উপক্রম – বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পরিচয়

ভাষা অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের সঙ্গে মেলবার উদ্দেশ্যে। সাধারণত সে মিলন নিকটের এবং প্রত্যহের। সাহিত্য এসেছে মানুষের মনকে সকল কালের সকল দেশের মনের সঙ্গে মুখোমুখি করবার কাজে। প্রাকৃত জগৎ সকল কালের সকল স্থানের সকল তথ্য নিয়ে, সাহিত্য জগৎ সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষের কল্পনাপ্রবণ মন নিয়ে। এই জগৎ সৃষ্টিতে যে সকল বড়ো বড়ো রূপকার আপন বিশ্বজনীন প্রতিভা খাটিয়েছেন সেই সব সৃষ্টিকর্তাদের মানুষ চিরস্মরণীয় বলে স্বীকার করেছে। বলেছে তাঁরা অমর।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১. সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাস

মানুষের চিন্তাভাবনা ও অন্যান্য সমস্ত কাজকর্ম ইতিহাসের প্রভাব-নিয়ন্ত্রিত ফলশ্রুতি। তাই সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ও সংস্কৃতি সমস্ত কিছু সৃষ্টির পিছনেই রাষ্ট্রিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মনৈতিক জীবনের অল্পবিস্তর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ প্রভাব অবশ্যম্ভাবী।

সাহিত্যের বিষয়বস্তু মানবজীবন। চলমান মানবজীবনের বিচিত্র সুখদুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিচিত্র অনুভূতির কাহিনি সাহিত্যে রসসৌকর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। সাহিত্য হল ভাষা-শিল্প, রসের শিল্প। রসবস্তুর বিচারে সাহিত্য হল বহু বিচিত্র মানবিক জীবনলীলার শাশ্বত ফসল। রসসৌকর্যের বাইরে সমাজের আর পাঁচটা বস্তুর সঙ্গে সাহিত্যেরও যোগসূত্র থাকে। সাহিত্যিকের জীবনচর্যার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক কী, সাহিত্যিকের ওপর সমকালীন যুগজীবনের প্রভাব কতটুকু এবং কোনো কবির সৃষ্টি-সম্পদ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সাহিত্যধারার সঙ্গে কতটুকু যোগাযোগ রক্ষা করে ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে- সাহিত্যের ইতিহাসে এই সমস্ত দিক আলোচনা করলে রসসৌকর্যের সৃষ্টিগত সামগ্রিক দিকটি পরিস্ফুট হয়।

তাই সাহিত্যকে আমরা যতই নির্বিকল্প বা নির্বস্তুক বলি না কেন তার একটা বাস্তব অধিষ্ঠানভূমি থাকবেই। কারণ, কবি বা সাহিত্যিক যেহেতু একজন সামাজিক জীব, তাই তার চিন্তাভাবনা ও অনুভূতির পিছনে সমকালীন যুগজীবনের অল্পবিস্তর প্রভাব প্রতিফলিত হবেই। যে-দেশে যে-যুগে ও যে-পরিবেশে সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেন-মূলত সেই জীবন্ত চলমান জীবনধারাই তাঁর মনোজীবনকে গড়ে তোলে। এ প্রসঙ্গে ‘An Introduction to the Study of Literature’ গ্রন্থে ইংরেজ সমালোচক উইলিয়ম হেনরি হাডসনের একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:

“As behind every book that is written lies the personality of the man who wrote it and as behind every national literature lies the character of the race which produced it, so behind the literature of any period lies the combined forces personal and impersonal-which made the life of that period, as a whole what it was.”

সমালোচক W. H. Hudson-এর মতে সাহিত্য যেহেতু লেখক ও জাতীয় জীবনের impersonal force-এর সমন্বয়ী ফসল, তাই প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যের ইতিহাস হচ্ছে সমসাময়িক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যকর্মের বিচার ও বিশ্লেষণ। সাহিত্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সমাজজীবন কতখানি সংযোগ রক্ষা করেছে- সৃষ্টির পিছনে কবির ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা কীভাবে ও কতখানি কাজ করেছে, জগৎ ও জীবনের প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ কী, সমকালীন জীবনধর্মের ঊর্ধ্বে কবির কল্পনা চিরকালীন মানবহৃদয়কে কতখানি তুলে ধরেছে-এ সমস্তই সাহিত্যের ইতিহাসের বিষয়বস্তু।

দ্বিতীয় কথা, সাহিত্যের বিবর্তন ও বিকাশে পূর্বাপর যোগসূত্রকে যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে ভাবধারা ও ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারাটিকে সুস্পষ্ট করে তুলতে হবে। বিভিন্ন যুগে যুগধর্মের প্রভাবে জীবনধারার বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তনের স্তর-পরম্পরায় সাহিত্যের রূপ ও রীতির পরিবর্তন ঘটে। এ সম্পর্কে মোহিতলাল মজুমদারের উক্তি প্রণিধানযোগ্য-

উপক্রম

‘কোনো সাহিত্যই দেশকালের প্রভাববর্জিত নয়। সাহিত্যের জন্ম হয় দেশকালের গণ্ডির মধ্যে, সেইখান হইতেই তাহার শিকড়গুলি রসসন্বয় করে, ফুল মাটির উপরে, এমনকি বহু উচ্চে পৃথক বৃত্তে ফুটিয়া উঠে বটে, কিন্তু সকল জাগতিক সৃষ্টির মতো তাহার বিকাশ হয় পার্শ্বভৌতিক নিয়মে। তারপর সেই বিকাশের চরম ভঙ্গিটি দেখিয়া তাহার মূল্য-নিরূপণ হয়। তখন রসিক ব্যক্তিরা তাহার সৌন্দর্যরটুকুরই বিচার করেন, এবং সেই রস-রূপটি তাহার একমাত্র সার্থক লক্ষ্মণ বলিয়া স্বীকার করেন। এই বিচার যথার্থ, ইহার বিরুদ্ধে বলিবার কিছু নাই। কিন্তু তথাপি দেশকাল এবং জাতি বা সমাজবিশেষের সম্পর্ক তাহার ক্ষয়বৃদ্ধির মূলে প্রচ্ছন্ন থাকিলেও বেশ ঘনিষ্ঠ হইয়াই আছে। নির্বিশেষে রসের বিচারে তাহাকে বাদ দিলেও, তাহার উৎপত্তি ও বিকাশধর্মের সঙ্গে এই সকলের একটি নিবিড় যোগ আছে, রসিক সমাজের রত্নাগারে স্থান পাইবার পূর্বে সাহিত্যকে তাহার কারখানা বা রসশালায় একটা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া গড়িয়া উঠিতে হয়। এই কার্যকারণতত্ত্ব সাহিত্যের পক্ষেও

সমান বলবৎ-জগতের কোনো কিছুই স্বয়ম্ভু বা ভূঁইফোড় নহে।’ এস্থলে মনে রাখতে হবে, কোনো যুগ আপনাতে আপনি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মানবসভ্যতার

