদকে যোগান দেওয়া ছাড়াও কিছু জীবাণু মাটিতে সঞ্চিত খাদ্যকে (যেমন ফসফেট, পটাশ) দ্রবীভূত ও গ্রহণযোগ্য করে গাছকে নিয়মিত সরবরাহ করে থাকে। মাটিতে আশ্রিত জীবাণুগুলোর কয়েকটি গাছের শেকড়ে বাস করে মিথোজীবী ভাবে (যেমন রাইজোবিয়াম জীবাণু শিম্বী জাতীয় ফসলের গোড়ায় গুটি তৈরী করে) থাকে। বাকীরা স্বাধীনভাবে মাটিতে থেকে উদ্ভিদকে খাদ্য যোগান দেয়। বিশেষ ধরনের কয়েক প্রকার জীবাণু গাছের পাতার ‘লিপিড’ খেয়ে বেঁচে থাকে এবং গাছকে খাবার সরবরাহ করে।
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ আদর্শ মাটির প্রতি গ্রামে ১ কোটি ব্যাক্টেরিয়া, ১০ লক্ষ ছত্রাক, ১ লক্ষ অ্যাটিনোমাইসিটিস্ বসবাস করতে পারে। আবার ১ একর জমির ১৫-২০ সেমি গভীর মাটিতে ১৮০-১৮০০ কোটি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়।
অণুজীবরা সাধারণতঃ এককোষী হয়ে থাকে। ব্যাক্টেরিয়া প্রাণী বিভাগের ও ছত্রাক উদ্ভিদ বিভাগের অর্ন্তগত। মাটিতে বসবাসকারী অণুজীবদের মধ্যে কেবলমাত্র ৫ শতাংশ ক্ষতিকারক আর বাকী ৯৫ শতাংশ অণুজীবই উপকারী।
ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক বা অ্যাটিনোমাইসিটিস্ ছাড়া বেশ কিছু ভাইরাসও শত্রু পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
কৃষিতে জীবাণুর বাণিজ্যিক ব্যবহারের প্রেক্ষাপট
এ রাজ্য তথা এদেশের কৃষিক্ষেত্রে চিরাচরিত প্রচলিত ব্যবস্থায় ছন্দপতন ঘটলো ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষিক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব আরোপ করার সঙ্গে সঙ্গেই। দেশের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার মতো অবস্থা তখন আমাদের ছিল না, নির্ভর করতে হতো বিদেশের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপরে। তাই, ঐ বছর থেকেই ‘আরও খাদ্য ফলাও’ স্লোগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে। পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোর সুদৃঢ় বুনিয়াদ তৈরী না করেই উন্নয়নের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিণতি যা হওয়ার তাই হল- অনেক অনেক খাদ্যশস্য উৎপন্ন হল, পরনির্ভরতা ছেড়ে আমরা আজ কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানীকারকের ভূমিকায়। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ও বেহিসেবী রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রীড বা সংকর জাতের ফসল চাষের প্রবণতা, জৈবসার ব্যবহারের প্রতি অনীহা, যন্ত্রের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেশী লাঙ্গলেব প্রস্থান এবং সেই সাথে গবাদি পশুর সংখ্যা হ্রাস-সব মিলিয়ে আরও বেশী ফসল ফলানোর লক্ষ্যে দেশের কৃষি ব্যবস্থা আজ এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেও আজ আর আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছে না, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে কীটশত্রু যত না মরছে তার চেয়ে বেশী মরছে অন্যান্য পোকা ও উন্নত প্রাণী। গোরুর দুধে, মায়ের বুকের দুধে রাসায়নিক কীটনাশকের অবশেষ। বিগত কয়েক বছরে ফসলের শত্রু নয় এমন বহু কীটপতঙ্গ ফসলের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়ন-গ্যাটচুক্তির সুবাদে ভর্তুকী হ্রাস ও লোপ করার মধ্য দিয়ে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের আকাশ ছোঁয়া দাম-সব মিলিয়ে কৃষির সাথে যুক্ত মানুষকে বর্তমান পরিস্থিতি ভাবাতে শুরু করেছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পথ খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেছে সেই গুপ্ত পথের হদিস। জৈব ও জীবাণুর ব্যবহার। আদি ও অকৃত্রিম, সভ্যতার প্রাচীনতম সদস্য এই অণুজীবকূল, কিছু প্রতিকূলতা থাকলেও, সবচেয়ে বেশী কার্যকরী, পরিবেশ বান্ধব, লাভজনক, টেকসই ও সহজ সরল মাধ্যম-যা দিয়ে একদিকে যেমন মাটির উর্বরতাশক্তিকে ধরে রাখা যাবে, অন্য দিকে তেমনই রোগ-পোকা- আগাছাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একদিকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের আকাশছোঁয়া দাম এবং অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত ও অনিয়মিত ব্যবহারের ফলে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ও আশানুরূপ ফল না পাওয়া-এই জাঁতাকলে পড়ে কৃষক সমাজ যখন মুক্তির আশায় হাঁসফাঁস করছে তখনইতো কৃষিক্ষেত্রে উপকারী জীবাণুর বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযুক্ত সময়। বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা এগিয়ে এসেছে নানা ধরণের জীবাণুর বাণিজ্যিক উৎপাদন নিয়ে। এখন শুধু প্রয়োজন ভালো করে জেনে-বুঝে নিয়ে তার প্রয়োগ ঘটানো।
সরকারও সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে রাসায়নিক সার উৎপাদকদের জীবাণু সার উৎপাদনের নির্দেশ আরোপ করেছেন। বাণিজ্যিকভাবে ইফকো, হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন ইত্যাদি সংস্থাগুলি বিগত কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু জীবাণু সার বাজারে এনেছে। আর পশ্চিমবঙ্গের মত উচ্চ নিবিড়তাযুক্ত চাষের এলাকা, সম্ভাবনাময় বাজারের কথা মাথায় রেখে ইতিমধ্যেই বহু বেসরকারী সংস্থা ও বহুজাতিকরা কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী জীবাণু সমূহকে বাজারজাত করা শুরু করেছে।
