১. সংক্ষিপ্ত চৈতন্য-জীবনী
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে (১৪৮৬) বাংলাদেশে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত এক যুগান্তকারী ঘটনা। মধ্যযুগের এক ক্রান্তিকালে তাঁর আবির্ভাব। মধ্যযুগের বাংলাদেশে তিনি সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর আবির্ভাবে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি যেমন গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন ভাবকল্পনা ও চিন্তাদর্শে সমৃদ্ধ ও বিকশিত হয়েছে, তেমনি বাংলার সমাজজীবনেরও জন্মান্তর, রূপান্তর সাধিত হয়েছে।
শ্রীচৈতন্যদেবের আদি বাসস্থান ছিল শ্রীহট্টে। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন বৈদিক ব্রাহ্মণ। তিনি ও শ্রীহট্টের নীলাম্বর চক্রবর্তী সহ আরও অনেকে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা বিদ্যার্জনের জন্য নব্য ন্যায় চর্চার অন্যতম কেন্দ্র নবদ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করেন। জগন্নাথের প্রথম সন্তান ছিলেন বিশ্বরূপ। তাঁর বয়স যখন বারো, তখন ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে ২৩ ফাল্গুন দোল পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যাকালে মহাপ্রভুর জন্ম হয়। এর আগে শচীমায়ের পর পর কয়েকটি সন্তান মারা যায়। নবজাত শিশুর নামকরণ হয় বিশ্বম্ভর। ডাকনাম নিমাই। নিমাই মানে নিমের মতো তিক্ত। তাই যম তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই ছিল তৎকালীন সংস্কার। নিমাই-এর গায়ের রং কাঁচা সোনার মতো উজ্জ্বল বলে পাড়া-প্রতিবেশীরা তাঁকে গৌরাঙ্গ বলে ডাকত। মাটি উপায় কি কি বাসনাও কি সমক
মহাপ্রভুর বাল্যকালে তাঁর বড়ো ভাই বিশ্বরূপ বিবাহের ভয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। সেই ভয়ে আদুরে সন্তান নিমাইকে পিতামাতা পাঠশালায় পাঠাননি। বাল্যকালে নিমাই অত্যন্ত দুরন্ত ও চপল ছিলেন। তাঁর নানা প্রকার অত্যাচারে নবদ্বীপবাসীগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। নিমাই কুপুত্র এবং নানাজনের নানাপ্রকার অভিযোগে চিন্তিত হয়ে জগন্নাথ তাঁকে গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোলে ভর্তি করে দিলেন। তীক্ষ্ণধী নিমাই অল্পকালের মধ্যে কাব্য, ন্যায়, ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত হয়ে উঠলেন। তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। নবদ্বীপে তিনি টোল খুলে ছাত্র পড়াতে লাগলেন। শ্রীহট্ট থেকেও অনেক ছাত্র এল।
টোল খোলার অল্পকাল পরে বল্লভ আচার্যের কন্যা লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে নিমাই-এর বিবাহ হল। তখন তাঁর বয়স ষোলো-সতেরো। তারপর পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশোনার ব্যাপারে শ্রীহট্টে চলে যান। অল্পকাল পরে গৃহে ফিরে এসে শুনলেন সর্পদংশনে স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যু হয়েছে। এরপর পিতাও ইহধাম ছেড়ে চলে গেলেন। মায়ের পীড়াপীড়িতে আবার ধনী ও সম্ভ্রান্ত ঘরের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহ হল। দ্বিতীয়বার বিয়ের অল্পকাল পরে তেইশ বছর বয়সে পিতৃপিণ্ড প্রদানের জন্য গয়ায় গেলেন। সেখানে বিশ্বপাদপদ্ম দেখে
বা. সা. ই. পরিচয়-৭