যে-যুগবিভাগ করা হয়েছে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক-তা ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিকাশের অনবচ্ছিন্ন জীবনধারা। একটি যুগ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বাতন্ত্র্য প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে। লেখকের রচনায় সেই নতুন জীবনের রূপটি প্রতিভাত হয়। সেই প্রকাশগত দিকটি আবার ভাষার বিবর্তনেও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে যে, সাহিত্যের ইতিহাস মানে শুধু সাহিত্য-ধর্ম বা সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রেক্ষাপটের ইতিহাস আলোচনা নয়। সাহিত্য ও ইতিহাসের সুষম মেলবন্ধনে সাহিত্যকর্মের বিচার, বিশ্লেষণ ও

সামগ্রিক মূল্যায়নই সাহিত্যের ইতিহাসের মূল কথা।

সাহিত্য জাতির ধ্যানধারণা, তার মানস ধর্ম ও কর্মসাধনার দর্পণ। সাহিত্য বহন করে জাতির অনন্তযুগ ও জীবনজিজ্ঞাসার স্বাক্ষর। অপরদিকে জাতির মানস গঠনে সাহিত্যেরও বিরাট এক দায়িত্ব থাকে। সাহিত্য যেমন সমাজ থেকে অনেক কিছু নেয়, সমাজকে দেয়ও অনেক কিছু। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে, সাহিত্য সমাজ-নিরপেক্ষ নয়, আবার সমাজ সাহিত্য-নিরক্ষেপ নয়, অথচ যে যার নিজের এলাকায় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। সাহিত্যের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য হল সেই নেওয়া ও দেওয়ার সম্পর্ক ও তার স্বরূপটি সুস্পষ্ট করে তোলা। এরই মাধ্যমে ধরা পড়ে বিভিন্ন কালে সাহিত্য নদীর স্রোতের মতো বাঁক পরিবর্তন করে ভাব ও রূপগত আঙ্গিকে অর্থাৎ ভাষা ও আলঙ্কারিক বৈচিত্র্যে কীভাবে বিভিন্ন যুগে স্বাতন্ত্র্যদ্যোতক হয়ে উঠেছে।

২. বাঙালি জাতির উদ্ভব

সাহিত্যিক একজন সামাজিক জীব। তাই যে-দেশে, যে-কালপরিধি ও সমাজব্যবস্থার

মধ্যে তাঁর জীবন বর্ধিত হয়-মূলত সেই জীবন্ত দেশকালের পটভূমি থেকেই তাঁর জীবন ভূমিকা, সাহিত্য দেশ ও জাতি সম্পর্কিত সমস্ত ধ্যানধারণা ও চিন্তাভাবুকতার উদ্ভব ঘটে। এভাবেই সাহিত্যের মধ্যে সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত অনুভূতি বা ভাব-কল্পনার সঙ্গে দেশ ও জাতির রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সাহিত্যে দেশ ও জাতির এই অখণ্ড সংহতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

‘মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানের, দূরের সহিত নিকটের অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগসাধন সাহিত্য ব্যতীত আর কিছুর দ্বারাই সম্ভবপর নহে, যে দেশে সাহিত্যের অভাব সে দেশের মানুষ পরস্পর সঞ্জীব বন্ধনে আবন্ধ নহে-তাহারা বিচ্ছিন্ন।’

পূর্বভারতের একটি বিশিষ্ট জাতি বাঙালি। বাঙালির সুদীর্ঘকালের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, ভালোমন্দ, সুখদুঃখ-তার রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উত্থানপতনের ইতিহাস সুসংবদ্ধ হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যে।

‘জাতি’-এই শব্দটির বিভিন্ন অর্থ হয়। সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন- ‘এই ভারতবর্ষের নানা জাতি। বাসস্থানের প্রভেদে, বংশের প্রভেদে, ধর্মের প্রভেদে নানা জাতি।’

তাই ইংরেজ জাতি ও ভারতীয় জাতি, হিন্দু জাতি ও মুসলমান জাতি, ব্রাহ্মণ জাতি ও কায়স্থ জাতি, আবার বাঙালি জাতি ও অসমীয়া জাতি-এরূপ বিভিন্ন অর্থেই আমরা জাতি শব্দটিকে প্রযুক্ত হতে দেখি। প্রদেশভেদেই আমরা বলি বাঙালি জাতি ও অসমীয়া জাতি।

বাঙালি জাতি বলতে-বঙ্গপ্রদেশে জন্মসূত্রে বাংলা ভাষাভাষী অধিবাসীদেরই প্রতিপন্ন করে। তাই বাঙালি জাতির ইতিহাস আলোচনার আরম্ভে বাংলা-ভূখণ্ডের ভৌগোলিক সীমার কথা জানা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

আমরা যে বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি-সাহিত্যের দিক থেকে তার পরিসীমা হিসাবে মুখ্যত অবিভক্ত বাংলাদেশকেই স্বীকার করে নিতে হবে। এখন বাংলাদেশ নামে যে নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-তা সুপ্রাচীনকাল থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলারই অংশবিশেষ ছিল।

আমাদের আলোচ্য বাঙালি জাতি অবিভক্ত এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মানুষকে নিয়ে। বিভক্ত বাংলা ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্ম থেকে প্রায় হাজার বছরের যে বাংলা অখন্ড বাংলা সাহিত্য সাহিত্যের বিচিত্র ধারা-তার মধ্যে অবিভক্ত অখন্ড বাংলার জল হাওয়া শস্যে পরিপুষ্ট বাঙালির সুখদুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা আনন্দের বিচিত্র অনুভূতি বাণীবদ্ধ হয়ে আছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পরিণতি হিসাবে বাংলাদেশের আকৃতি দ্বিখণ্ডিত ও পরিবর্তিত হলেও এপার বাংলা ‘পশ্চিমবঙ্গের’ সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে ওপার বাংলা ‘বাংলাদেশের’ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিগূঢ়তম যোগসূত্র অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা সৃষ্টিকর্মে উল্লেখযোগ্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঙালি জাতির প্রাণমন ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার অখন্ড ইতিহাস। ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলেও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে দু-ভাগ করা যাবে না।

প্রাচীনকালে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোনো সীমানা ও নাম ছিল না। হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান বাংলার সীমা যুগে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। সংস্কৃতির ইতিহাসবেত্তা ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ভাষা ও সাহিত্যের পেয়েছেন:

সীমাস্বরূপ বাংলাদেশকে মোটামুটি এভাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস ‘উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয় হইতে নেপাল, সিকিম ও ভুটান রাজ্য উত্তর-পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তরসীমান্তবর্তী সমভূমি, পূর্বদিকে গারো খাসিয়া জৈতিয়া ত্রিপুরা চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণি বাহিয়া দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত। পশ্চিমে রাজমহল-সাঁওতাল পরগনা ছোটোনাগপুর

মালভূমি-ধলভূমি-কেওঞ্জর-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর-এই ভূখণ্ডেই ঐতিহাসিক কালের বাঙালির কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্মকর্ম নর্মভূমি।’

বর্তমানকালের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ, আসামের কাছাড়, গোয়ালপাড়া, বিহারের পূর্ণিয়া, মানভূম, সিংভূম ও সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি অঞ্চল প্রাচীন বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তথাকথিত বাংলাদেশ উত্তরবঙ্গে পুন্ড্র ও বরেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় ও তাম্রলিপ্তি এবং দক্ষিণবঙ্গে সমতট ও হরিকেল এবং পূর্ববঙ্গে বাংলা প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদ অংশে পরিচিত ছিল।