অথচ, অধিকাংশ উপাদান খুব সহজেই বাংলার কৃষকরা নিজেরাই উৎপাদন করতে সক্ষম। যদি এই প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয় তবে কৃষক বাণিজ্যিক সংস্থার জাল থেকে সহজেই মুক্ত হতে পারবে।
কৃষিতে উপকারী জীবাণুর ভূমিকা
কৃষির যে যে ক্ষেত্রে উপকারী জীবাণুগুলি বিশেষ ভূমিকা পালন করে সেগুলো হল-
(ক) মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায়:
মাটির প্রধান উপাদান হল জৈববস্তু। বিভিন্ন ধরণের জীবাণুর দ্বারা এই জৈববস্তুর পচন ঘটে এবং তা গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসে; মাটির ক্ষারত্ব-অম্লত্ব নিয়ন্ত্রণ করে; গঠন, গ্রথন ও জল ধারণ ক্ষমতার মানোন্নয়ন করে; মাটির তড়িৎ বাহিতা নিয়ন্ত্রণ করে; মাটির প্রাণ ‘হিউমাস’ কে গঠন ও সমৃদ্ধ করে।
(খ) রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে:
বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক সার মাটির সংস্পর্শে এসে নানাধরনের ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভেঙ্গে যায় এবং গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসে। এই জটিল প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন ধরণের জীবাণু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাটির মধ্যে জটিল যৌগ অবস্থায় থাকা ফসফেট, পটাশ, সালফার ইত্যাদি খাদ্যকণাকে গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় এনে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে ক্লসট্রিডিয়াম, মাইক্রোকক্কাস, অ্যাক্রোমোব্যাক্টর, ব্যাসিলাস, ফ্রাটুরিয়া, অ্যাসিটোব্যাক্টর এর মতো অসংখ্য অণুজীব।
(গ) জৈব সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতেঃ
মাটিতে যে জৈব সার প্রয়োগ করা হয় তার পচন হয় দুই ভাবে স্বাভাবিক নিয়মে পচন (Decay) ও জীবাণুর ক্রিয়ায় পচন (Decomposition)। জীবাণুর ক্রিয়ায় পচনের ফলে সুষম হারে জৈববস্তুর পচন হয় এবং নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশ সহ নানা ধরণের খাদ্যকণা অধিক পরিমাণে গাছের কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসে। একাজের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত সেরাটিয়া, মাইক্রোকক্কাস, সিউডোমোনাস, ব্যাসিলাস, ক্লসট্রিডিয়াম, কোরাইনিব্যাকটেরিয়া, অ্যাজোটোব্যাক্টর এবং বেশ কিছু ছত্রাক ও অ্যান্টিনোমাইসিটিস্। খামারের সার, গোবর সার, কেঁচো সার, খইল সার, অ্যাজোলা, নীল সবুজ শ্যাওলা-সকল জৈববস্তুর পচনই সম্ভব হয় নানা ধরণের জীবাণুর ক্রিয়ায়। প্রতি গ্রাম কেঁচোসারে ২.৫ x ১০০ টি নাইট্রোজেন স্থিতিকারী জীবাণু এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসফেট দ্রাবক জীবাণুও পাওয়া যায়।
(ঘ) রোগ নিয়ন্ত্রণে:
ট্রাইকোডারমা, সিউডোমোনাস এর মতো ছত্রাক ও জীবাণু মাটিস্থিত নানাধরণের রোগজীবাণু ধ্বংস করে মাটিকে সুস্থ রাখে ও নানাধরণের রোগের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করে।
(ঙ) কীটশত্রু নিয়ন্ত্রণে:
ব্যাসিলাস থুরিঞ্জিয়েন্সিস জীবাণু, নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস এবং বিউভেরিয়া ব্যাসিয়ানা ছত্রাকের মতো অসংখ্য অণুজীব ফসলের নানা ধরণের কীটশত্রু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পরিবেশের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য প্রায় অক্ষুন্ন রেখেই কাঁটশত্রু নিয়ন্ত্রণ করে।
(চ) আগাছা নিয়ন্ত্রণে:
ফাইটোথোরা পামিভোরা ছত্রাক, স্ট্রেপটোমাইসেস্ হাইগ্রোস্কপিয়াস্ জীবাণুর মতো অসংখ্য অণুজীব সুনিদ্দিষ্টভাবে বেশ কিছু আগাছাকে ধ্বংস করে অথচ ক্ষেতের ফসলের কোন ক্ষতি করে না।
(ছ) নিমাটোড নিয়ন্ত্রণে:
পেসিলোমাইসেস লিলাসিনাস নামক ছত্রাক মাটির কৃমি বা নিমাটোড নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ট্রাইকোডারমা ভিরিডি নামক ছত্রাকটি নিজের মাইসেলিয়াম দ্বারা বেষ্টিত করে মাটির কৃমিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
কৃষিতে অপকারী জীবাণুর ভূমিকা
মাটি, জল ও বাতাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা লক্ষ-কোটি জীবাণুর অধিকাংশ উপকারী হলেও বেশকিছু জীবাণু অপকারীর ভূমিকা পালন করে। যেমন, মাটিস্থিত ডিনাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া নাইট্রেট যৌগকে ভেঙ্গে নাইট্রোজেন গ্যাস তৈরী করে, ফলে সারের অপচয় হয়। ম্যাক্রোফোমিনা, পিথিয়াম, ফাইটোস্থোরা, রাইজোক্টোনিয়া, কলেটোট্রিকাম ইত্যাদি ছত্রাকের বেশ কিছু প্রজাতি; সিউডোমোনাস, জ্যান্থোমোনাস জাতীয় ব্যাক্টেরিয়ার কয়েকটি প্রজাতি; ইয়েলো ভেন মোজেইক ভাইরাস, লীফ কার্ল ভাইরাস, টুংগ্রো ভাইরাস জাতীয় অণুজীব ফসলের ক্ষতি করে। এই সব ক্ষতিকর জীবাণুদের গতিবিধি সম্বন্ধেও ধারণা রাখতে হবে এং এদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপকারী জীবাণুর ব্যবহার করতে হবে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই, যথাযথভাবে।
ক্ষতিকারক অণুজীব দ্বারা বিভিন্ন ফসলে রোগের প্রার্দুভাব



২। মাটিতি অদ্রবীভূত ফসফেট দ্রাবক জীবাণুঃ
ক) ফসফেট দ্রাবক ব্যাকটেরিয়া
- ব্যাসিলাস মেগাথেরিয়াম (Bacillus megatherium)
- ব্যাসিলাস পলিমিক্সা (Bacillus polymyxа)
- সিউডোমোনাস স্ট্রায়াটা (Pseudomonas striata)
- সিউডোমোনাস র্যাথোনিস (Pseudomonas rathonis)
- -অ্যাগ্রোব্যাকটিরিয়াম (Agrobacterium sp.)