দিব্য ভাবের আবেশে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। বৈপ্লব ভক্ত সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরীর কাছে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা নিলেন। বৈরাগ্যে ভরে গেল চিত্ত। কৃষ্ণবিরহে সর্বদা আকুল মহাপ্রভুর জন্মান্তর ঘটল গয়ায়। নবদ্বীপে ফিরে এসে হরিভক্তদের নিয়ে সংকীর্তনে মেতে উঠলেন। একাজে কাজি ঘোরতর বিরোধিতা করল। চৈতন্য তাঁর ভক্তদের নিয়ে কাজি দলন করলেন। কাটোয়ায় কেশব ভারতীর নিকট মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসী হলেন। এরপর আর তিনি ঘরে ফিরলেন না। শান্তিপুরে গিয়ে অদ্বৈত আচার্যের গৃহে থাকেন। নিত্যানন্দ ও আরও অনেক ভক্ত সেখানে মিলিত হন। ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে অদ্বৈত ও নিত্যানন্দের ওপর বাংলায় বৈশ্ববধর্ম প্রচারের ভার দিয়ে চারজন সঙ্গী নিয়ে পুরীধামে যাত্রা করেন। সেখানে অদ্বৈতবাদী বাসুদেব সার্বভৌম তর্কে পরাস্ত হয়ে ভক্তিমার্গের পথিক হন। উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র তাঁকে গুরুর ন্যায় শ্রদ্ধাভক্তি করতেন। এরপর দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিম ভারত পরিক্রমা করে সাধক তুকারাম, বেঙ্কটভট্ট ও রায় রামানন্দের সাহচর্য লাভ করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রায় রামানন্দের সঙ্গে বৈঘ্নবধর্মের আলোচনা। তারপর ফিরে আসেন পুরীতে। ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবন পরিক্রমায় বের হন। গঙ্গাতীর ধরে শান্তিপুর হয়ে গৌড়ে আসেন। শান্তিপুরে শেষ বারের মতো গর্ভধারিণী মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আর তিনি বাংলায় ফেরেননি।
গৌড়ের নিকট রামকেলিতে হোসেন শাহের দুই মন্ত্রী দবীর খাস ও সাকর মল্লিকের আনুগত্য লাভ করেন। এঁরা চৈতন্যপথের পথিক হন। মহাপ্রভু এঁদের যাবনিক নাম বদলে রাখেন রূপ ও সনাতন। মহাপ্রভুর নির্দেশে দুজন বৃন্দাবন গিয়ে সংস্কৃতে নানা গ্রন্থ রচনা করে বৈশ্ববধর্মের দাশনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এঁদের ভ্রাতুষ্পুত্র জীব গোস্বামীও বৃন্দাবনে গিয়ে বৈশ্ববধর্ম চর্চায় রত থাকেন। বৃন্দাবনে এঁদের সঙ্গে মিলিত হন রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট ও গোপাল ভট্ট। এঁরা সবাই বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী নামে খ্যাত। মহাপ্রভু নানা তীর্থ ঘুরে ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে পুরীধামে ফিরে আসেন। এরপর আঠারো বছর তিনি পুরী ছেড়ে কোথাও যাননি। তাঁর বিশেষ সঙ্গী ছিলেন হরিদাস, স্বরূপ দামোদর, পরমানন্দপুরী ও রায় রামানন্দ।
মহাপ্রভু পুরীধামে সর্বদা কৃষ্ণবিরহে বাহ্যজ্ঞান রহিত হয়ে দিব্যভাবে বিভোর থ াকতেন। কৃষ্ণবিরহে মহাপ্রভুর শরীর ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। অবশেষে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি অমৃতলোকে পাড়ি দেন। তাঁর তিরোধান সম্পর্কে লোচন দাসের অভিমত তাঁর মরদেহ জগন্নাথ বিগ্রহে বিলীন হয়ে যায়। ভিন্নমতে, তিনি পুরীর সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আর ফেরেননি। জয়ানন্দ লিখেছেন পুরীতে রথযাত্রার সময়ে মহাপ্রভু আনন্দে রথের সামনে নৃত্য করতে থাকলে পায়ে ইষ্টকাবিদ্ধ হন। তারই বিষক্রিয়ায় যন্ত্রণা বাড়ে ও জ্বরাক্রান্ত হয়ে তিনি ইহলীলা সংবরণ করেন। আবার রাজনৈতিক চক্রান্তে পান্ডারা তাঁকে হত্যা করেছিলেন বলেও অভিমত প্রচলিত।
২. সমাজজীবনে চৈতন্যদেব
বাংলার জাতীয় জীবনে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব (১৪৮৬ খ্রি.) এক যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনা। বাঙালির সমাজজীবন ও ধর্মদর্শনের উপর তাঁর প্রভাব খুবই ব্যাপক