প্রাচীন সংস্কৃত ও বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে এবং ভ্রমণবৃত্তান্তে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির উল্লেখ রয়েছে। রামায়ণ ও মহাভারতে বাংলার সমৃদ্ধি ও ক্ষত্রিয়বলের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলার আদিবাসী ও তাদের সংস্কৃতির (অনার্য সংস্কৃতি) প্রতি আর্যদের ঘৃণা, অবজ্ঞা ও কঠোর মনোভাবের কিছু কিছু পরিচয় মেলে। বৈদিক ধর্মসূত্রে প্রাচীন বাংলাকে আর্য সভ্যতার বহির্ভূত করে দেখা হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, মহাভারত ও ভাগবত পুরাণে বাংলার অধিবাসীদের কিরাত, নিষাদ, লুব্ধক, দস্যু, ম্লেচ্ছ, বর্বর, অসভ্য প্রভৃতি ভাষায় হীন প্রতিপন্ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাচীনকালে ছিল নদনদী খাল-বিল-পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা এক স্বতন্ত্র ভূখণ্ড। এখানে অস্ট্রিক-শ্রেণিভুক্ত নানা জাতি ও উপজাতিরা বসবাস করত। এদের প্রতি আর্যদের দারুণ অবজ্ঞা ও ঘৃণার ভাব ছিল। এখানে আর্যরা এলে তাদের জাত যেত-প্রায়শ্চিত্ত না করলে গত্যন্তর ছিল না। পরে অবশ্য তাদের এই উন্নাসিকতা দূর হয়ে যায়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে আর্যরা এদেশে প্রবেশ করে। পাণিনি-পতঞ্জলির গ্রন্থে এবং রামায়ণ, মহাভারত ও বৌদ্ধ জৈন গ্রন্থে বাংলাদেশ শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছে। প্রাচীন বাংলায় ছিল নানা জাতি ও উপজাতির বসবাস। কেউ কেউ বলেন, বাংলার আদিম অধিবাসী কোল, মুন্ডাদের এক দেবতার নাম ছিল ‘বোঙ্গা’- এই বোঙ্গা থেকেই ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি ঘটেছে। এই মতবাদ অবশ্য সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করেনি। প্রাচীনকালে বাংলা নামে সমগ্র দেশের নামকরণ হয়নি। সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ রাঢ়, সুম্ভ, পুণ্ডু, ব্রজভূমি, তাম্রলিপ্ত, সমতট, বরেন্দ্রী, গৌড়, বঙ্গালা, বঙ্গ, হরিকেল প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশের কোনো নির্দিষ্ট নাম ছিল না। একাদশ দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এদেশ সাধারণত গৌড়ভূমি নামে অভিহিত হয়।

গুপ্তবংশীয় রাজগণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মহারাজ শশাঙ্ক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায়

স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শশাঙ্ক অনেক জনপদ জয় করে সেগুলিকে নিজ অধিকারভুক্ত করার ফলে খণ্ড-খন্ড জনপদগুলি ক্রমশ রাষ্ট্রীয় ঐক্য লাভ করতে থাকে।

রাজা শশাঙ্ক

শশাঙ্কের সময় থেকেই বাঙালি এক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে থাকে এবং ইতিহাসের গৌরবটীকা ললাটে ধারণ করে। শশাঙ্ক ছিলেন গৌড় বা বাংলাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে:

‘শশাকের সময় হইতেই একটি মাত্র নাম লইয়া প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন জনপদগুলি ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টার সজ্ঞান সূচনা দেখা দিয়াছিল পাল ও সেন রাজাদের আমলে তাহা পূর্ণ পরিগতি লাভ করিল। এই সময় হইতেই গৌড় নামটির ঐতিহাসিক বাঞ্ছনা যেন অনেকখানি বাড়িয়া গিয়াছিল। এবং পাল রাজারা বঙ্গভাপতি হওয়া সত্ত্বেও গৌড়াধিপতি, গৌড়েন্দ্র, গৌড়েশ্বর নামে পরিচিত হইতেই ভালোবাসিতেন।’

গৌড়কে সমগ্র বাংলাদেশ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি। পাঠান আমল থেকে বাংলার জনপদগুলি বিশেষভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়। সম্রাট আকবরের আমলে বাংলাদেশ ‘সুবাবাংলা’ নামে পরিচিত হয়। আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম বাংলা শব্দটি সমগ্র দেশের নামে ব্যবহার করেন। আবুল ফজল বাংলা নামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আল যুক্ত হয়ে বাংলা শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে। ঔরঙ্গজেবের আমলে সুবা বাংলার যে-অংশ শায়েস্তা খাঁর অধীন ছিল তাকে বলা হত গৌড়মণ্ডল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত বঙ্গ অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের নামেই সমগ্র বাংলার নাম হয় বঙ্গদেশ এবং বাংলার অধিবাসীরা পরিচিত হন বাঙালি নামে। য়ুরোপীয় পর্যটকরা এই দেশকে ‘বাঙ্গালা’ বা বেঙ্গল (Bengala) বলে উল্লেখ করেছেন। এখন বঙ্গ, বাংলা ও Bengal অভিধাগুলি বহুল পরিচিত। মধুসূদন, নবীনচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের রচনায় বাংলা, বঙ্গ ও গৌড় নামের উল্লেখ মেলে।

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গোপাল দেব অষ্টম শতাব্দীতে পালবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পাল রাজবংশের সময়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্ম হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাগীতি পদাবলীতে বাঙালি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি ভুসুকপাদ

পাল বংশ

লিখেছেন- ‘আজি ভুসুক বঙ্গালী ভৈলী।’ অনুমান করা যেতে পারে পাল রাজত্বের পূর্বে খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর মধ্যেই বাঙালি এক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

বাংলার আদিম অধিবাসীগণ আর্যরক্তজাত নয়। ভারতে আর্যদের আগমনের আগে বাংলাদেশে কোল, ভীল, সাঁওতাল, মুণ্ডা, পুলিন্দ, ডোম ও চণ্ডাল প্রভৃতি জাতির বসবাস ছিল। বাংলার বাইরেও এই সমস্ত জাতির বসবাস ছিল। এই সমস্ত জাতিকে অষ্ট্রিক মানবগোষ্ঠীর বংশধর বলা হয়েছে। অনেকে এদের নিষাদ জাতি বলেছেন। অনেকের মতে অস্ট্রিকদের পূর্বে এদেশে ‘নিগ্রোবট্’ নামে এক উপজাতি বাস করত। বাংলায় ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের রক্তধারার সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের গায়ের রং কালো, চুল ঘন কৃয় ও কোঁকড়ানো; নাক মোটা ও চ্যাপ্টা, ঠোঁট পুরু ও ওল্টানো। আকৃতি খর্ব। বিহারের রাজমহল পাহাড়ে, পশ্চিমবাংলার সুন্দরবন অঞ্চলে, নিম্নবঙ্গের বহু জায়গায় ও ময়মনসিংহের পার্বত্য অঞ্চলে এ ধরনের চেহারার লোকের বসতি রয়েছে। কালক্রমে এরা অস্ট্রিকদের সঙ্গে মিশে যায়। অস্ট্রিকরা বাংলাদেশে তথা সমগ্র ভারতবর্ষে কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রার প্রবর্তক। এরপরে বাংলাদেশে প্রবেশ করে অধিকতর সভ্য দ্রাবিড় গোষ্ঠী। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর নরনারীর সঙ্গে এসে মিলিত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলীয় বা ভোটচৈনিক জাতির কয়েকটি শাখা। তারপর খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে বাংলাদেশের এই জনপ্রবাহে এসে মিলিত হল আর্যজাতি। এই আর্যদের ঐতিহাসিকরা Outer Aryan বা বহিরাগত বা আলপোদীনারীয় আর্য বলেছেন। সুতরাং নৃতত্ত্বের দিক থেকে বর্তমান বাঙালি জাতি হল অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় ও আর্যজাতির সংমিশ্রণ। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি একটি মিশ্র গতি। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন।