খ) ফসফেট দ্রাবক ছত্রাক
- অ্যাসপারজিলাস আওয়ামরী (Aspergillus awamori) -অ্যাসপারজিলাস ফিউমিগ্যাটাস (Aspergillus fumigatus)
- পেনিসিলিয়াম ডিজিটেটাম (Pencillium digitatum)
গ) ফসফেট দ্রাবক অ্যাক্টিনোমাইসিটিস্
- স্ট্রেপটোমাইসেস (Streptomyces)
- নোকারডিয়া (Nocardia)
ঘ) ভ্যাম বা ভেসিকুলার আরবাসকুলার মাইকোরাইজা (Vesicular Arbuscular Mycorrhiza বা VAM)
- গ্রোমাস (Glomus)
- গিগাস্পোরা (Gigaspora)
- অ্যাকাওলোস্পোরা (Acaulospora)
- এনট্রোফস্ফোরা (Entrophosphora)
- স্কেলিওসিস্টিস (Scleocystis)
- এন্ডোগন (Endogone)
৩। জৈব সার প্রস্তুতকরণ বা জৈব বস্তুর পচনে জীবাণুর ভূমিকা:
সাধারণতঃ জৈবসারের গর্তে বা মাটিতে জৈববস্তু প্রয়োগের পর নানারকম জীবাণুর আক্রমণে তা পচতে শুরু করে। ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যাটিনোমাইসিটিস প্রভৃতি জীবাণু আর্দ্রবিশ্লেষণ (Hydrolysis), জারণ (Oxidation), বিজারণ (Reduction) প্রভৃতি প্রক্রিয়ার সাহায্যে জটিল জৈব যৌগকে সরল যৌগে পরিণত করে ও গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় এনে দেয়। এদের দেহ নিঃসৃত জারকরস অনুঘটক-এর (Enzyme) কাজ করে। অবাত (Anaerobic) ও সবাত (Aerobic) শ্বসনকারী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে সবাত শ্বসনকারী ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এই পচন ক্রিয়া ত্বরান্বিত করে- প্রথমে ভাঙ্গে শর্করা, স্টার্চ, লিগলিন, সেলুলোজ প্রভৃতি নাইট্রোজেন বিহীন অংশ। পচনের পর জৈববস্তুর মধ্যে কার্বন-নাইট্রোজেন (C:N) এর অনুপাত হওয়া উচিত ১২: ১ (গড়)।
জৈব পদার্থের সরলীকরণ বা পচন সৃষ্টিকারী জীবাণুঃ
ক) সেলুলোলাইটিক বা সেলুলোজ পচনকারী
- ট্রাইকোডার্মা (Trichoderma)
- কিটোমিয়াম (Chaetomium)
- অ্যাসপারজিলাস (Aspergillus)
- সেলুলোমোনাস (Cellulomonus)
- ক্লস্ট্রিডিয়াম (Clostridium)
- নোকারডিয়া (Nocardia)
- স্ট্রেপটোমাইসেস (Streptomyces)
- পেনিসিলিয়াম (Penicillium)
খ) লিগ্নোলাইটিক বা লিগনিন পচনকারী
- ক্লাভেরিয়া (Claveria)
- সেফালোস্পোরিয়াম (Cephalosporium)
- হিউমিকোলা (Humicola)
81 গাছের শেকড়াঞ্চলে বসবাসকারী ও বৃদ্ধি উদ্দীপক ব্যাকটিরিয়া (Plant Growth Promoting Rhizobacteria বা PGPR) বা পি. জি. পি. আর. জীবাণু সার:
- ব্যাসিলাস সিরিয়াস (Bacillus cereus)
- ব্যাসিলাস ফার্মাস (Bacillus firmus)
- ব্যাসিলাস লিনিফার্মিস (Bacillus lichnifarmis)
- ব্যাসিলাস সিরুল্যান্স (Bacillus cirulans)
- ব্যাসিলাস সাবটিলিস (Bacillus subtilis)
- সিউডোমোনাস গ্ল্যাডিওলি (Pseudomonas gladioli)
- সিউডোমোনাস সেপাসিয়া (Pseudomonas cepacia) ইত্যাদি।
উপরোক্ত জীবাণুগুলির মধ্যে সাধারণভাবে শিম্বগোত্রীয় ফসলের জন্য রাইজোবিয়াম যুক্ত জীবাণুসার; অশিম্বগোত্রীয় ফসলের জন্য অ্যাজোটোব্যাক্টর, অ্যাজোস্পাইরিলাম, অ্যাসিটোব্যাক্টর, ক্লসট্রিডিয়াম এবং সব রকমের ফসলের জন্য ফসফেট দ্রাবক সহ অন্যান্য জীবাণুসার এবং সম্প্রতি পি.জি.পি.আর. জীবাণুসার ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়।
জীবাণুসার ব্যবহারের উপকারিতা:
১) মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুগুলির সংখ্যা ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ফলে আরও বেশী পরিমাণে মাটিতে কার্বন ও নাইট্রোজেন (হেক্টরে প্রায় ২০ থেকে ২০০ কেজি পর্যন্ত নাইট্রোজেন) যোগ হয়।
২) জৈব নাইট্রোজেন, মাটিতে অদ্রবীভূত ফসফেট (হেক্টরে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত) ও পটাশকে গাছের ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায় এবং সেগুলি গাছের পক্ষে গ্রহণযোগ্য বা সহজলভ্য হয়। ফলে, কম খরছে গাছের প্রয়োজনীয় সুষমখাদ্য সরবরাহ হয় এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো যায়।