ও সুদূরবিস্তারী। এই মহাপুরুষ যে বৈশ্ববীয় প্রেমধর্মের আদর্শ প্রচার করেন তাতে সমগ্র বাঙালি জাতির চিত্ত জড়ত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে স্বচ্ছ ও বেগবতী ধারায় সমাজজীবনকে
ভূমিকা নানা দিক থেকে বিচিত্রমুখী বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাঙালি জাতির নবজাগরণ ঘটে। বাঙালির চিন্তায়, কল্পনায়, কর্মসাধনায় ও সমাজ সংগঠনের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রেরণা দিলেন। ষোড়শ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত যে ব্যক্তির মনন ও ধর্মাদর্শের প্রভাব বাংলার সমাজজীবন ও সাহিত্যকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে লালনপালন করেছে তিনি হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের পটভূমিতে বাঙালির আত্ম-উজ্জীবনের সর্বাধিনায়ক শ্রীচৈতন্য।
শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলাদেশ প্রায় আড়াইশো বছরের মুসলিম শাসনে বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। মুসলিম শাসকরা অনেকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্ধ্বে উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন বটে, কিন্তু অভিজাত হিন্দুরা মুসলমান শাসনব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণ সমাজে আদর্শনিষ্ঠা ছিল না বললে চলে। অবৈন্ধুব সম্প্রদায়রা
সমকালীন সমাজ তান্ত্রিক ক্রিয়াধর্ম নিয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত। রাজকর্মচারীদের অত্যাচার লুণ্ঠন ও উৎপীড়ন প্রাধান্য পায়। সমাজে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক পরস্পর বিদ্বেষে সংঘর্ষে পর্যুদস্ত। মুসলমান শাসকদের নিষ্ঠুরতা- ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি’ ও হিন্দুসমাজের অন্তর্গত বর্ণবিভেদ, সম্প্রদায়ভেদ ও উচ্চনীচ জাতিভেদে বাঙালিজীবন বহুধা বিচ্ছিন্ন, ঐক্যভ্রষ্ট ও একান্ত পঙ্গু হয়ে পড়ে। সমগ্র জাতি তখন ঘোর নিরাশার অন্ধকারে ডুবুডুবু। সমাজের ধনীরা স্বভাবতই বিলাসব্যসন প্রাচুর্যের মধ্যে দিন কাটাত। আর্থিক প্রাচুর্যের
জন্যই ধর্মের নামে, পূজাচর্নার নামে ভক্তিবর্জিত নানা বাহ্য আড়ম্বর ও ব্যভিচার প্রশ্রয় পায়। অন্যদিকে দরিদ্ররা ছিল অর্থহীন, নানা কুসংস্কার ও লোকাচারের দাসানুদাস। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সামাজিক নিষ্পেষণে নিম্নশ্রেণিভুক্ত হতম্লান হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। ইসলামের শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে তারা
চৈতন্যধর্ম
আত্মরক্ষার আশ্রয় খুঁজে পায়। সমগ্র হিন্দুজাতির এই মরণাপন্ন অবস্থায় শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব। বৈশ্বব প্রেমধর্মের মাধ্যমে তিনি প্রচার করলেন বিশুদ্ধ উদার মানবিকতার বাণী। সবার ওপরে মানুষ ও মনুষ্যত্বই প্রকৃত জীবনসত্য। ঈশ্বর মানুষের বন্ধু তিনি সন্তান, তিনি প্রেমিক পুরুষ। প্রতি মানুষের হৃদয়দ্বারে প্রেমের কাঙালরূপে তিনি নিত্য বিরাজমান; দ্বার খুললেই মিলন ঘটবে। মানুষে মানুষে কোনো ভেদ নেই। মানবতা সার্থক হয় ঈশ্বরপ্রেমে। চণ্ডালও ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ যদি সে হরিভজনা করে।- ‘মুচি হয়ে শুচি হয় যদি হরি ভজে।’ মহাপ্রভু জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকেই বক্ষে টেনে নিলেন। যবন হরিদাসকে তিনি গ্রহণ করলেন। দুই ঘোর তান্ত্রিক জগাই, মাধাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করল।। শুষ্ক নীতিতত্ত্ববাদী নৈয়ায়িক সার্বভৌম ঠাকুর প্রেমধর্মকে স্বীকার করে নিলেন। নৃপতি হুসেন শাহ মানবতার আদর্শ চৈতন্যের প্রতি সহনশীলতার নীতি ঘোষণা করে ধর্মপ্রচারে আদেশ