প্রথম কোলবংশীয় অনার্য, তারপর দ্রাবিড়বংশীয় অনার্য, তারপর আর্য এই তিন মিলিয়া আধুনিক বাঙালি জাতির উৎপত্তি হইয়াছে।*

তারপর ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের পরবর্তীকালে মুসলমান রক্তেরও কিছুটা সংমিশ্রণ ঘটে বাঙালি জাতির মধ্যে। সে যাহোক, বিচিত্র জনসাধারণের মিলিত রক্তে সংকর বাঙালি জাতির অভ্যুদয়। বাঙালির রক্তে রয়েছে বিচিত্র মানব প্রকৃতির সমন্বয়ী শক্তি- ‘আমার আর্থ সংমিশ্রণ শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তারি বিচিত্র সুর।’ বর্তমানের বাঙালি বলতে হিন্দু বাঙালি, মুসলমান বাঙালি ও আদিবাসীদের বোঝায়। বাঙালি

আসলে এক সংকর জাতি। এস্থলে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি উত্তি প্রণিধানযোগ্য:

“বাংলা ভাষা উৎপত্তির আগে বাংলাদেশে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন মানববংশের উৎপত্তি ছিল আলাদা, মূল ভাষা ছিল আলাদা, ধর্ম সভ্যতা সংস্কৃতি রীতিনীতি বহন-সহন চাল-চলন সব আলাদা আলাদা ছিল। খ্রিস্টজন্মের

কাছাকাছি সময়ে এদের নিজ নিজ পৃথক অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু খ্রিস্টান্মের পরে, প্রায় হাজার হাজার বছরের মধ্যে সব উলট-পালট হয়ে গেল। আর্য ভাষা মাগধী প্রাকৃত আর মাগধী অপভ্রংশ, পশ্চিমের বিহার অশ্বল থেকে বাংলাদেশে গড়িয়ে গড়িয়ে আসে-খ্রিস্টজন্মের পূর্বেকার কয়েকশত বৎসর ধরে এই আর্য ভাষার প্রসার বাংলাদেশে হতে থাকে। পরে এই মাগধী প্রাকৃত আর তার পরেকার রূপ মাগধী অপভ্রংশ, বাংলাদেশে বাংলা ভাষার রূপ নেয় খ্রিস্টজন্মের পরে ৮০০-১০০০ বৎসরের মধ্যে। দেশের প্রায় তাবৎ বিভিন্ন জাতির আর ভাষার লোকেরা এই নবজাত বাংলা ভাষাই এহণ করে, ভাষায় ভাবে এক ধরনের হয়ে যেতে থাকে। পরে তারা সকলে বঙ্গাবাসী ‘গৌড়জন’ বা বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়।”

৩. বাংলা ভাষার উদ্ভব

আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষার মধ্যে অন্যতম বাংলা ভাষা। এই ভাষার উদ্ভবের ইতিহাস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতেই বাংলার অধিবাসীরা ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি হিসাবে ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করে। মূলত সেই সময় থেকেই বাংলা ভাষার অঙ্কুরোদ্গম ঘটতে থাকে বলা চলে। ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে খ্রিস্টীয় বৈদিক ভাষা

দশম শতকের কোনো এক সময়ে বাংলা ভাষার জন্ম। তার পরিচয় মেলে চর্যাগীতি-পদাবলীতে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে স্বীকার করতেই হবে যে মানুষের জন্মের মতো কোনো ভাষার জন্মের সময়সীমা সঠিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারণ করা যায় না।

*বঙ্কিমচন্দ্রের সময়ে ভোটচীনীয় বা মঙ্গোলীয়দের সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত ঘটেনি।

খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর আগে থেকেই বাংলা ভাষা ‘হাঁটি-হাঁটি পা-পা’ করে চলতে শুর করেছে। বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে বলা হল যে, এই ভাষার উৎস হল বৈদিক সংস্কৃত। এর প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় ঋগ্বেদ সংহিতায়। এই ঋগ্বেদের ভাষাই বর্তমান ভারতের সমস্ত প্রাদেশিক সাহিত্যিক ভাষার আদি জননী। বৈদিক সংস্কৃত ভারতবর্ষের ইন্দো- ইরানীয় আর্যগোষ্ঠীর ভাষা। ইন্দো-ইরানীয় আর্যগোষ্ঠীর একটি শাখা ভারতে আসে। তাদের নাম ভারতীয় আর্য। বৈদিক সংস্কৃত আর্য জাতির ভাষা।

আর্যরা ভারতবর্ষে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পনেরো শতকের পূর্বে কোনো এক সময়ে এসে পড়ে। তখন ভারতবর্ষে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক নামে দুটি অনার্য জাতির ভাষা ছিল। আর্যরা আসার পর তাদের ভাষা ধীরে ধীরে পশ্চাৎপটে চলে যায়। বৈদিক সংস্কৃতই বহু শত বৎসরের বিবর্তনের পথ দিয়ে বাংলা ভাষার রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলার আর্থীকরণের পূর্বে বাংলার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে সম্ভবত অস্ট্রিক গোষ্ঠীর

কোনো ভাষ। প্রচলিত ছিল। কিন্তু তারা নিজেদের ভাষা লিপিবদ্ধ করে রাখতে জানত না। তাই সে ভাষার সঠিক নিদর্শন পাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলা ভাষায় অস্ট্রিক প্রভাব যথেষ্টই রয়েছে। বৈদিক সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রাকৃত ও অপভ্রংশের বিবর্তনের স্তর অতিক্রম করে বাংলা ভাষার জন্ম।

ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার, ড. সুকুমার সেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ পণ্ডিতের মতে কোনো এক বিস্মৃত অতীতে মধ্য ইউরোপে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী একদল মানুষ বান।

করত। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী মানুষেরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এদের একটি শাখা ইরানে এসে পৌঁছায়। তাদের বলা হয়েছে