৩) মাটির ভৌত, রাসায়নিক, ভৌত-রাসায়নিক এবং জৈবিক গুণাবলী বৃদ্ধি পায়।
8) গাছের পুষ্টিগ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ভিটামিন, অক্সিন ও অন্যান্য হর্মোন নিঃসরণের মাধ্যমে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
৫) বীজের অঙ্কুরোদগম, গাছের ফুলধারণ ও ফসলের পরিপূর্ণতা ত্বরান্বিত হয়।
৬) জমিতে পূর্ববর্তী ফসলে জীবাণুসার ব্যবহার করলে পরবর্তী ফসলের জন্যও মাটিতেঐ সারের গুণাগুণ বজায় থাকে।
৭) গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং মাটি বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৮) মাটিতে জৈব পদার্থের পচনে সাহায্য করে, মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়, পুষ্টি বজায় থাকে এবং সর্বোপরি গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না।
৯) মাটির জলধারণ ক্ষমতা ও মাটিতে বায়ু চলাচলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
১০) ফসলের ফলন প্রায় ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
১১) দূষণমুক্ত আর পরিবেশ সংরক্ষণকারী কৃষি উপকরণ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১২) খুব কম পরিমাণে প্রয়োজন হয়, কম মূল্যে পাওয়া যায় এবং চাষের খরচ কমে।
বিভিন্ন ধরণের উপকারী জীবাণুসারের কার্যকারিতা
রাইজোবিয়াম জীবাণুসার
রাইজোবিয়াম হল এক ধরণের অতি ক্ষুদ্র জীবাণু, যা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। এটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকারী মিথোজীবি ব্যাকটেরিয়া। গ্রীক ভাষায় “রাইজা” মানে শেকড় এবং “বায়স” মানে জীবন। শেকড়ে এই জীবাণুরা থাকে বলে এর নাম “রাইজোবিয়াম”। এই জীবাণু শিম্বগোত্রীয় অর্থাৎ শুঁটি জাতীয় গাছের শেকড়ে গুটি বা অর্বুদ তৈরী করে তার ভেতরে বাসা বাঁধে এবং সরাসরি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে ও মাটিতে সংবন্ধন করে অর্থাৎ জৈব নাইট্রোজেনে পরিণত করে ও জমিকে উর্বর করে তোলে। তাই এই ধরণের শস্যের চাষ করতে নাইট্রোজেন ঘটিত সারের বিশেষ প্রয়োজন হয় না। অধিকন্তু এই সার মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এই জীবাণু থেকেই রাইজোবিয়াম জীবাণুসার তৈরী করা হয়।
সবরকম ডালশস্যের ও শিম্বগোত্রীয় তৈলবীজের শেকড়ে একই রকমের রাইজোবিয়াম গুটি তৈরী করতে পারে না। বিভিন্ন রকম শিম্বগোত্রীয় শস্যের জন্য রাইজোবিয়ামের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। যেমন, সয়াবীনের জন্য যে রাইজোবিয়াম দরকার, ছোলার জন্য তা নয়। আবার কোন বিশেষ শিম্বগোত্রীয় শস্যের রাইজোবিয়াম সেই শস্য ছাড়াও আরও কয়েকটি ঐ জাতীয় শস্যে গুটি তৈরী করতে পারে। যেমন, মটর ও মুসুর এর জন্য রাইজোবিয়ামের জাত একই। রাইজোবিয়াম ও শিম্বগোত্রীয় শস্যের মধ্যে এই ধরনের সম্পর্ক থাকার জন্য শস্যগুলিকে কয়েকটি গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়েছে। ঐ গোষ্ঠীর কোন একটিকে যদি চাষীভাই তাঁর জমিতে একবার চাষ করেন, তাহলে সেই গোষ্ঠীর অধীনে অন্য যে কোন শস্যের শেকড়েও গুটি তৈরী করার জন্য পরবর্তী সময়ে মোটামুটিভাবে প্রয়োজনীয় রাইজোবিয়াম জীবাণু জমিতে পাওয়া যাবে। অ্যাজোরাইজোবিয়াম কলিনোড্যান্স (Azorhizobium caulinodans) নামক একটি জীবাণু রয়েছে, যা ধইঞ্চা গাছের শেকড় ও কান্ডে গুটি বা অর্বুদ তৈরী করতে সাহায্য করে। ফসল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন ‘স্ট্রেন’ কাজ করে।
রাইজোবিয়াম জীবাণু সার সম্বন্ধীয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ
(১) রাইজোবিয়ামকে চারকোল / জৈব সার / লিগনাইট জাতীয় মাধ্যমে রাখা যেতে পারে। তবে, জৈব পদার্থকে অন্য জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব নয় বলে মাধ্যম হিসাবে চারকোল ব্যবহার করা উচিত।
২) প্রতি গ্রাম রাইজোবিয়াম সারে নুন্যতম ১০৮ সংখ্যায় রাইজোবিয়ামের জীবন্ত কোষ থাকা উচিত।
(৩) রাইজোবিয়ামের যে স্ট্রেনটি ব্যবহার করা হবে সেটি যেন বিভিন্ন ভৌগোলিক
আবহাওয়ায গুটি তৈরীতে সক্ষম হয়।
(৪) রাইজোবিয়াম জীবাণুকে যে মাধ্যমে রাখা হবে সেটি যেন অন্য জীবাণু মুক্ত হয়।
(৫) রাইজোবিয়ামের আধার বা মাধ্যমটির পি. এইচ. যেন ৬.০ থেকে ৭.৫-এর মধ্যে থাকে।
(৬) রাইজোবিয়াম প্রয়োগ করা গাছটির শুকনো ওজন যেন প্রয়োগ না করা গাছের ওজনের চাইতে ৫০ শতাংশ বেশী হয়।
(৭) রাইজোবিয়াম কালচার সর্বদা পলিথিন ব্যাগে রাখা উচিত।
(৮) জীবাণু সারের প্রতিটি ব্যাগে সে সব তথ্য থাকা প্রয়োজন সেগুলি হলো-
(ক) পণ্যের নাম
(খ) কোন্ ফসলের জন্য ব্যবহার করা হবে
(গ) তৈরীর তারিখ,
(ঘ) কার্যকারীতার সময়,
(ঙ) ব্যাচ নং,
চ) সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিষদ বিবরণের বয়ান নিম্নরূপ- (
STORE IN COOL AND DRY PLACE AWAY FROM
DIRECT SUNLIGHT AND HEAT.
(ছ) ব্যবহার বিধি, (
জ) উৎপাদকের নাম ও ঠিকানা।
বিভিন্ন শস্যের উপযোগী রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর প্রজাতিসমূহ


রাইজোবিয়াম কি ভাবে কাজ করে:
নাইট্রোজেন প্রোটিনের এক প্রধান উপাদান এবং প্রোটিন জীবদেহের প্রধান উপাদান সুতরাং জীবের দেহকোষ গঠনের জন্য নাইট্রোজেন একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনমত নাইট্রোজেন না পেলে কোন জীবনই, সে মানুষ হোক বা গাছই হোক, ভালোমতো বৃদ্ধি পায় না। বাতাসে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন আছে-শতকরা প্রায় ৭৭.১৭ ভাগ। কিন্তু তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কারণ নাইট্রোজেন হল একটু আল্ল্সে অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় ধরনের মৌলিক পদার্থ। ফলে মানুষের ক্ষেত্রে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য এবং গাছের জন্য কৃত্রিমভাবে তৈরী নাইট্রোজেন ঘটিত সার দিয়ে এই অভাব মেটানো হয়। অথচ মানুষ বা গাছ যা পারে না, তা প্রকৃতির অদ্ভুত নিয়মে এই জীবাণুরা বাতাস থেকে মাটিতে সরাসরি নাইট্রোজেন বেঁধে নিয়ে আসতে পারে এবং তা নিজেদের কাজে লাগায়।
নাইট্রোজেন সরাসরি বাতাস থেকে নিতে পারে বলেই এই জীবাণুদের বলা হয় “নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী” জীবাণু। যেহেতু শিম্বগোত্রীয় গাছের শেকড়ে এই জীবাণুদের বাসা বা কারখানা, সেই কারণে শিম্বগোত্রীয় গাছকেও নাইট্রোজেনের জন্য চিন্তা করতে হয় না। এই জীবাণুদের তৈরী নাইট্রোজেনেই তাদের কাজ চলে, পরিবর্তে গাছ থেকে জীবাণুরা তাদের প্রয়োজনীয় শর্করা জাতীয় খাদ্য পায়। ফলে শিম্বগোত্রীয় গাছের সাথে এই জীবাণুদের এক সুন্দর বোঝাপড়া সবসময় বজায় থাকে। আর, এই বোঝাপড়ার ফলেই মাটিতেও নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
বিভিন্ন শিম্বগোত্রীয় শস্যের জন্য রাইজোবিয়ামের প্রকারভেদ থাকায় ঐ শস্যের জীবাণুদের বাতাস থেকে নাইট্রোজেন বন্ধন করার ক্ষমতাও বিভিন্ন। গুটি যত বেশী পুষ্ট এবং লালচে বর্ণের হবে, সেই গুটির রাইজোবিয়ামও ততটা ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। এই সংবন্ধন করা নাইট্রোজেন শিম্বগোত্রীয় শস্যের নিজের প্রয়োজনে লাগার পরেও কিছু নাইট্রোজেন মাটিতে থেকে যায়। তার ফলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে। সুতরাং এজাতীয় শস্য চাষের পর চাষীভাই তার জমিতে ধান বা পাট যাই-ই চাষ করুন না কেন, তাতে সুপারিশ করা নাইট্রোজেনের পরিমাণ থেকে কিছু কম পরিমাণ নাইট্রোজেন ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনও সার ব্যবহার না করে শুধুমাত্র ভালো গুটি তৈরী হয়, এমন ডালশস্য বা শিম্বগোত্রীয় তৈলবীজ চাষ করলে জমিতে কতখানি নাইট্রোজেন বাঁধা পড়বে, সেটা জানা যাবে এই সারণী থেকে-