দিলেন। মহাপ্রভু স্বাধীনভাবে সকলের নিকট ধর্মপ্রচার করবেন- ‘কাজি বা কোটাল কিবা হউ কোন জন/ কিছু বলিলেই তার লইব জীবন।।’ রাজানুগত্যের ফলে হিন্দুর ধর্ম ও সংস্কৃতি ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির জীবনধারার অনুকরণ থেকে স্বধর্মে রক্ষা করার পথ তৈরি
হল। পরধর্মের প্রতি ঘৃণা ও বিলুপ্তি নয়-পরধর্মসহিষ্ণুতাই আসল মানবধর্ম। এভাবে শ্রীচৈতন্য হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করে জাতিকে নতুন শক্তিতে উদ্দীপ্ত করলেন। অপমানিত, লাঞ্ছিত, মূঢ়, মৃক, ম্লান নতশির জাতিকে তিনি মানবতার নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করলেন। উচ্চনীচ, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-নির্ধন ও হিন্দু-মুসলমান সকলে মানবতার একাসনে বসার সুযোগ পেল। এই মানবিকতার আদর্শ ও সমন্বয়ের বাণী ভারতবর্ষের জাতীয় সংহতির মর্মবাণী তা বহু আগেই চৈতন্যদেবের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। এদিক থেকে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক। একটিমাত্র মানুষ একটি যুগকে, জাতিকে প্রেম ও অহিংসার সমন্বয়ে ও আদর্শে পরিশ্রুত করে যে নতুন চেতনা দেশে সঞ্চার করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। একা শ্রীচৈতন্য মধ্যযুগের বাঙালি সমাজের অন্ধকারকে দীর্ণবিদীর্ণ করে মানবতার সত্য ও প্রেমের করুণ কোমল বিশ্বপ্লাবী নবজাগৃতির অরুণোদয় সম্ভব করে তুলেছিলেন। যুগন্ধর মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে বাঙালি জাতির এই যে সর্বতোমুখী জাগরণ একে চৈতন্য-রেনেসাঁ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বাঙালির সমাজজীবনে চৈতন্যের প্রভাবের ফলশ্রুতি এই যে, সমস্ত অর্থহীন, আচার-সংস্কার ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে বাঙালি জাতিকে তিনি অখণ্ড জাতি হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার বিপুল প্রেরণা দান করেছেন। তিনি উদার ও মানবিক প্রেমধর্মের আদর্শ প্রচার করে অধঃপতিত বাঙালি জাতিকে মুক্তিদান করলেন। জাতি ঐক্যবদ্ধ হল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- প্রেমের অধিকারে সৌন্দর্যের অধিকারে ভগবানের অধিকারে কারও কোনো বাধা থাকল না। হরিনাম সংকীর্তনই ছিল চৈতন্যদেবের ধর্মসাধনার সহজ পন্থা। এর ফলে ধনীনির্ধন ও উচ্চনীচের বৈষম্য এবং জাতিভেদ প্রথার কৃত্রিম বন্ধন আলগা হয়ে যেতে থাকে। মানবিক মূল্যবোধের নতুন মন্ত্রে বাঙালিজাতি নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। কাউকে গ্রাস বা পীড়ন করে নয়, সকলকে নিয়েই মানবতার আদর্শচর্চার দীক্ষা দিলেন মহাপ্রভু। ফলে মনুষ্যত্বের সম্মান ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি নতুন হিন্দু সমাজ গড়ে উঠতে থাকে।
৩. বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেব সাধারণ আলোচনা