বৈদিক সংস্কৃতের ইতিবৃত্ত

ইন্দো-ইরানীয় আর্য। এদেরই একটি শাখা ভারতে আসে। তাদের নাম ভারতীয় আর্য। ভারতীয় আর্যরা দেবতার আরাধনা বিষয়ক যেসব স্তোত্র রচনা করেন তা আনুমানিক প্রাচীনতম নিদর্শন। ঋগ্বেদের ভাষাকে বৈদিক সংস্কৃত বা ছান্দস ভাষা বলা হয়। উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থরাজি এই ভাষাতেই রচিত।

বৈদিক সংস্কৃত ভাষা লোকমুখে বিকৃত হতে থাকলে তখন পাণিনি প্রমুখ বৈয়াকরণেরা ভাষার বিকার রোধ করার জন্য ব্যাকরণের নিয়মাবলি তৈরি করেন। ব্যাকরণের নিয়মানুসারে সাহিত্যিক সংস্কৃত সংস্কার করার ফলে ভাষার যে নতুন রূপ তৈরি হল-তাকে বলা হয়েছে

সাহিত্যিক সংস্কৃত। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে বা তার কিছুকাল পরে বৈদিক সংস্কৃত ভাষার মার্জিত রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাণিনির ব্যাকরণের নিয়মকানুনে বাঁধা এই ভাষা ছান্দস ভাষারই রূপান্তর। বৈদিক সংস্কৃত ও সাহিত্যিক সংস্কৃতের মধ্যে কালগত পার্থক্যের চেয়ে রূপগত পার্থক্যই বেশি। এই সংস্কৃত ভাষা সমগ্র আর্যাবর্ত ও বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রাথমিক যুগের ছান্দস ও সংস্কৃত ভাষাকে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বা Old Indo

Aryan, সংক্ষেপে O.I.A. বলা হয়েছে।

ধীরে ধীরে আর্যরা ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশের তৎকালীন প্রচলিত অনু-আর্য ভাষাগুলির প্রভাবাধীনে এসে ভাষার পরিবর্তনে ধর্মের নিয়মানুসারে সংস্কৃত ভাষা আর নিজের আভিজাত্য রক্ষা করতে পারল না। ফলে

সংস্কৃত ভাষা নতুন একটি রূপ গ্রহণ করল। তখন তার নাম হল প্রাকৃত ভাষা। পণ্ডিতদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বুদ্ধদেবের পূর্বে প্রাকৃত ভাষার জন্ম। প্রাকৃত ভাষার কালপর্ব খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে থেকে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত।

প্রাকৃতের প্রথম স্তরে আমরা পালি ভাষা পাই। অশোকের অনুশাসন ও বুদ্ধদেবের উপদেশাবলী এই ভাষায় রচিত। পালিকে প্রাচীন প্রাকৃত বলা চলে। এর পরের স্তরে প্রাকৃত ভাবার বিভিন্ন রূপ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে প্রায় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত প্রাকৃতপর্ব বলা যেতে পারে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, ভারতবর্ষে প্রদেশগতভাবে বহু প্রাকৃতভাষার প্রচলন ছিল। সংস্কৃতের প্রভাবে সেগুলি সাহিত্যিক উৎকর্ষ লাভ করে। প্রধান প্রধান প্রাকৃত পশ্চিম পাঞ্জাব বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ব্যবহৃত হত। দুঃখের বিষয় এই প্রাকৃতের বিশেষ কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

প্রদেশভেদে প্রাকৃত ভাষার মধ্যে নানাপ্রকার রূপভেদ লক্ষ করা যায়। মগধ অঞ্চলের কথ্যভাষার নাম ছিল মাগধী প্রাকৃত বা প্রাচ্য প্রাকৃত। মাগধী প্রাকৃতের আবার তিনটি রূপভেদ ছিল-পশ্চিম মাগধী, মধ্য মাগধী ও পূর্ব মাগধী। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-

বিভিন্ন প্রাকৃত

চতুর্থ শতকে মৌর্যদের সময়ে এই পূর্ব মাগধী প্রাকৃত বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং খ্রিস্টোত্তর চতুর্থ শতকের মধ্যেই বাংলাদেশে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। প্রাকৃত ভাষাগুলি আবার কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন অপভ্রংশ ভাষার বিকাশ ঘটায়।

অপভ্রংশ

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকে দশম শতক পর্যন্ত মোটামুটি অপভ্রংশ ভাষার কাল। এই প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষার স্তরকে ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা মধ্যভারতীয় আর্য ভাষা বা Middle Indo Aryan, সংক্ষেপে M.I.A. নামে অভিহিত করেছেন।

বিভিন্ন অপভ্রংশ ভাষা থেকে আবার খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, সিন্ধি, বাংলা, ওড়িয়া, মৈথিলি প্রভৃতি আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। এই ভাষান্তরটিকে ঐতিহাসিক দিক থেকে নব্য ভারতীয় আর্যভাষা বা New Indo Aryan, সংক্ষেপে N.I.A. বলা হয়। সেদিক থেকে বাংলা একটি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা।

বাংলা ভাষার সৃষ্টি ঘটেছে পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে। বৈদিক সংস্কৃত ভাষা কীভাবে প্রাকৃত অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়ে বাংলা ভাষার রূপ লাভ করেছে তার দু-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল:

সংস্কৃত ভাষা কালে কালে সরল হতে হতে প্রাকৃত ও অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে বাংলা ভাষার বিশিষ্ট রূপ লাভ করে। বহু অন্-আর্য শব্দও বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যেই বাংলাভাষা আরবি, ফার্সি, পোর্তুগিজ ও ইংরেজি প্রভৃতি বিদেশি ভাষার শব্দসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ইংরেজি শব্দও বাংলায় প্রবেশ করে। আধুনিককালে বাংলা গদ্য ভাষার দুটি বিশিষ্ট আদর্শ দাঁড়িয়ে গেছে-সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা।

ভাষা নদীপ্রবাহের মতো গতিশীল। ভাষাতাত্ত্বিকের মতে, Language is always in flux, যুগের পরিবর্তনে জাতির ভাষা বিবর্তিত হয়। বিবর্তনের পথে পথে তার বিচিত্র রূপসৌন্দর্যের বিকাশ ঘটে। কাল থেকে কালান্তরে ভাষা এমনিভাবেই নূতনতর রূপ নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাইরের এই রূপ পরিবর্তন সত্ত্বেও ভিতরে বাংলা ভাষার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বাংলা ভাষার স্বভাবের কাঠামো অক্ষুণ্ণ রয়েছে

গ্রন্থ রচিত হয়। এতে একশো এগারোজন কবির পাঁচশো পঁচিশটি শ্লোক সংগৃহীত। বেশির ভাগ শ্লোক আদি-রসাত্মক। প্রশ্নটির প্রথম নাম ছিল ‘সুভাষিত রত্নকোশ’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘কবীন্দ্রবচন সমুচ্চয়’ নাম রাখেন। এছাড়া শ্রীধর ভট্ট বৈশেষিক দর্শনের ওপর ‘ন্যায়কন্দলী’ রচনা করেন। ভবদেব ভট্টের ‘ছান্দোগ্য কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি’, জীমূত বাহনের ‘ব্যবহার মৃত্তিকা’, ‘কালবিবেক’ ও ‘দায় ভার’, চক্রপাণি দত্তের ‘চিকিৎসা সংগ্রহ’, ‘আয়ুর্বেদদীপিকা’, ‘ভানুমতী’, ‘শব্দচন্দ্রিকা’ ও ‘দ্রব্যগুণসংগ্রহ’ উল্লেখযোগ্য। গ্রন্থগুলি সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, আয়ুর্বেদ চিকিৎসা সম্পর্কিত।