বিভিন্ন শিম্বগোত্রীয় শস্যের মাধ্যমে মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধনের পরিমাণ

বেশী পরিমাণ নাইট্রোজেন সংবন্ধন করার ক্ষমতা নির্ভর করে শিম্বগোত্রীয় শস্যের শেকড়ে অধিক পরিমাণে পুষ্ট লালচে বর্ণের গুটি বা অর্বুদের ওপর। কিন্তু যে জমিতে চাষীভাই এজাতীয় শস্য চাষ করবেন, সে জমিতে অনেক সময় প্রয়োজনীয় রাইজোবিয়াম জীবাণু থাকে না কিংবা থাকলেও ততটা কার্যকরী হয় না। সেক্ষেত্রে বলা হয় যে জমিতে এই ধরণের শস্য চাষ হয়, তার মাটি নিয়ে জমিতে ফেললে ফল পাওয়া যেতে পারে। কথাটা আংশিক সত্য। এ পদ্ধতি আগে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এতে একটা অসুবিধা হল এই যে, ঐ মাটিতে যদি গাছের পক্ষে কোন ক্ষতিকারক জীবাণু থাকে, সেটাও চাষীভাইয়ের জমিতে ছড়িয়ে পড়বার আশঙ্কা থাকবে এবং শুধু তাই নয় রাইজোবিয়ামের শত্রু জীবাণুও এর সাথে স্থানান্তরিত হয়ে অন্য শস্যের প্রয়োজনীয় রাইজোবিয়ামকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি হল, রাইজোবিয়ামকে পরীক্ষাগারে জীবাণুসারে পরিণত করে চাষের জমিতে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা।
নাইট্রোজেন আবদ্ধকরণ ও গুটি তৈরীর শর্তগুলো হ’ল:
(১) মাটিতে গ্রহণযোগ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ-মাটিতে গ্রহণযোগ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশী হলে নাইট্রোজেন আবদ্ধ ও গুটি তৈরী কম হয়।
(২) মাটির পি.এইচ. মাটির পি.এইচ. ৬.০-এর কম এবং ৮.০-এর বেশী হলে মাটিতে রাইজোবিয়াম ও গুটির বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
(৩) মাটিতে ফসফরাসের গ্রহণযোগ্যতা-মাটিতে ফসফরাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে গুটি তৈরী ও নাইট্রোজেনের সংযোজন বেশী হয়।
(৪) কীটনাশক/ছত্রাকনাশক/আগাছানাশকের ব্যবহার — দেখা গেছে গাছে, পাতায় এসব রাসায়নিকের উপস্থিতি রাইজোবিয়াম তৈরীতে কোনো রকম বিরূপ প্রভাব ফেলে না। কিন্তু বীজ শোধনের রাসায়নিক সমূহ যেমন থাইরাম বা পারদ ঘটিত বীজ শোধনের রাসায়নিক ব্যবহারে রাইজোবিয়াম জীবাণু মারা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাইজোবিয়াম ব্যবহারের মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে। কিন্তু ম্যানকোজেব বা কার্বেন্ডাজিম এর মত ছত্রাকনাশক ব্যবহারে রাইজোবিয়ামে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। দানা জাতীয় কীটনাশকের মধ্যে ফোরেট-১০ জি ব্যবহারে রাইজোবিয়ামের ক্ষতি হলেও কার্বোফিউরান-৩ জি ব্যবহারে রাইজোবিয়ামের কোনো ক্ষতি হয় না।
অ্যাজোটোব্যাক্টর ও অ্যাজোস্পাইরিলাম জীবাণু সার
যে কোন অশিম্বগোত্রীয় ফসলের জন্য অ্যাজোটোব্যাক্টর ও অ্যাজোস্পাইরিলাম হল উচ্চমানের মুক্তজীবি নাইট্রোজেন স্থিতিকারী জীবাণু। অ্যাজোটোব্যাক্টর এমন একটি বায়ুজীবি/মুক্তজীবি/স্বাধীনজীবি ব্যাকটেরিয়া যার বাঁচার জন্য এবং নাইট্রোজেন স্থিতিকরণের জন্য কোন উদ্ভিদের দরকার হয় না। এই জীবাণুটির ৭টি প্রজাতির মধ্যে যে তিনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি হল অ্যাজোটোব্যাক্টর ক্রুকক্কাম (Azotobactor chroococcum), অ্যাজোটোব্যাক্টর ভিনেল্যান্ডি (A. vinelandii) ও অ্যাজোটোব্যাক্টর বিজেরিঙ্কিয়া (A. beijerinkia)। কোনো একটি মরশুমে এই জীবাণুটি হেক্টর প্রতি জমিতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ কেজি পর্যন্ত নাইট্রোজেন সংবন্ধন করতে পারে। এই জীবাণুটি অম্লমাটির (পি.এইচ.-৬.০-এর নীচে) ক্ষেত্রে খুব সংবেদনশীল এবং মুক্ত বায়ুজীবি হওয়ায় জল দাঁড়ানো সহ্য করতে পারে না। তবে ধানের জমিতে এটা কাজ করে। এর কারণ, সম্ভবতঃ জমিতে উপস্থিত শ্যাওলা/শৈবাল যে অক্সিজেন মুক্ত করে, তা নিয়ে জীবাণুটি বেঁচে থাকে।