সাহিত্য জিনিসটি হচ্ছে সমাজজীবন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার কল্পনাসৃষ্ট ফসল। সুতরাং সমাজজীবনের রীতি-নীতি ও জীবনধর্ম অনুযায়ী কবি সাহিত্যিকের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। শ্রীচৈতন্যের পবিত্র জীবন ও বাণীর স্পর্শে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হল। বাঙালির সামাজিক জীবনে ভাবমূলক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হল- সেই নব প্রবুদ্ধ জীবনচেতনা বাংলা সাহিত্যের পালাবদল ঘটাল। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলা সাহিত্যের উপর শ্রীচৈতন্যের প্রভাব অপরিসীম। শ্রীচৈতন্যদেব নিজে একখানাও গ্রন্থ রচনা করেননি। কিন্তু বাংলাসাহিত্যে তাঁর প্রভাব নানাভাবে সক্রিয়।
চৈতন্য আবির্ভাবের পর পূর্ববর্তী দেশমুখী সাহিত্যের মানবতন্ত্রী মনোভাব প্রাধান্য পেল। জীবনসাহিত্যে ও পদাবলি সংগীতের বিকাশ ঘটল। রবীন্দ্রনাথের মতে পদাবলি সাহিত্য বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের উৎসমুখ খুলে দিল। ভাষা পেল ছন্দ, সংগীত ও শক্তি। আলোর পাখিরা বিচিত্র রাগিণীতে প্রেমের গীত রচনা করল।
চৈতন্যজীবনের আলোকে পদাবলি সাহিত্য আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হল। রাধা ও কৃষ্ণ জীবাত্ম পরমাত্মার প্রতীকে পরিণত হলেন। চৈতন্য প্রবর্তিত বৈঙ্গবধর্মের মূল কথা রাগাণুগা ভক্তি এবং ভক্ত ভগবানের সঙ্গে মধুর প্রেমের সম্পর্ক। তাই চৈতন্যের ধর্ম প্রেম ও ভক্তির বিশিষ্ট এক দর্শন। চৈতন্য পরবর্তীকালের কবিরা সেই বৈশ্ববধর্মে দীক্ষিত হয়ে পার্থিব নরনারীর প্রেমকে আধ্যাত্মিক মহিমায় উন্নীত করলেন। শ্রীচৈতন্যদেব নিজের জীবনচর্চা ও ধর্মসাধনার মধ্যে বিকাশ দিয়ে বৈঘ্নবীয় ভক্তিভাব বা রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার তাৎপর্যকে পরিস্ফুট করেন। তিনি ছিলেন রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ-অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ ও বহিরঙ্গে রাধা। পদকর্তা নরহরি সরকার লিখেছেন- ‘গৌরাঙ্গ নহিত কি মেনে হইত কেমনে ধরিত দে।। রাধার মহিমা প্রেমরসসীমা জগতে জানাত কে।/ মধুর বৃন্দা বিপিন মাধুরী প্রবেশ চাতুরী সার।/ বিরজ যুবতী ভকতি শকতি হইতে কার।’ রাধাকৃষ্মের বৃন্দাবনলীলার ধর্মীয় ব্যাখ্যা মহাপ্রভুর জীবনে একান্ত সহজরূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল বলেই পরবর্তীকালের বৈশ্ববভক্ত কবিরা প্রতিভা বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছেন। প্রায় তিন শতাব্দী কাল জুড়ে বৈশ্বব সাহিত্যের পরিপুষ্টি ও
গৌরচন্দ্রিকা ও
অন্যান্য রচনা
চৈতন্যজীবনীকাব্য পরিণতি ঘটেছে। চৈতন্যোত্তর পদাবলি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে রাধাভাবের রাগানুগা ভক্তির দ্বারা। এছাড়া চৈতন্যজীবনী নিয়ে গড়ে উঠল গৌরচন্দ্র বিষয়ক গীতিকবিতা। মানবচরিত্র সাহিত্যে প্রাধান্য গেল। কিন্তু সেইসব কবিতার মধ্যে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ নামক কবিতাগুলির প্রকৃতি স্বতন্ত্র। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পালাকীর্তনের পূর্বে রাধা ও কৃষ্ণভাবের পরিপূরক বা রসোদ্বোধক যেসব গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ গীত হয়-তাই গৌরচন্দ্রিকা।
মহাপ্রভুর সমগ্র জীবনকে কেন্দ্র করে চৈতন্য-সমকালীন ও চৈতন্যোত্তরকালের কবিরা চৈতন্যজীবনীকাব্য রচনা করেন। বৃন্দাবনদাসের চৈতন্য ভাগবত, জয়ানন্দ ও লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল এবং কম্মদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত উৎকৃষ্ট চৈতন্যজীবনীকাব্য। তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগ আসেনি। তবুও কবিরা সমকালীন মহাপুরুষের জীবন-আলেখ্য চিত্রণে যত্নবান হয়েছেন।