সেনযুগে ব্রাহ্মণ্য আদর্শপৃষ্ট সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন বেড়ে যায়। সেনযুগে বৈদিক যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়ানুষ্ঠান খুব সমারোহে চলত। বল্লাল সেনের গুরু অনিরুদ্ধ ‘হারলতা’ ও ‘পিতৃদয়িত’ শীর্ষক দুটি গ্রন্থে হিন্দুদের নিত্যকর্ম ও নানা অনুষ্ঠানের আলোচনা করেন। বল্লাল সেন সুলেখক ছিলেন। ‘ব্রতসাগর’, ‘আচারবাসর’, ‘প্রতিষ্ঠাসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ নামক পাঁচটি গ্রন্থে ঝড়, ভূমিকম্প, গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান ও শুভাশুভ লক্ষণ পর্যালোচনা করেন। পন্ডিত ও সুলেখক হলায়ুধ ‘ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব’, ‘মীমাংসা-সর্বস্ব’, ‘বৈশ্বব-সর্বস্ব’, ‘শৈব-সর্বস্ব’ ও ‘পণ্ডিত-সর্বস্ব’ গ্রন্থে হিন্দুদের বৈদিক ক্রিয়াকর্ম ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করতে প্রয়াসী হন। এ সময় বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দ ‘টীকা-সর্বস্ব’ গ্রন্থে অমরকোশের টীকাগ্রন্থ রচনা করেন। পুরুষোত্তম নামধারী দুজন সমসাময়িক বৌদ্ধ লেখক ‘ব্যাকরণ’ ও বৌদ্ধ বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, লক্ষণ সেনের মহাসামন্ত বটুকদাশের পুত্র শ্রীধরদাশের ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ গ্রন্থটি। এতে চারশো পঁচাশি জন কবির দুহাজার তিনশো সত্তরটি কবিতা সংকলিত। কবিতাগুলিতে দেবতা, প্রেম-প্রকৃতি, রাজারাজড়ার স্মৃতি, বৃক্ষ লতাপাতা, পশুপক্ষী, দেশকাল ও কবিপ্রসঙ্গ প্রভৃতি বিচিত্র বিষয় স্থান পেয়েছে। রাজা লক্ষণ সেনের সভা অলংকৃত করতেন উমাপতি ধর, গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ী ও কবি জয়দেব। এঁরা পঞ্চরত্ন নামে খ্যাত। উমাপতি ধর বাক্যবিন্যাসে সুপটু ছিলেন। লক্ষণ সেনের পিতামহ বিজয় সেনের দেওপাড়া প্রশস্তি তাঁর রচনা। শরণ দুর্বোধ্য দুরূহ পদ রচনায় পারদর্শী ছিলেন। গোবর্ধন আচার্য প্রেম ও শৃঙ্গার রসাত্মক সাতশো সংস্কৃত শ্লোকের ‘আর্যাসপ্তশতী’ গ্রন্থ রচনা করেন। ধোয়ী ‘পবনদূত’ ও ‘সত্যভামাকৃষ্ণ সংবাদ’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় নি। ‘পবনদূত’ কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের অনুসরণে লেখা। কাব্যের নায়ক রাজা লক্ষণ সেন, নায়িকা গন্ধর্ব কন্যা কুবলয়বর্তী। কাব্যটি আদিরসাত্মক ও যৌন- শৈথিল্যের পরিচয়বাহী। লক্ষণ সেনের সভাকবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জয়দেব ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য রচনা করেন। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এই কাব্যে প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত জীবনাদর্শের সমন্বয়ে নতুন ঐতিহ্য লাভ করেছে। পরবর্তী প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ওপর এই কাব্যের প্রভাব অপরিসীম। জয়দেবের সংস্কৃত ভাষায় বাংলা ভাষার বাগুঙ্গি উকিঝুঁকি মেরেছে। যেমন- “মধুকর নিকরকরম্বিত কোকিল কুজিত কুঞ্জকুটিরে। দিনমণি-মণ্ডল- মণ্ডন, ভবখণ্ডন, মুনিজন-মানস-হংস।”

সংস্কৃত সাহিত্যের পাশাপাশি বাঙালি প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় গ্রন্থ রচনায় ব্রতী হন। তবে বেশির ভাগ গ্রন্থ বাংলার বাইরে রচিত। চতুর্দশ শতকে রচিত ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ নামক

ছন্দবিষয়ক গ্রন্থের একাধিক শ্লোক বাঙালি কবির রচনা বলে অনুমিত। বাঙালি জীবনের ভোগবিলাসের চিত্র একটি কবিতায় মেলে- ‘ওপর ভত্তা, রম্ভা পত্তা। গাইক ঘিত্তা, দুগ্ধ সজ্জত্তা। মোইলি মচ্ছা, নালিচ গচ্ছা। দিজ্জই কন্তা, খনাঅ পুনবন্তা।।”-অর্থাৎ আঁকাড়া চালের ভাত, মৌরলা মাছের তরকারি, গাওয়া ঘি, দুধ ও নালচে শাক প্রিয়া স্ত্রী কলাপাতায় পরিবেশন করছে, পুন্যবান স্বামী খাচ্ছে।

এছাড়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও প্রবোধচন্দ্র বাগচি আবিষ্কৃত দোহাকোশে বাঙালির সাধন ভজনের গূঢ় ইঙ্গিত রয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় বাংলা ভাষা জন্মের পূর্বে বাঙালির প্রতিভা বিচিত্র দিকে তার স্বাক্ষর রেখেছে। ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। মাতৃভাষা জন্মের পরই বাঙালির ভাবভাবনা ও চিৎপ্রকর্ষ সাবলীল গতিতে প্রবাহিত হয়ে চলল।

২. বাংলা গোড়াপত্তন

পূর্বেই বলা হয়েছে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যেই মাগধী অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে ভূমিকা বাংলা ভাষার জন্ম হয়। বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল সম্পর্কে মোটামুটি পণ্ডিতেরা একমত। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের উদ্ভবকাল সম্পর্কে সঠিক

সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। আজ পর্যন্ত প্রাচীনতম বাংলাগ্রন্থের যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা হল চর্যাগীতি পদাবলী বা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামে খ্যাত একটি বৌদ্ধধর্মগীতি সংকলন। বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তির পূর্বে খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাঙালি কাব্য সাহিত্যে নয়, ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, ব্যাকরণ, অলংকার জ্যোতিষবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ও সামাজিক প্রাকৃতের পর অপভ্রংশ ভাষাই সমগ্র উত্তর ভারতের সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে। পাল রাজবংশের রাজত্বকালে বাংলাদেশে অপভ্রংশ ভাষার গীতি ও গাথা রচিত হয়। কবি হালের ‘গাথা সপ্তশতী’, পিঙ্গলাচার্যের ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ ও কৃষ্ণাচার্যের