অ্যাজোটোব্যাক্টরের মত অ্যাজোস্পাইরিলাম হল মাটিতে স্বাধীনভাবে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া, যার চারটি প্রজাতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি হল অ্যাজোস্পাইরিলাম লিপোফেরাম (Azospirillum lipoferum) ও অ্যাজোস্পাইরিলাম ব্রাসিলেন্স (A. brassilence)। মূলতঃ নীচু জমির ধানের জন্য খুব কার্যকরী হলেও উঁচু জমির ফসলের জন্যও এর ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। অ্যাজোটোব্যাক্টরের মতই এটি ব্যবহার করা হয় এবং এর নাইট্রোজেন স্থিতিকরণ ক্ষমতা একই। প্রতি গ্রাম বাণিজ্যিক উৎপাদনে অণুজীব কোষ থাকা আবশ্যক (ন্যূনতম) ১০৮টি।
জীবাণুসারদুটি চারার শিকড় শোধন অথবা সরাসরি মাটিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সে সমস্ত ফসলে এদের প্রয়োগ করা যায়, সেগুলি হল উচু জমির ধান, গম, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, সরিষা, তিল, সূর্যমুখী, তিসি, কুসুম, আখ, আলু, তুলো, তামাক, পাট, কলা, আঙ্গুর, তরমুজ, সবজি ইত্যাদি।
অ্যাজোটোব্যাক্টর ব্যবহারের সুবিধা
১) নাইট্রোজেন আবদ্ধকরণ — অ্যাজোটোব্যাক্টর প্রতি গ্রাম নাইট্রোজেন ব্যবহার করে ১০ গ্রামের বেশী নাইট্রোজেন উদ্ভিদকে সরবরাহ করতে পারে।
২) উপকারী হরমোন, উৎসেচকের ক্ষরণ— অ্যাজোটোব্যাক্টর ক্রুকোক্কাম থায়ামিন, রাইবোফ্লাবিন, পাইরিডক্সিন, সায়ানোকোবালামিন, নিকোটিনিক অ্যাসিড, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, ইন্ডেন্টাল অ্যাসেটিক অ্যাসিড, জিব্বারেলিক অ্যাসিড ইত্যাদি ক্ষরণের মাধ্যমে ফসলকে বৃদ্ধি ও পুষ্টিতে সহায়তা করে থাকে।
৩) ফসলকে রোগের হাত থেকে বাঁচানো— অ্যাজোটোব্যাক্টর ক্রুকোক্কাম ছত্রাকনাশক/ব্যাক্টেরিয়ানাশক ক্ষরণ উৎপাদন করে ক্ষতিকারক ছত্রাক যেমন, অল্টারনেরিয়া, হেলমিথোস্পোরিয়াম কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
8) ফসল বৃদ্ধিতে অ্যাজোটোব্যাক্টরের ভূমিকা– বিভিন্ন ফসলে অ্যাজোটোব্যাক্টরের ব্যবহারে গমে-১৫.১ শতাংশ, ভুট্টায়-১৯.৫ শতাংশ, টমাটোয়-১৫.১ শতাংশ, লঙ্কাতে- ৬.৩ শতাংশ, ধানে-১৪ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে।
যে সকল কারণে অ্যাজোটোব্যাক্টরের কার্যকারিতা প্রভাবিত হয়-
১) পি. এইচ. — পি. এইচ. ৬-৭.৪ এ নাইট্রোজেন সংবন্ধনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশী।
২) মাটিতে জলের পরিমাপ— স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে অ্যাজোটোব্যাক্টর-এর কার্যকারিতা বেশী লক্ষ্য করা গেছে। বদ্ধ জলাতে এর কার্যকারিতা কম হয়।
৩) রাসায়নিক নাইট্রোজেনের উপস্থিতি— রাসায়নিক নাইট্রোজেনের উচ্চ উপস্থিতি অ্যাজোটোব্যাক্টরের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়।
৪) মাটির তাপমাত্রা — সাধারণতঃ ২০-৩৫° সেলসিয়াস মাটির তাপমাত্রা অ্যাজোটোব্যাক্টর বৃদ্ধির সহায়ক।
৫) কীটনাশক/ছত্রাক নাশক ব্যবহার — কার্বেন্ডাজিম, ম্যানকোজেব, বেনোমিল, সালফার ব্যবহারে অ্যাজোটোব্যাক্টরের কোন ক্ষতি হয় না।
কীটনাশকের মধ্যে মিথাইল প্যারাথিয়ন, ম্যালাথিয়ন ও ফসফামিডন ইত্যাদি প্রয়োগ করলে অ্যাজোটোব্যাক্টর নষ্ট হয়। অপরদিকে কার্বোফুরান, মনোক্রটোফস্ ব্যবহারে অ্যাজোটোব্যাক্টর উদ্দীপিত হয়। কিন্তু ফোরেট ও কারবারিল ব্যবহার প্রাথমিক পর্যায়ে অ্যাজোটোব্যাক্টরের ক্ষতি করলেও পরবর্তী ৬-১০ দিনে অ্যাজোটোব্যাক্টর দ্বারা ঐ রাসায়নিক নিষ্ক্রীয় হয়ে যায়।
অ্যাজোস্পাইরিলাম ব্যবহারের সুবিধা