চৈতন্যদেবের প্রভাব ও উদ্দীপনা কেবল বৈশ্বব সাহিত্যের মধ্যে সীমিত থাকেনি। মঙ্গলকাব্যে, অনুবাদকাব্যে ও শাক্তপদাবলিতেও অল্পবিস্তর তার প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছে। চৈতন্যপূর্ব যুগে দেবদেবী ভয়ংকর কুটিল ও হিংস্র প্রকৃতির। তিনি মারেন মরি, বাঁচান বাঁচি-এরূপ দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী। কিন্তু চৈতন্যোত্তর মঙ্গলকাব্যে সেই দেবতা অনেকটা ক্ষেমংকরী-মার্জিত ও পরিশুদ্ধ হল। তাছাড়া বৈশ্বব কবিতার প্রভাবে কোনো কোনো মঙ্গলকাব্যের কবিরাও বিষ্ণুপদ রচনা করেছেন। অন্যদিকে বৈশ্বব পদাবলির আদর্শে স্বতন্ত্র গীতিকাব্যে শাক্ত পদাবলির উদ্ভব ঘটল। শুধু তাই নয় বাউল সংগীতেও বৈষ্ণবভাব অম্লাধিক প্রবেশ করল।
অনুবাদ সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাবও কম নয়। কাশীধাম দাশ বৈশ্বব ভক্ত ছিলেন। তাঁর কাব্যে বৈশ্বব ভাবধারা বিশেষভাবে প্রতিভাত। রামায়ণ ও ভাগবতের পরিবেশ, চরিত্র ও কাব্যরসের উপর চৈতন্য ভক্তিভাবের প্রভাবও যথেষ্ট। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর
শাক্তপদাবলি ও বাউল সংগীতে অনাবিল ভক্তিরসের উৎসার ঘটেছে, তার উপর মহাপ্রভুর
অনুবাদ সাহিত্য ভক্তিভাবের প্রভাবও যথেষ্ট। সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবিরাও বৈশ্বব লোকসাহিত্য ভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁরা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক অনেক গান লিখেছেন। শাক্তপদাবলি ও বাউল লোকসংগীতে রাধাকৃষ্ণের কাহিনি স্থান পেল। মহাপ্রভুর সর্বব্যাপী অসামান্য প্রভাবে বাংলাসাহিত্যের নানা শাখা বিচিত্র বিষয়বস্তু, ভাবসম্পদ ও শিল্পকলায় সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠল।
অনুশীলনী
১। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব বর্ণনা করো। তুমি তাঁকে কেন ভালোবাস?
(উ.মা. ১৯৬০)
২। বাঙালির কাব্যে ও জীবনে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব সংক্ষেপে বর্ণনা করো।
(উ.মা. ১৯৬৩)
৩। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেব ও তাঁর প্রবর্তিত ধর্মমতের কী প্রভাব অনুভব করা যায়-তা আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৭৯)
৪। বাংলা সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব নির্ণয় করো।
(উ.মা. ১৯৮৩)
৫। বৈশ্বব সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করো। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় শ্রীচৈতন্যের প্রভাব কতটা পড়েছিল লেখো।
(উ.মা. ১৯৮১)
৬। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ধর্মান্দোলন একটি শক্তিশালী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-আলোচনা করো।
৭। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকাহিনি সংক্ষেপে লেখো। বাংলা সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো। (উ.মা. ১৯৯৩)
৮। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনী সংক্ষেপে লেখো। বাঙালির সমাজ ও সাহিত্যে তার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।
(উ.মা. ১৯৯৭)
৯। চৈতন্যদেবের জীবনকথা সংক্ষেপে লেখো। বাংলার সাহিত্যে ও সমাজজীবনে চৈতন্যদেবের প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করো।
(উ.মা. ২০০০)