বিষয়ে সংস্কৃতে সৃষ্টিপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকেই সংস্কৃতের প্রভাব কমতে থাকে এবং প্রাকৃত ভাষার চর্চা শুরু হয়। বাংলার সংস্কৃত চর্চা

‘দোঁহাকোশ’-অপভ্রংশ রচনার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এই অপভ্রংশের বিবর্তিত রূপের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পূর্ণ হয়। ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ দশম শতাব্দীর রচনা বলেই অনুমিত হয়েছে- সুতরাং এই শতককেই বাংলা সাহিত্যের

প্রাকৃত চর্চা

গোড়াপত্তনের যুগ বলে ধরা যেতে পারে।

আদিযুগে বাংলা রচনা বলে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের ‘হিন্দু বৌদ্ধযুগ’ নামাঙ্কিত অধ্যায়ে শূন্যপুরাণ, মানিক চন্দ্রের গান, নাথগীতিকা, ডাক ও

আদিযুগের রচনা

সপ্তদশ শতকের পূর্বে নয়।

খনার বচন প্রভৃতিকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফেলেছেন। অনেকে নাথগীতিকাকে চর্যার আগের রচনা মনে করেন। কিন্তু অভিমত প্রকৃতপক্ষে নাথ কাহিনি যে শতকে প্রচলিত থাক না , তার লেখ্যরূপ

রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণের রচনাকাল সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলা যায় না। উক্ত গ্রন্থের ভাষার মধ্যে আধুনিকতার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। শূন্যপুরাণের ‘নিরঞ্জনের রশ্মি’ অংশটি

পঞ্চদশ শতাব্দীর কাহিনি নিয়ে লেখা। তাই শূন্য পুরাণের রচনাকাল ষোড়শ শতকের পূর্বের নয়। তবে গোড়ার দিকে ছড়াগুলি লোকমুখে আগে প্রচলিত থাকতে পারে।

ডাক ও খনার বচনকে সাহিত্য বলা যায় না। সমাজজীবনের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে এগুলির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের অভিমত-এগুলি অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর সাহিত্যকর্মের নিদর্শন বলে মানা যায় না।

দ্বাদশ শতাব্দীতে (১২২৯-৩০ খ্রি) মহারাষ্ট্রের চালুক্যরাজ সোমেশ্বরের নির্দেশে ‘মানসোল্লাস’ বা অভিলাষার্থ চিন্তামণি রচিত হয়। এই গ্রন্থের ‘গীতবিনোদ’ অংশে রাধাকৃয় গোপীলীলা বিষয়ক ও দশাবতার স্তোত্রের কিছু কিছু অংশ বাংলায় রচিত বলে আচার্য সুনীতিকুমার জানিয়েছেন। রচনাগুলি চর্যাগীতির সমসাময়িক রচনা বলা যেতে পারে। কিন্তু এই বিক্ষিপ্ত সামান্য রচনাকে বাংলা সাহিত্যের তালিকাভুক্ত করা যায় না, বাংলা ভাষার জন্মক্ষণের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন পরিচয় হিসাবে ধরা যেতে পারে। বাংলা

সিদ্ধান্ত

ভাষার প্রাচীন রূপের পরিচয় রয়েছে ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘শেখা শুভোদয়’ গ্রন্থের একটি প্রেমগীতিতে। এই গ্রন্থে রাম পালের মৃত্যু ও বিজয় সেনের রাজ্যপ্রাপ্তির বিষয়টি সন্নিবেশিত। আচার্য সুনীতিকুমারের মতে বাংলা

ভাষায় এই প্রেমগীতিটি দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত।

মোটকথা, দ্বাদশ শতাব্দীতেই বাঙালির প্রতিভা বাংলা ভাষাকেই আশ্রয় করে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হয়। দ্বাদশ শতকেই বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন ঘটে। তুর্কি আক্রমণে বাঙালির রচিত সাহিত্যসম্ভার অনেক নষ্ট হয়ে গেছে, তা মনে করা অযৌক্তিক নয়। বাংলার প্রাচীন সাহিত্য সম্ভার যে-কোনো উপায়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন বাঙালিরা। তার প্রমাণ নেপাল রাজদরবারে আবিষ্কৃত চর্যাগীতি ও অন্যান্য রচনা। হয়তো ভবিষ্যতে কোনো প্রাচীন বাংলা সাহিত্য আবিষ্কৃত হতে পারে। যতদিন তা না হয়, চর্যাগীতিকেই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসাবে আমরা গ্রহণ করব।

৩. বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাগীতি পদাবলী। এর আবিষ্কারক

ভূমিকা

থেকেই। অতঃপর হাজার বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিবর্তন ঘটেছে নানা শাখায় ও

উপশাখায়।

পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে গ্রন্থটি তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। তারপর ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে চর্যার রচনাকাল দশ শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই হওয়া স্বাভাবিক। যা হোক, বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন ঘটেছে চর্যাগীতি

সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা বাংলা সাহিত্যের ধারাকে কয়েকটি যুগে বিন্যস্ত করেছেন।

  • আদিযুগ: চর্যাগীতিকে নিয়ে বাঙালির যে সাহিত্য সাধনা তা আদিযুগের অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টীয় দশম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা চর্যাগীতির পদগুলি রচিত ও প্রচারিত হয়। আদিযুগের আর কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

ত্রয়োদশ শতকের প্রথমে তুর্কি আক্রমণে দেশব্যাপী অরাজকতা ও ঘোরতর বিশৃংখল ও বিপন্ন অবস্থার জন্য বাংলা ভাষায় কোনো সাহিত্য রচিত হয়নি। কিংবা কিছু রচিত হয়ে থাকলেও বিপুল ধ্বংসের কবতে তা নষ্ট হয়ে গেছে।

  • মধ্যযুগ: তুর্কি আক্রমণের পর প্রায় আড়াইশো বছর কাল বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন মেলেনি। এই সময়ে সাহিত্য প্রায় নিষ্ফলা বলেই একে ‘অন্ধকার যুগ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রিক ঝড়-ঝাপ্টা ও দুর্যোগের পর সামাজিক জীবন একটু সুস্থির হওয়ায় সাহিত্যের মরা গাঙে আবার সৃষ্টির বান ডেকে যায়। এই সময় রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য রচনার কাজ শুরু হয়। ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সমগ্র মুসলমান রাজত্বের যে সময়সীমা তাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘মধ্যযুগ’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মধ্যযুগ থেকেই বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টির অফুরন্ত ফসল ফলেছে। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃয়কীর্তনকে এই যুগের প্রথম পাদে রচিত বলে ধরা হয়েছে। সমকালীন যুগে অনুবাদ সাহিত্য রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল এবং বৈশ্বব পদাবলীর রচনাকার্য চলে। পদাবলী ধারার শাক্তপদাবলীর রচনাকাল সপ্তদশ শতক থেকে। ষোড়শ শতাব্দীতে যে যুগন্ধর মহামানবকে লাভ করে নবজাগৃতির আলোকে বাংলাদেশ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে- সেই মহাবতারের নাম শ্রীচৈতন্যদেব। এঁর অসামান্য চরিত্রের প্রভাবেও ধর্ম আন্দোলনে বাঙালির সমাজ, রাষ্ট্র, ঐতিহ্য ও মানসিকতার বিরাট পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগের প্রায় সমস্ত ধারার সাহিত্য চৈতন্য-প্রভাবে বিবর্তন ও বিকাশের পথ দিয়ে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে আবার চার ভাগে চিহ্নিত করা যেতে পারে:

(১) চৈতন্য-পূর্ব যুগ: এর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, অনুবাদ সাহিত্য ও মনসামঙ্গল কাব্য পড়ে। ২) চৈতন্য যুগ: চন্ডীমঙ্গল কাব্য ও বৈয়বপদাবলী এই পর্বের বিশিষ্ট রচনা। (

(৩) চৈতন্যোত্তর যুগ মনসামঙ্গল কাব্য, চণ্ডীমঙ্গল কাব্য, শিবায়ন, ধর্মমঙ্গল কাব্য, নাথ সাহিত্য, রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ ও মুসলমান কবিদের প্রণয়মূলক উপাখ্যান প্রভৃতির মধ্যে বাঙালি প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ।

(৪) যুগসন্ধি: শিবায়ন ও ধর্মমঙ্গল কাব্য, অন্নদামঙ্গল, শাক্ত পদাবলী, বাউল ও গাথাসাহিত্য এই সবই লেখা হয়েছে। যুগসন্ধিকালে পুরাতন ও নতুন জীবনাদর্শের সমন্বয়ের পরিচয় পাওয়া যায় বাংলা রচনায়। দীর্ঘকাল বাংলা সাহিত্যে যেসব ধর্ম ও দেবতার একাধিপত্য ছিল তা এই সময়ে হ্রাস পেতে থাকে। সাহিত্যে দৈবীচেতনার স্থলে মানব মহিমার প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।

  • আধুনিক যুগ: অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এদেশে ইংরেজ বণিকদের আগমন ঘটে। ধীরে ধীরে ইংরেজ জাতির আধিপত্য ও শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে বাংলাদেশে আধুনিক যুগ শুরু হয় এবং বাংলা সাহিত্যে ঋতু-পরিবর্তন ঘটে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের মতে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ থেকেই আধুনিক যুগ শুরু হয়-প্রাচীন যুগের অবসান ঘটে: ‘On June 23, 1757, the middle ages of India ended and her modern age began.’

আধুনিক যুগ কবে থেকে শুরু তা নির্দিষ্ট তারিখ ও দিনক্ষণ হিসেবে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দকেই মোটামুটিভাবে যুগান্তরের কাল হিসেবে ধরা হয়। এই সময়টাকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার রেনেসাঁস বা নবজাগরণের যুগ বলা হয়। (এ সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ ‘ক’ পর্যায়ে আলোচিত বাংলার নবজাগরণ আলোচনা দেখ)। নবজাগরণ বলতে পূর্বের থেকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি-মানুষের সার্বিক জাগরণ-বিচিত্র দিকে চিন্তাভাবনা ও সৃষ্টির বিকাশ এবং অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায় বহমান কর্মধারা। মূলত ঈশ্বর গুপ্তের সময় থেকেই বাংলা সাহিত্যে মানবতন্ত্রী জীবনাদর্শের প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয় এবং সাহিত্য অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতের প্রভাব থেকে মুক্তিলাভ করে। মানুষই সেখানে প্রধান স্থান পায়। এ সময় বাংলা সাহিত্যে গদ্যের প্রচলন শুরু হয়। মন্ত্রের যুগ শেষ হয়ে গেল, এল যন্ত্রের যুগ। বস্তুত, এই সময়েই মুদ্রাযন্ত্রের আবিষ্কার আপামর জনসাধারণের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। বাংলা গদ্যের সূচনা এই সময় থেকেই। ফলে নাটক, মহাকাব্য, গীতিকাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও ছোটোগল্প প্রভৃতি বিচিত্রমুখী বিকাশের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্য নানা দিকে সম্প্রসারিত হয় এবং রূপ

রসে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

এই আধুনিক যুগের অন্যতম গদ্যশিল্পী রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও প্রমথ চৌধুরী। কাব্যসাহিত্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন ও বিহারীলাল চক্রবর্তীর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নাট্যসাহিত্যে মনোমোহন ঘোষ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। এই আধুনিক যুগেরই বিচিত্রমুখী ও বহুপথগামী এক বিস্ময়কর প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গদ্য, পদ্য ও নাটক সাহিত্যের সব শাখাকেই তিনি তাঁর নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রসমকালীন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, বনফুল, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্রকৃয় চট্টোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, সৈয়দ মুজতবা আলি প্রমুখ বিদগ্ধ লেখক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অসামান্য গৌরবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

সাম্প্রতিককালের শক্তিধর লেখকেরা নিরলসভাবে সাহিত্যসাধনায় ব্যাপৃত আছেন। তাঁদের রচনায় বিচিত্র বর্ণে রূপে রসে জীবন-রহস্যের নবনব দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। এ সময়কার বিশিষ্ট কবি ঔপনাস্যিক ও ছোটোগল্পকারদের মধ্যে অন্যতম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরি, আশাপূর্ণা দেবী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, দিব্যেন্দু পালিত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব গুহ, প্রফুল্ল রায়, মহাশ্বেতা দেবী এবং অতি আধুনিকদের মধ্যে সুচিত্রা

ভট্টাচার্য, বাণী বসু, জয় গোস্বামী, শামসুর রাহমান প্রমুখ। সাম্প্রতিককালে সাহিত্যিকদের একটি বিশেষ প্রবণতা হল অতীতকালের জীবনযাত্রার রূপায়ণ ও তার মূল্য নিরূপণ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘পূর্বপশ্চিম’, ‘সেই সময়’ ও ‘প্রথম আলো’- উপন্যাসগুলি সেদিক থেকে বিশেষ সাহিত্যমূল্যের অধিকারী। উপন্যাসের চরিত্রগুলি সজীব ও প্রাণবন্ত। ইতিহাসের তথ্যপুঞ্জে আবদ্ধ নরনারীকে তিনি রক্তমাংসে সঞ্জীবিত করে তুলেছেন। স্থান কালের প্রেক্ষিতে চরিত্রগুলির সংলাপ সৃষ্টিতে তিনি অসামান্য সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। অতীত সেখানে কলভাষে মুখর হয়ে উঠেছে। পাঠক অতীতের চরিত্রগুলিকে তার সামনেই কথোপকথনরত স্পষ্টোজ্জ্বল দেখতে পায়। এই সৃজ্যমানতার গুণে তাঁর উপন্যাসের শিল্পরূপ নতুন মর্যাদা পেয়েছে।

১. বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় বাঙালির সংস্কৃত রচনাদিকে প্রস্তাবনা পর্যায়ে আলোচনার তাৎপর্য কী? ২. বাঙালি কবিদের সংস্কৃত ভাষায় কাব্য সাধনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

৩. সাহিত্য ছাড়া বাঙালি লেখকেরা সংস্কৃত ভাষায় অন্য কোন্ কোন্ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন সংক্ষেপে আলোচনা করো।

৪. বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

৫. বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।