১) নাইট্রোজেন আবদ্ধকরণ — দেখা গেছে অ্যাজোস্পাইরিলামের কোন কোন স্ট্রেন প্রতি গ্রাম কার্বন আত্মীকরণের মাধ্যমে ৫-১৫ মিলিগ্রাম নাইট্রোজেন উৎপাদন করতে সক্ষম। যে সকল প্রজাতি ১০ মিলিগ্রামের বেশী নাইট্রোজেন উৎপাদন করতে পারে সে গুলোই উৎকর্ষ মানের। বীজশোধন বা মাটিতে জীবাণু সার প্রয়োগ করলে অ্যাজোস্পাইরিলামের মাধ্যমে প্রতি হেক্টরে প্রায় ২৫ কেজি নাইট্রোজেন সঞ্চিত হতে পারে।
২) উদ্ভিদ হরমোন, উৎসচেক ও ভিটামিন ক্ষরণ — অ্যাজোস্পাইরিলাম নানা ধরণের উদ্ভিদ বৃদ্ধি সহায়ক হরমোন ও ভিটামিন ক্ষরণ করে ফসলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৩) ফলন বৃদ্ধি — অ্যাজোস্পাইরিলাম প্রয়োগে কয়েকটি ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। গমে ৬ শতাংশ, ধানে ১৭.৩০ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি হতে দেখা গেছে।
যে সকল কারণে অ্যাজোস্পাইরিলামের কার্যকারিতা প্রভাবিত হয়-
১) মাটির পি.এইচ-৬.০৭.৫ পি. এইচ-এ অ্যাজোস্পাইরিলামের কাজ ভালো হয়।
২) বেশী সময় ধরে মাটিতে জল জমে থাকলে অ্যাজোস্পাইরিলামের কার্যকারিতা কমে।
সাধারণতঃ প্রতি হেক্টরে ৬০-৮০ কেজি নাইট্রোজেন প্রয়োগে এই জীবাণু সারের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। ৩)
৪) ফসফরাসের ঘাটতিযুক্ত মাটিতে ফসফরাস প্রয়োগ করলে নাইট্রোজেন আবদ্ধের পরিমাণ বাড়ে।
৫) সালফার, ম্যানকোজেব, ক্যাপটান, কার্বেন্ডাজিম, বেনোমিল ইত্যাদি সঠিকমাত্রায় প্রয়োগ করলে অ্যাজোস্পাইরিলামের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কার্বোক্সিন, থাইরাম এর ব্যবহার অ্যাজোস্পাইরিলামের বৃদ্ধির অন্তরায়।
অপরদিকে কুইনলফস, ফসফামিডন, ফেনথিয়ন ইত্যাদি কীটনাশক অ্যাজোস্পাইরিলাম এর ক্ষতি করে বা কার্যকারিতা হ্রাস করে।
অ্যাজোটোব্যাক্টর বা অ্যাজোস্পাইরিলাম কখন ব্যবহার করতে হবে
এই দুটি জীবাণু সার অশিম্বজাতীয় যে কোনো ফসলে প্রয়োগ করা যায়।
তবে অ্যাজোটোব্যাক্টর, অ্যাজোস্পাইরিলাম ব্যবহারের বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র হল-
১) অ্যাজোটোব্যাক্টর সাধারণতঃ বেলে বা বেলে দোয়াঁশ মাটিতে, যেখানে জল ধারণ ক্ষমতা কম সেখানে ভালো কাজ করে।
২) কাদা মাটি, জল ধারণ ক্ষমতা বেশী, কিন্তু জল নিষ্কাশণের ব্যবস্থা রয়েছে, মাটিতে বাতাসের পরিমাণ কম, এই রকম মাটিতে অ্যাজোস্পাইরিলাম ভালো কাজ করে।
৩) আবার যেখানে মাটির অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু মাটিতে জল দাঁড়িয়ে আছে (জলাভূমি নয়) সেখানে অ্যাজোটোব্যাক্টর ও অ্যাজোস্পাইরিলাম ৫০ : ৫০ মাত্রায় ব্যবহার করা যায়।
অ্যাজোস্পাইরিলাম বা অ্যাজোটোব্যাক্টর কিভাবে ব্যবহার করা হয়
বীজ শোধন — ভালো করে বীজ শোধনের জন্য প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ২০ গ্রাম করে জীবাণু সার ব্যবহার করা যায়। প্রথমে ২০০ গ্রাম জীবাণু সার ৩০০-৪০০ মিলি জলের সঙ্গে মেশাতে হবে। এবার জীবাণু মিশ্রিত দ্রবণ ১০ কেজি বীজের সঙ্গে এমনভাবে মেশাতে হবে যাতে প্রতিটি বীজের গায়ে জীবাণু সার লেগে যায়। উক্ত বীজ এবার ছায়ায় শুকোতে হবে।
চারা শোধন —১ কেজি জীবাণু সার ৫-১৫ লিটার জলে গুলে দ্রবণ তৈরী করতে হবে। চারার শেকড়ে আবদ্ধ মাটি ধুয়ে চারাগুলো বাণ্ডিল করে ২৫-৩০ মিনিট ঐ দ্রবণে ডুবিয়ে জল ঝরিয়ে নিয়ে ১ একর জমিতে রোপণ করা যাবে।
মাটিতে অ্যাজোস্পাইরিলাম/অ্যাজোটোব্যাক্টরের ব্যবহার-
প্রতি একরের জন্য ৬ কেজি অ্যাজোটোব্যাক্টর/অ্যাজোস্পাইরিলাম জীবাণু সার ১০০ কেজি জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে সেচ দেওয়ার আগে মাটিতে দিতে হবে। তবে, আখ বা আলুর জন্য প্রথম চাপান হিসেবে ৩ কেজি ৩০ দিন ও দ্বিতীয় চাপান হিসেবে ৩ কেজি ৬০ দিনের মাথায় মাটি ধরানোর সময় প্রয়োগ করতে হবে।
চারাগাছের ক্ষেত্রে গাছ পিছু ২৫ গ্রাম জীবাণু সার ৫০০ গ্রাম জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।



